করোনা প্রাদুর্ভাবের এই সংকটকালীন সময়ে ঢাকার বাড়িওয়ালারা যেন আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছেন। মানবিক হওয়ার বদলে হয়ে উঠছেন রীতিমত দানবিক। বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটিয়ার মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতা আমাদের বহুদিনের। ইচ্ছা মতো ভাড়া নেয়া, ইচ্ছামত ভাড়া বাড়িয়ে দেয়া, ভাড়া নিয়ে অনেক সময় রশিদ না দেয়া বা অশালীন আচরণ ইত্যাদি ঘটনা দীর্ঘদিনের স্বাভাবিক বিষয়। শুধু ঢাকা নয় কমবেশি দেশের বড় শহরগুলোতেও বিষয়টা লক্ষণীয়। মূলত আইন বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণেই বাড়িওয়ালাদের এমন অনিয়ম ও অত্যাচারের লাগামহীন সংস্কৃতি দিনের পর দিন মাত্রাতিরিক্ত হয়ে উঠেছে। ঢাকা শহরে একটা বাড়ির মালিক হওয়া মানে যেন পুরো বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের জীবন মান বা জীবনের মূল্যবোধগুলোকে কিনে নেওয়া। সঙ্কটকালীন এই সময়ে সরকারের আইন ও কঠোর নির্দেশনাকে তোয়াক্কা না করে অনেক প্রভাবশালী বাড়িওয়ালাই ভাড়া না পাওয়ায় তাঁদের ভাড়াটিয়াদের বের করে দিচ্ছেন বিনা নোটিশে। মানছেন না কোনো নিয়মনীতি।
বাসা ভাড়া দেওয়া ও নেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের ‘বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৯১’ থাকলেও সেটি না মানায় আজ ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে শুধুমাত্র ভাড়াটিয়াদের। অনেক বাড়ির মালিক সে সম্পর্কে জানেন না। আবার কেউ কেউ জানলেও সেটি গ্রাহ্য করেন না। এই প্রবণতা রাজধানী ঢাকাতেই বেশি। মাথা গোঁজার ঠাঁই এবং বাড়তি সুযোগ-সুবিধা ও নিরাপত্তার খাতিরে ভাড়াটিয়ারা মেনে নিচ্ছেন মালিকদের স্বেচ্ছাচারিতা। আইনের ১০ নং ধারায় বাসা ভাড়া নেওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রিম এক মাসের ভাড়া নেওয়ার কথা থাকলেও অনেক মালিক নিচ্ছেন কমপক্ষে তিন মাসের ভাড়া। এলাকাভেদে ছয় মাসের ভাড়াও নেওয়া হচ্ছে। আইনের ১৬ নং ধারায় বড় কোনো ধরনের নির্মাণকাজ বা পরিবর্তন আনা ছাড়া দুই বছরের মধ্যে মূল ভাড়া বৃদ্ধির নিয়ম না থাকলেও গত ২০ থেকে ২৫ বছরে ঢাকাতেই ভাড়া বেড়েছে ২০০ শতাংশ। এছাড়া ভবনে পানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ সরবরাহ সংশ্লিষ্ট রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের খরচ মালিকপক্ষের বহন করার কথা থাকলেও এটিও ভাড়াটিয়াদের উপর চাপিয়ে দেওয়ায় প্রতিমাসে অতিরিক্ত ৫ থেকে ১০ হাজার বেশি টাকা গুনতে হচ্ছে ভাড়াটিয়াদের।
ইদানীং লকডাউনের কারণে কাজকর্ম বা আয় রোজগারের পথ বন্ধ থাকায় অনেক ভাড়াটিয়া পারছেন না সময় মতো বাড়িভাড়া পরিশোধ করতে। সম্প্রতি বাড়িভাড়া পরিশোধ করতে না পারায় কুষ্টিয়ার কমলাপুরে নয় মাসের অন্তঃসত্ত¡া নারীকে পুড়িয়ে হত্যা করা এবং বিভিন্ন রকম হুমকি ধামকিসহ অত্যাচার করে দুই মাসের সন্তানসহ স্বামী-স্ত্রীকে প্রচÐ বৃষ্টিতে রাতের বেলা বাসা থেকে বের করে দেয়ার মতো ঘটনাও আমরা দেখেছি। করোনা প্রাদুর্ভাবের এই সময়ে বিনা নোটিশে শিক্ষার্থীদের উৎখাত করছেন ঢাকার বাড়িওয়ালারা। ধানমÐিতে শিক্ষার্থীদের সনদ, ল্যাপটপসহ সব জিনিসপত্র ভাগাড়ে ফেলে দিয়েছেন এক বাড়িওয়ালা। জানা গেছে, মার্চের মাঝামাঝিতে লকডাউনের কারণে ধানমÐির এক বাসায় সাবলেটে থাকা নয়জন শিক্ষার্থী যার যার বাড়িতে চলে যান। সম্ভবত গত মাসের ২৫ তারিখে বাড়িওয়ালা বাসা ভাড়া চাইলে শিক্ষার্থীরা বিদ্যুৎ, গ্যাস বিল ও বাসা ভাড়াসহ কয়েক হাজার টাকা দিয়ে অনুরোধ করেন বাকী টাকা দ্রæতই ঢাকায় এসে পরিশোধ করবেন। তার চারদিন পরে অর্থাৎ ২৯ তারিখ সজিব নামের কুমিল্লার এক ভাড়াটিয়া ঢাকা কলেজের ইসলামের ইতিহাসের শেষ বর্ষের ছাত্র ঢাকায় এসে জানেন তাঁর গুরুত্বপূর্ণ সনদ, রুমমেটদের কারো এইচএসসি পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশন কার্ড, প্রবেশপত্র, বইপত্র, ল্যাপটপ, কাপড়চোপড়সহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় ব্যবহার্য জিনিস ভাগাড়ে ফেলে দেয়া হয়েছে। খুঁজে পাননি কিছুই।
তাদেরকে হুমকিও দেয়া হয়েছে দফায় দফায়। এখন বাসার দরজায় মালিক সাজিয়ে উচ্চ পদস্থ এক সামরিক কর্মকর্তার নাম ঠিকানা সেঁটে দেয়া হয়েছে। আরো জানা গেছে, প্রভাবশালী ঐ বাড়িওয়ালা তার নিকটাত্মীয় এক সামরিক কর্মকর্তার প্রভাব দেখিয়ে সজিব ও তার রুমমেটদের নানা রকম ভয়ভীতি প্রদর্শন করছেন, যাতে তারা কোন আইনি ব্যবস্থা না নেন। অন্যদিকে আরো একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৩০ জন শিক্ষার্থীকে একই ‘অপরাধে’ বিনা নোটিশে হোস্টেল থেকে বের করে তাদের জিনিসপত্রও গ্যারেজে স্তূপ করে রাখা হয়। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, লাগামহীনভাবে বেড়ে যাওয়া নিয়মনীতিবহির্ভূত বা সরকারের নির্দেশনাকে পাশ কাটানো বাড়িওয়ালাদের এসব অত্যাচার কবে থামবে? সরকারের উচিৎ ঢাকা শহরের এই নিয়ন্ত্রণহীন বাড়ি ভাড়ার বিষয়টি কঠোরভাবে তদারকি করা। বাড়িওয়ালাদের অনিয়ম, অত্যাচার বন্ধে বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৯১ প্রয়োজনে সংশোধনপূর্বক দ্রæত বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি।
লেখক: প্রকৌশলী
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন