বাংলাদেশের প্রাণ-প্রকৃতিতে মৎস্যসম্পদের সাথে প্রাচীন ঐতিহ্য ও লোকজ জীবনের সমৃদ্ধির চিরন্তন মেলবন্ধন রয়েছে। চিরায়ত সাহিত্যে উঠে আসা আমাদের প্রাচীন জনজীবনের অনায়াসলব্ধ উপকরণ ছিল মাছ, ‘মৎস্য মারিব খাইব সুখে’- এভাবেই উঠে এসেছে গ্রামীণ জীবনের চিত্র। মাছে-ভাতে বাঙালির হাজার বছরের তকমা কখনো ফিকে হয়ে যায়নি। কৃষিব্যবস্থা, খাদ্যাভ্যাস ও পরিবর্তনশীল সমাজবাস্তবতায় মৎস্য যেন আরো অনিবার্য রূপে আবির্ভূত হচ্ছে। উজানে বাঁধ ও পানি প্রত্যাহারের কারণে আমাদের অধিকাংশ নদনদী নাব্য হারানোর পরও দেশের মৎস্যচাষি এবং সরকারের নানাবিধ উদ্যোগের কারণে মৎস্য উৎপাদন আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেড়েছে। আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে ভারত ও মিয়ানমারের সাথে সমুদ্রসীমা বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধানের পর বঙ্গোপসাগরের পানিসীমায় ১ লাখ ১৮ হাজার বর্গকিলোমিটারের বেশি আয়তনের নিষ্কণ্টক জলসীমায় মৎস্যসম্পদের নতুন প্রাচুর্যের হাতছানি। সাম্প্রতিক সময়ে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধিতে সরকারের নানামুখী উদ্যোগ ফলপ্রসূ প্রমাণিত হয়েছে। গত দুই দশকে ইলিশ উৎপাদন দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। আর বিপুল সংখ্যক নদ-নদী, খাল-বিল পানিশূন্য হওয়ার পরও দেশের হাজার হাজার মৎস্যখামারি ও উদ্যোক্তার বহুমুখী উদ্যোগে স্বাদু পানির দেশীয় মাছের উৎপাদন বেড়েছে কয়েকগুণ।
এমনিতেই নানামুখী উদ্যোগের মধ্য দিয়ে মৎস্যসম্পদে সমৃদ্ধ হয়েছে দেশ। বেশ কয়েক বছর আগে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে ২০২২ সালের মধ্যে বিশ্বের চারটি দেশ মৎস্যচাষে বিপুল সাফল্য অর্জন করবে বলে আভাস দেয়া হয়েছিল। এ চারটি দেশের অন্যতম হিসেবে উঠে এসেছিল বাংলাদেশের নাম। বিশ্ব খাদ্য সংস্থার সে ভবিষ্যদ্বাণী মিথ্যা হয়নি। গত সাত-আট বছরে দেশে মাছ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি যে কোনো সেক্টরের চেয়ে বেশি। ইলিশের জাটকা নিধন বন্ধ রাখতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নজরদারি, মৎস্যজীবীদের প্রণোদনাসহ সরকারি উদ্যোগগুলো এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। প্রথম দফায় প্রজননকালীন ইলিশের মা মাছ ধরা বন্ধে তিন সপ্তাহের নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ শেষ হওয়ার এক মাসের মধ্যেই গত ২০ মে থেকে বঙ্গোপসাগর ও উপকূলে ৬৫ দিন মৎস্যআহরণ বন্ধ রাখার নির্দেশনার বাস্তবায়ন চলছে। সরকারের বিশেষ উদ্যোগ ও সংরক্ষণ নীতির কারণেই এবারের প্রজনন মওসুমে এশিয়ার প্রধান ঐতিহ্যবাহী প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদীতে মাছের ডিম ও রেণু সংগ্রহের পরিমাণ গত ১৪ বছরের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। হালদার এই রেণু শিকার আগামী মাসগুলোতে দেশের মৎস্যখামারগুলোতে রেকর্ড পরিমাণ মাছ উৎপাদনের আশা করা হচ্ছে। আগামী ইলিশ মওসুমে সাড়ে ৭ লাখ টনের বেশি ইলিশ আহরণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। করোনার কারণে উপকূলীয় পর্যটন স্পটগুলো জনবিরল হয়ে পড়ার কারণে যেমন সেখানকার জীব-বৈচিত্র্য পরিবেশের অভাবনীয় উন্নতি লক্ষ করা যাচ্ছে, একইভাবে বঙ্গোপসাগরের মৎস্য বিচরণক্ষেত্রগুলোও নতুন প্রাণচাঞ্চল্যে ভরে উঠার খবর পাওয়া যাচ্ছে।
প্রতিটি ধ্বংসের সাথেই থাকে সৃষ্টির নতুন বারতা। করোনাকাল এবং সাম্প্রতিক সামুদ্রিক ঘূর্ণীঝড় আমফানের পর বঙ্গোপসাগরের জীব-বৈচিত্র্য ও প্রাণপ্রকৃতিতে নতুন চাঞ্চল্য দেখা যাচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন। এ সময়ে বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরায় ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা আগামী মওসুমে মৎস্যআহরণের লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। তবে এ সময়ে সরকারি খাদ্য সহায়তা নিয়ে আমাদের জেলেরা মৎস্যআহরণ থেকে বিরত থাকলেও ভারতীয় জেলেদের অনুপ্রবেশ ও মৎস্যলুণ্ঠন ঠেকাতে না পারলে বিশাল ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। সেই সাথে প্রজনন মওসুমের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে উপকূলীয় অগভীর পানিতে শত শত জেলে নৌকার মাছ শিকারের খবর পাওয়া যাচ্ছে। গতকাল ইনকিলাবে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, নৌপুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনকে টাকা দিয়ে ম্যানেজ করেই কিছু সংখ্যক জেলে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে সমুদ্রে মাছ ধরতে যাচ্ছে। সামুদ্রিক মৎস্যখাতের অনেক সম্ভাবনার মধ্যে এটি খুবই হতাশাজনক চিত্র। এই অসাধুচক্রের কারণে নিষেধাজ্ঞা মান্যকারী হাজার হাজার জেলে পরিবারের হতাশ ও বিক্ষুব্ধ হওয়া অস্বাভাবিক নয়। এ ধরনের অপতৎপরতা কঠোরভাবে বন্ধ করতে হবে। এই করোনাকালের অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি এবং আগামী দিনের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কৃষির পাশাপাশি মৎস্যখাতের সম্ভাবনাগুলোকে যে কোনো মূল্যে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। দেশের দরিদ্র মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা এবং মৎস্যরফতানির অপার সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে শিল্পখাতের ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার কার্যকর রোডম্যাপ থাকতে হবে। নিষেধাজ্ঞার সময়ে জেলেদের জন্য সরকারি খাদ্য সহায়তা যেন দুর্নীতি ও অস্বচ্ছতায় ব্যর্থ না হয় সেদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদ সংরক্ষণ, আহরণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ ও শিল্পোদ্যোগে সরকারি-বেসরকারি পরিকল্পনা ও সমন্বয় নিশ্চিত করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন