আমিনুল হক, মীরসরাই (চট্টগ্রাম) থেকে : ইলিশের মৌসুম এলেই জমে উঠতো মীরসরাই উপজেলার কয়েকটি উপকূলীয় জোন। উপজেলার সাহেরখালী, মুহুরী প্রজেক্টের মোহনা, মঘাদিয়া ঘাটে বেড়ে যেত মানুষের কোলাহল। আর এবার সেখানে নির্জীব নীরবতা। এছাড়া সীতাকু-ের কুমিরা, বাড়কবু- ঘাটেও একই অবস্থা বলে জানা যায়। মৎস্য বিভাগ বলছে, নানামুখী পরিবেশগত প্রতিকূলতার জন্যই আগের মতো ইলিশের দেখা মিলবে না। দিনে দিনে কমে যেতে পারে। আবার বাড়লে তাও প্রাকৃতিকভাবে। তাহলে কি সুস্বাদু মজাদার এই রূপালী ইলিশ মাছ আমাদের কাছ থেকে বিলীন হয়ে যাবে?
সাগরে ইলিশের দেখা না পেয়ে হতাশায় দিন পার করছেন এখানকার জেলেরা। প্রতিদিন মাছধরা ট্রলার, নৌকা নিয়ে জেলেরা সাগরে গেলেও ইলিশের দেখা পাচ্ছেন না তারা। জেলেদের কাছে দাদন দিয়ে পাইকাররা ও মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। জেলে শ্রমিক থেকে শুরু করে আড়তদার সবাই হতাশ এখন। অনেক দরিদ্র জেলের ঘরে জ্বলছে না চুলাও।
গত দু’দিন আগে মীরসরাই পৌর বাজারে এক জেলে এক খাঁচা জাটকা সাইজের ইলিশ বিক্রি করতে এলে ক্রেতারা হুমড়ী খেয়ে পড়ে। কিন্তু তা ও দাম আকাশচুম্বি। ছোট সাইজের কেজিতে ৪ টার ইলিশ দাম হাঁকছে ৬ শত টাকা। এর আগে পরে গত ১৫ দিনে মাত্র এই ১ খাঁচা ইলিশই এসেছে সদর বাজারে।
গতকাল ৩০ জুলাই শনিবার মীরসরাই বাজারের মাছ বিক্রেতা তারা জলদাস-এর কাছে ইলিশের বিষয়ে জানতে চাইলে জেলে বললেন এই এলাকার শতাধিক জেলেই ইলিশের অপেক্ষায়। আষাঢ় পেরিয়ে শ্রাবণের শেষে এলাম আমরা। হিসাব অনুযায়ী ইলিশের এই ভরা মৌসুম। তবুও ইলিশ মাছের দেখা নেই। আড়তদারদের সূত্রে জানা যায়, আবার শুধু এখানেই না ইলিশ ধরা পড়ছে না বরিশাল, চাঁদপুরেও।
চট্টগ্রামের রেয়াজউদ্দিন বাজারের এক ইলিশ আমদানিকারক আড়তদার আ. খালেক বললেন, গেল বছর এ সময়ে হাজার মণ মাছ মিলত। এখন কেবল এক-দেড়শ’ মণ মাছ আসে। ট্রলার থেকে তুলতে মণপ্রতি ৪৫ টাকা আর গাড়িতে তুলে দিতে ৪৫ টাকা করে পান। প্রতিদিন বাজারে এলে চা-নাশতা বাবদ ২০-৩০ টাকা চলে যায়। এর পর সংসারের খরচ চালাতে গিয়ে এরই মধ্যে সমিতি থেকে ২৫ হাজার টাকা দেনা করেছেন। বয়স হয়েছে আর অন্য কাজ ভালো বোঝেন না। তাই পেশা বদলাতেও পারছেন না। ফলে এখানেই পড়ে আছেন। তিনি আরো জানান, এক যুগ ধরে ইলিশ আসা কমতে শুরু করেছে। কাজ হারিয়ে চট্টগ্রামের বাইরে থেকে আসা শ্রমিকদের অনেকে পেশা বদল করেছেন, নয়তো বাড়ি চলে গেছেন। যারা থেকে গেছেন, তাদের মধ্যে যারা নিরূপায়, তারাই কেবল মাছঘাটে কাজ করছেন। মাছের মৌসুম শেষে আড়তদাররা যেমন তরমুজ বা অন্য ফলের ব্যবসা করেন, শ্রমিকরাও তখন ওই কাজ করে জীবন চালান। অপর এক ব্যবসায়ী জানান, গত এক সপ্তাহে সাগর থেকে মাত্র সাতটি ট্রলার বাজারে ফিরছে। যাতে মাত্র ৫শ’ পিস ইলিশ মাছ পাওয়া গেছে। এতে তাদের যাতায়াত খরচও উঠেনি। ইলিশের দেখা নেই বলে কষ্টের কথা জানালেন মিঠাছড়ার বরফ কলের শ্রমিক মো. দিদার। এমন সময়ে প্রতিদিন ১০০ ক্যান বরফ ভাঙতেন তারা। এখন অন্য মাছের জন্য বরফ নিতে এলেও ইলিশের জন্য আসছে না কেউ। এই বিষয়ে মীরসরাই উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী জানান, বঙ্গোপসাগরের এই অংশে জলবায়ু পরিবর্তন, নদীতে পানি কমে আসা, সাগর মোহনায় চর জাগাসহ নানামুখী পরিবেশগত প্রতিকূলতার জন্যই আগের মতো ইলিশের দেখা যে মিলবে না। তিনি বলেন, বিশেষ করে সাগরের হাতিয়া অংশে বিশাল চর সৃষ্টি হওয়ায় সাগরের গভীর পানির এই ইলিশের ঝাঁক চলে যাচ্ছে বরিশাল, ঝালকাঠি ও চাঁদপুরের দিকে। এই রূপালী ইলিশ কি তাহলে এই জনপদ থেকে বিলীন হয়ে যাবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রাকৃতিক ভাবেই কিছু বছর পর সমুদ্র জলভাগ ও স্থলভাগের পট পরিবর্তন হয়। সেক্ষেত্রে আবার সুমৌসুমের অপেক্ষাই করতে হবে বলে তিনি জানান। তবে আবার আশার বিষয় হলো চাঁদপুরের ইলিশ গবেষণা প্রকল্পের পরিচালক ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. আনিচুর রহমান বলেন, এই মৌসুমে ইলিশ একদম ধরা না পড়ায় বিষয়টি তাদের ভাবিয়ে তুলছে। এটি খতিয়ে দেখার জন্য ব্যবস্থা নেবেন তারা। তবে আবার এই কর্মকর্তা আরো জানান, ইলিশের মৌসুম এখন থেকেই হলেও মূল মৌসুম এখনো রয়ে গেছে। সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরজুড়ে সর্বশেষ ভরা মৌসুম। তবে এবার আগাম ইলিশের দেখা কম মিলছে বলে জেলেরা হতাশ। তবে নদীতে পানি বাড়লে মূল মৌসুমে এবার বড় সাইজের ইলিশের দেখা মিলবে বলে আশা করেন তিনি। আর তখন আনুপাতিক হারে ছোট ইলিশের পরিবর্তে বড় ইলিশই বেশী পাবার সম্ভাবনা আছে বলে তিনি জানান।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন