বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

পাট নিয়ে বিপাকে চাষি

আতিক সিদ্দিকী | প্রকাশের সময় : ১৩ জুলাই, ২০২০, ১২:৩১ এএম

দেশের সোনাফলা মাঠে সোনালি আঁশ তথা পাটচাষ আমাদের প্রচলিত আবাদের একটি বড় অংশ। ফসলের মাঠে পাট আবাদ হবে না এমনটা কল্পনাও করা যায় না। পাট কেবল মিলে নয় আমাদের দেশে গ্রামীণ জনপদের পারিবারিক জীবনে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। পাটের কিছুই ফেলনা নয়। সরকারি পাটকল বন্ধে সোনালি আঁশ খ্যাত পাটের ভবিষ্যত নিয়ে দেখা দিয়েছে নানা অনিশ্চয়তা। কৃষকের মাঠে এখনও কাঁচা পাট দাঁড়িয়ে আছে। পাট কাটার সময় এখনও আসেনি। পাটকাটা জাগ দেয়া, রোদে শুকানো সবমিলিয়ে এখনও এক মাসের ওপরে সময় লাগবে পাট হাটে নিতে কৃষকের। এমন সময় পাটকল বন্ধের খবরে মাঠের পাট নিয়ে দু’চোখে অন্ধকার দেখছে কৃষক। পাট নিয়ে হাটে নয় পথে বসতে চলেছে তারা। 

দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত সকল জুটমিল ১ জুলাই থেকে বন্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। অব্যাহত লোকসানের কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত ২৫টি জুটমিলের ২৪ হাজার ৮৮৬ জন স্থায়ী কর্মচারীর চাকরি একই সাথে গোল্ডেন হ্যান্ডশেকে অবসরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। জুটমিল বন্ধ হলে পাট কেনাও বন্ধ হয়ে যাবে, সেটাই তো স্বাভাবিক। পাটচাষিরা তাদের উৎপাদিত পাট নিয়ে কোথায় যাবেন? করোনা আক্রান্ত পৃথিবীকে জাগিয়ে তোলবার জন্য কৃষিকে যখন সবাই গুরুত্ব দিচ্ছে। সে সময় পাটচাষিরা পাট নিয়ে সীমাহীন দুশ্চিন্তায় পড়েছে। পাটচাষিদের কথা না ভেবে এমন সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছে দেশের সচেতন সমাজ। সিদ্ধান্ত যদি নেয়াই হবে তাহলে উচিৎ ছিল কৃষককে আগেভাগে জানিয়ে দেয়া। কৃষকের আগে থেকে জানা থাকলে পাটচাষে নগদ পুঁজি বিনিয়োগ করতে যেতেন না তারা।

সোনালি আঁশ পাটকে অর্থনৈতিকভাবে দেশের সমৃদ্ধিতে কাজে লাগানোর জন্য স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশন (বিজেএমসি) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। প্রতিষ্ঠাকালে বিজেএমসির আওতায় ৭০টিরও বেশি জুটমিল নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল। কিন্তু অব্যাহত লোকসানের কারণে জুটমিলের সংখ্যা কমতে থাকে। লোকসানের বিশাল বোঝা মাথায় নিয়ে ২৫টি জুটমিল টিকেছিল। ১ জুলাই থেকে সর্বশেষ ২৫টি জুটমিল বন্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, জুটমিল প্রতিষ্ঠার ৪৮ বছরের মধ্যে প্রায় অর্ধেক সময়কাল ধরে লোকসানে ছিল বিজেএমসি। বর্তমানে বিজেএমসি’র লোকসানের পরিমাণ ১০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। যদিও বেসরকারি খাতের জুটমিলগুলো ঠিকই মুনাফা করছে। বেসরকারি জুটমিল লাভ করে আর সরকারি জুটমিলের লোকসান হয়। লোকসানের এমন ভয়াবহ চিত্র বলে দেয় ব্যাপক দুর্নীতির কথা। বিশ্লেষকরা বলছেন, মিল বন্ধের সিদ্ধান্তে কোনো সমাধান নেই। প্রয়োজন কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারিদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ। করোনা ভাইরাসের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববাজারের পাটের চাহিদা বাড়ছে, এমন একটি সম্ভাবনাময় সময়ে দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত জুটমিল বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশ্লেষকরা। তাঁদের ধারণা, মাথায় ক্ষত রেখে পায়ের ঘা সারানোর চেষ্টা করছে সরকার। জুটমিলের আধুনিকিকরণ করে চালু রাখা সম্ভব ছিল।

৭০’র দশকে প্লাস্টিক ও পলিথিন পাটতন্তুর বিকল্প পণ্য হিসাবে বাজারে এলে আদমজী জুটমিলের উৎপাদিত পণ্যের চাহিদা দেশে এবং দেশের বাইরে কমতে থাকে। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীনের পর এটিকে জাতীয়করণ করা হয়। কিছুদিন যেতে না যেতেই লোকসানে চলে যায় প্রতিষ্ঠনটি। শ্রমিক ও মূলতঃ বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর বিরোধিতা স্বত্তে¡ও লোকসানের বোঝা বইতে না পেরে ২০০২ সালের ৩০ জুন এই মিলটি বন্ধ করে দেয় তখনকার সরকার।

বর্তমানে বিজিএমসি’র অধীনে জুট ফাইবার গ্লাস ইন্ডাস্ট্রিজ লি., গালাক্সী হাবীব লি. ও মিল ফার্নিসিং লি. এই ৩টি নন জুট প্রতিষ্ঠানসহ মোট ২৬টি মিল রয়েছে। ঢাকা অঞ্চলের অধীনে ৭টি, চট্টগ্রাম অঞ্চলের অধীনে ১০টি এবং খুলনা অঞ্চলের অধীনে ৯টি মিল রয়েছে। এরমধ্যে একটি জুটমিল আগে থেকেই বন্ধ রয়েছে। অঞ্চলভিত্তিক এসব জুটমিল দেখভালের জন্য বিজেএমসির দুটি আঞ্চলিক কার্যালয় রয়েছে। দেশে পাট উৎপাদন এলাকাগুলোতে ১৬০টি পাটক্রয় কেন্দ্র রয়েছে। এ সব ক্রয় কেন্দ্রের মাধ্যমে কৃষকদের কাছ থেকে বিজেএমসি পাট ক্রয় করে থাকে। বিজিএমসি দেশের বৃহত্তম পাটপণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান হিসাবে হেসিয়ান কাপড়, ব্যাগ, বস্তার কাপড়, বস্তা, সুতা, জিও-জুট, কম্বল, মোটা কাপড়, সিবিসি ইত্যাদি প্রস্তুত করে আসছে, যা সম্পূর্ণ রূপে প্রাকৃতিক তন্তুজাত পণ্য। বিজেএমসি তাদের নিজস্ব বিক্রয় বিভাগ দেশি ও বিদেশি ক্রেতাদের কাছে বিক্রয় করে থাকে। এভাবে জাতীয় অর্থনীতিতে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে বিজেএমসি গুরুত্বপ‚র্ণ ভ‚মিকা পালন করে থাকে। বিজেএমসি জনবল ও অবকাঠামো বিবেচনায় দেশের সর্ববৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান। সংস্থাটিতে বিভিন্নপদে প্রায় ৭০ হাজার শ্রমিক এবং সাড়ে ৫ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী ছিল।এসব কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শ্রমিকদের আয়ের ওপর তাদের পরিবার এবং প্রায় ৬০ লক্ষ কৃষি পরিবারের জীবন-জীবীকা নির্ভর করে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, সারা বিশ্ব এখন সবুজায়নে জোর দিচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) ২৮টি দেশ পলিথিন ব্যবহার বন্ধের সিদ্ধান্তে একমত হয়েছে। এতে ওইসব দেশগুলোয় বিপুল পরিমাণে পলিথিনের বিকল্প হিসেবে পাটের ব্যাগের চাহিদা সৃষ্টি হবে। পলিথিনে বিকল্প হিসেবে গোটাবিশ্বে পাটের তৈরি পণ্য সামগ্রীর বড় ধরনের চাহিদা তৈরি হচ্ছে। তাছাড়া পাটের শপিং ব্যাগ, শৌখিন ও আসবাব সামগ্রী তৈরির কাঁচামাল উৎপাদনের সুযোগ রয়েছে। ফলে রফতানির অন্যতম খাত হতে পারে আমাদের পাট ও পাটজাত পণ্য। একসময় পাট দিয়ে শুধু দড়ি, কাছি, চট, ছালা তৈরি করা হতো। পাটের বহুমুখী ব্যবহার সেদিন পালটে দিয়েছে। এছাড়া লাইফস্টাইল পণ্য ও গিফট তৈরি করা সম্ভব পাট দিয়ে। অথচ, এই সময়ে এসে রাষ্ট্রায়ত্ত জুটমিল বন্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস জানিয়েছেন, শ্রমিকদের পাওনা বুঝিয়ে দিয়ে জুটমিলগুলোকে সংস্কার ও আধুনিকায়ন করা হবে। এছাড়াও তিনি বলেন, মূলত শ্রমিকদের সুরক্ষার জন্য ৫০ শতাংশ পারিবারিক সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে দেয়া হবে। এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি আরও যা বলেন সেটা হচ্ছে এতে শ্রমিকরা এখন যে অবস্থায় আছেন তার চেয়ে বেশি ভালো থাকবেন। অন্যদিকে, ধারাবাহিকভাবে লোকসানে থাকা রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর প্রায় ২৪ হাজার ৮৮৬ জন স্থায়ী কর্মচারীর চাকরি গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে অবসরের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী। বস্ত্র ও পাট সচিব লোকমান হোসেন মিয়া বলেছেন, শ্রমিকদের অবসরে যাওয়ার পর আগামী ছয় মাসের মধ্যে পিপিপির (সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব) আওতায় আধুনিকায়ন করে এসব জুটমিলকে পুনরায় চালু করা হবে। তখন এসব শ্রমিক সেখানে চাকরি করার সুযোগ পাবেন। ২০১৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত যে আট হাজার ৯শ’ ৫৪ জন শ্রমিক অবসরে গেছেন, তাদের সব পাওনাও একইসাথে মিটিয়ে দেয়া হবে বলে সেদিন জানিয়েছেন পাটমন্ত্রী। বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন এর বিরোধিতায় মিছিল-সমাবেশের মতো কর্মস‚চি পালন করেছে। দেশে তিন দিনের একটি কর্মসূচি পালন করছে দেশটির রাষ্ট্রায়ত্ত জুটমিলগুলোর শ্রমিকেরা। সরকার বলছে, পাটকলগুলোতে বছরের পর বছর লোকসান হচ্ছিলো। শ্রমিক নেতারা সমাবেশ থেকে দাবি তুলেছেন, লোকসানের শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে হবে। তারা বলছেন, পাটজাত পণ্যের জন্য দেশকে ভারতনির্ভর করে তুলছে। তাই অবিলম্বে রাষ্ট্রায়ত্ব জুটমিল বন্ধের সিদ্ধান্ত বাতিল করতে হবে।

বিশ্বে পাট ও পাটজাত পণ্যের চাহিদা যেখানে বাড়ছে, সেখানে রাষ্ট্রায়ত্ত জুটমিল আধুনিকায়নের নামে শ্রমিক ছাঁটাই নয়, বরং নতুন শ্রমিকের নতুন করে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে বলে যুক্তি দিয়ে আসছেন তারা। বেসরকারি জুটমিলগুলো লাভ করতে পারলেও বিজেএমসির আওতাধীন মিলগুলোতে কেন বছরের পর বছর লোকসান করে যাচ্ছে, সেটি খুঁজে বের না করে মিল বন্ধ করে অবসরে পাঠানো কি ঠিক হলো? উচিৎ ছিল অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম ও দুর্নীতি খুঁজে ব্যবস্থা নেয়া। সরকার ২৫টি রাষ্ট্রায়ত্ত জুটমিল বন্ধ করে যে প্রায় পঁচিশ হাজার স্থায়ী শ্রমিককে গোল্ডেন হ্যান্ডশেক কর্মসূচির মাধ্যমে অবসরে পাঠাচ্ছে তারা তাদের সব পাওনা নগদ টাকা হিসেবে পাবেন না। অর্ধেক পাবেন নগদে আর বাকী অর্ধেক পাবেন সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে। পাওনা সকল অর্থই ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে পরিশোধ করা হবে। এক সময় আদমজী জুট মিলস ছিল বাংলাদেশের একটি খ্যাতনামা জুটমিল। নারায়ণগঞ্জ শহরে অবস্থিত এই জুটমিলটি পৃথিবীর বৃহত্তম জুটমিল হিসাবেও খ্যাত ছিল। ১৯৫১ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠিত হয় আদমজী জুট মিল। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের দ্বিতীয় জুটমিল ছিল এটি, প্রথমটি ছিল বাওয়া জুটমিল। পূর্ব পাকিস্তান তথা আমাদের সোনার বাংলাদেশে উন্নতমানের পাট ব্যবহার করে আদমজী পাটকলে বিভিন্ন পাটজাত দ্রব্য প্রস্তুত করা হতো। এটিকে এক সময় বলা হতো স্কটল্যান্ডের ডান্ডির নামানুসারে প্রাচ্যের ডান্ডি। বাংলাদেশের উন্নতমানের পাঠে তৈরি উন্নতমানের পাটজাত পণ্যের সুনাম ছিল বিশজুড়ে। প্রচুর পাটের আবাদ হয় আমাদের দেশে। মাঠে পাট রয়েছে। এখনও পাটকাটা জাগ দেয়া এবং শুকানো এসব কাজ শেষ করে বিক্রিতে সময় লাগবে এক থেকে দেড় মাস। পাটের দেশে পাটকল বন্ধের এমন সিদ্ধান্ত কৃষককে দিশেহারা করে তুলেছে। মাঠে কাঁচাপাট রেখে মাথায় হাত দিয়ে দুশ্চিন্তায় দিন পার করছে তারা।
লেখক: সাংবাদিক ও কলাম

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন