শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

স্বাস্থ্য

করোনাভাইরাসের বৃত্তান্ত ও কিছু পরামর্শ

| প্রকাশের সময় : ১৭ জুলাই, ২০২০, ১২:০৪ এএম

করোনাভাইরাস মূলত স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং পাখিদেরকে আক্রান্ত করে। মানুষের মধ্যে করোনাভাইরাস প্রথমত শ্বাসনালীর সংক্রমণ ঘটায়। এই সংক্রমণের লক্ষণ মৃদু হতে পারে, অনেক সময় যা সাধারণ সর্দিকাশির ন্যায় মনে হয়। অন্যান্য প্রাণীতে এই লক্ষণের তারতম্য দেখা যায়। যেমন মুরগির মধ্যে এটা উর্ধ্ব শ্বাসনালী সংক্রমণ ঘটায়, আবার গরু ও শূকরে এটি ডায়রিয়া সৃষ্টি করে। মানবদেহে সৃষ্ট করোনাভাইরাস সংক্রমণ এড়ানোর মত কোনো টিকা বা অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ আজও আবিষ্কৃত হয়নি।
এ বিষয়ে রাজধানীর শনির আখরার রূপসী বাংলা হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ ডা. জহুরুল হক সাগর বলেন, এরা পজিটিভ সেন্স একক সূত্রবিশিষ্ট আবরণীবদ্ধ বা এনভেলপড ভাইরাস। তাদের নিউক্লিওক্যাপসিড সর্পিলাকৃতির। এর জিনোমের আকার সাধারণত ২৭ থেকে ৩৪ কিলো বেসপেয়ার-এর মধ্যে হয়ে থাকে, যা এ ধরনের আরএনএ ভাইরাসের মধ্যে সর্ববৃহৎ। করোনাভাইরাস শব্দটি ল্যাটিন ভাষার করোনা থেকে নেয়া হয়েছে, যার অর্থ ‘মুকুট’। কারণ দ্বিমাত্রিক সঞ্চালন ইলেক্ট্রন অণুবীক্ষণ যন্ত্রে ভাইরাসটির আবরণ থেকে গদা-আকৃতির প্রোটিনের কাঁটাগুলির কারণে এটিকে অনেকটা মুকুট বা সৌর করোনার মত দেখায়। ভাইরাসের উপরিভাগ প্রোটিন সমৃদ্ধ থাকে যা ভাইরাল স্পাইক পেপলোমার দ্বারা-এর অঙ্গসংস্থান গঠন করে। এ প্রোটিন সংক্রমিত হওয়া টিস্যু বিনষ্ট করে। ভাইরাসটি ডাইমরফিজম রূপ প্রকাশ করে। ধারনা করা হয়, প্রাণীর দেহ থেকে এই ভাইরাস প্রথম মানবদেহে প্রবেশ করে।
করোনাভাইরাসের অনেক রকম প্রজাতি আছে, কিন্তু এর মধ্যে মাত্র ৭টি মানুষের দেহে সংক্রমিত হতে পারে। করোনাভাইরাসের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, এই ভাইরাসটি ৬০-এর দশকে প্রথম আবিষ্কৃত হয়। প্রথমদিকে মুরগির মধ্যে সংক্রামক ব্রঙ্কাইটিস ভাইরাস হিসেবে এটি প্রথম দেখা যায়। পরে সাধারণ সর্দি-হাঁচি-কাশিতে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে এরকম দুই ধরনের ভাইরাস পাওয়া যায়। মানুষের মধ্যে পাওয়া ভাইরাস দুটি ‘মনুষ্য করোনাভাইরাস ২২৯ই’ এবং ‘মনুষ্য করোনাভাইরাস ওসি৪৩’ নামে নামকরণ করা হয়। এরপর থেকে বিভিন্ন সময় ভাইরাসটির আরো বেশ কিছু প্রজাতি পাওয়া যায় যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ২০০৩ সালে ‘এসএআরএস-সিওভি’, ২০০৪ সালে ‘এইচসিওভি এনএল৬৩’, ২০০৫ সালে ‘এইচকেইউ১’, ২০১২ সালে ‘এমইআরএস-সিওভি’ এবং সর্বশেষ ২০১৯ সাল চীনে এসএআরএস-সিওভি-২’ পাওয়া যায়। যা বর্তমানে নোভেল করোনাভাইরাস নামেই পরিচিত। এগুলোর মধ্যে অধিকাংশের সংক্রমণের ফলে শ্বাসকষ্টের গুরুতর সংক্রমণ দেখা দেয়।
অন্যভাবে ব্যাখ্যা করলে বলতে হয়, করোনাভাইরাস এমন একটি সংক্রমক ভাইরাস যা আগে কখনো মানুষের মধ্যে ছড়ায়নি। ভাইরাসটির আরেক নাম ২০১৯-এনসিওভি। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ভাইরাসটি হয়তো মানুষের দেহকোষের ভেতরে ইতোমধ্যেই ‘মিউটেট করছে’ অর্থাৎ গঠন পরিবর্তন করে নতুন রূপ নিচ্ছে এবং সংখ্যাবৃদ্ধি করছে। যার ফলে এটি আরো বেশি বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।
করোনাভাইরাসটি অত্যন্ত দ্রুত ছড়াতে পারে এবং বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত করেছেন যে এ ভাইরাস একজন মানুষের দেহ থেকে আরেকজন মানুষের দেহে ছড়াতে পারে।
এই ভাইরাস মানুষের ফুসফুসে সংক্রমণ ঘটায় এবং শ্বাসতন্ত্রের মাধ্যমেই এটি একজনের দেহ থেকে আরেক জনের দেহে ছড়ায়। সাধারণ ফ্লু বা ঠান্ডা লাগার মতো করেই এ ভাইরাস ছড়ায় হাঁচি-কাঁশির মাধ্যমে। এক দশক আগে সার্স (পুরো নাম সিভিয়ার এ্যাকিউট রেস্পিরেটরি সিনড্রোম) নামে যে ভাইরাসের সংক্রমণে পৃথিবীতে ৮০০ লোকের মৃত্যু হয়েছিল সেটিও ছিল এক ধরণের করোনাভাইরাস। এতে আক্রান্ত হয়েছিল ৮ হাজারের বেশি মানুষ। আর একটি ভাইরাসজনিত রোগ ছিল মিডলইস্টার্ন রেস্পিরেটরি সিনড্রোম বা মার্স। ২০১২ সালে এতে মৃত্যু হয় ৮৫৮ জনের।
করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রধান লক্ষণ হলো, শ্বাসকষ্ট, জ্বর এবং কাশি। কিন্তু এর পরিণামে অরগ্যান ফেইলিওর বা দেহের বিভিন্ন প্রত্যঙ্গ বিকল হয়ে যাওয়া, নিউমোনিয়া এবং এমনকি মৃত্যু ঘটতে পারে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ভাইরাসটি শরীরে ঢোকার পর সংক্রমণের লক্ষণ দেখা দিতে প্রায় পাঁচ দিন লাগে। প্রথম লক্ষণ হচ্ছে জ্বর। তার পর দেখা দেয় শুকনো কাশি। এক সপ্তাহের মধ্যে দেখা দেয় শ্বাসকষ্ট এবং তখন কোন কোন রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। মারাত্মক অসুস্থতা এবং মৃত্যুর দিকে তাকালেই দেখা যায় এই ভাইরাস কতটা বিপজ্জনক। আর এটা ঠিক কতটা ভয়ংকর তা সারা পৃথিবীর সংক্রমণ শেষ না হওয়া পর্যন্ত স্পষ্ট নয়।
করোনাভাইরাস থেকে সর্তক থাকতে কিছু পরামর্শ দিয়ে ডা. জহুরুল হক সাগর আরো বলেন, পৃথিবীতে কোনো ধর্মই অবাধ যৌনাচারসহ অযাচিত জীবন-যাপনকে সমর্থন করে না। ধর্মীয় অনুশাসন ও শৃংখলিত জীবন-যাপনই প্রত্যেক ধর্মের মূলমন্ত্র। করোনাভাইরাস থেকে বাঁচতে সকল প্রকার পাপ কর্ম থেকে মুক্ত হয়ে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা অত্যন্ত জরুরি। নিয়মিত ধর্মীয় বিধান মেনে চলা ও সচেতনতাই পারে করোনাভাইরাস থেকে নিজেকে রক্ষা করতে।
করোনাভাইরাস থেকে বাঁচার মূলমন্ত্র হচ্ছে নিজস্ব সুরক্ষা, পরিচ্ছন্নতা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা। অথচ সমাজতত্ত¡বিদরা প্রশ্ন তুলছেন এ সামাজিক দূরত্ব মানে সমাজের একজন মানুষ থেকে আরেকজন মানুষের দূরত্ব। শব্দটি প্রায়োগিক অর্থে হওয়া উচিত নিরাপদ দূরত্ব কিংবা ফিজিক্যাল ডিস্টেন্স বা শারীরিক দূরত্ব।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে হয়তো সচেতনতার অভাবে এমনটা মনে হতে পারে যে সামাজিক দূরত্বের জন্য একটা মানসিক দূরত্বও তৈরি হচ্ছে। সেক্ষেত্রে যিনি বিষয়টি নিয়ে সচেতন, তাঁকে অপর জনকে সচেতন করতে হবে। তাকে ভালোভাবে বোঝাতে হবে যে এটা আমাদের বাঁচার লড়াই। এটি সামাজিক দূরত্ব নয়, সাময়িক সময়ের জন্য আমাদের নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার এবং অন্যকে বাঁচানোর লড়াই। এখন মুদিখানা বা ওষুধের দোকান যেখানেই যান না কেন, দূরত্ব বজায় রেখে কেনাকাটা করতে হবে। কার শরীরে এই রোগ-জীবাণু ছড়িয়ে আছে তা চোখে দেখে বোঝা অসম্ভব। তাই নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখলে আমরা বাঁচতে পারব।
সামাজিক দূরত্বের আসল প্রয়োগ বাড়ির বাইরে, যেখানে আমি নিজে সংক্রমিত হতে পারি, আবার অন্য কাউকে সংক্রমিত করতেও পারি। তাই সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করা মানে অপ্রয়োজনে এমন কোথাও না যাওয়া যেখানে আরো মানুষজন আছেন। মানে, একসঙ্গে আড্ডা নয়, খেলাধুলা নয়, প্রার্থনা সভা নয়, কোচিং ক্লাস নয়, এমনি অনেক কিছু। আপনি যদি এসবে না যান তবে পাড়ার মুদির দোকানে ভিড় না করে দূরে দাঁড়িয়ে লেনদেন করতে কিংবা কুশল বিনিময় করতে কোনো সমস্যা নেই। বাড়ি থেকে ফোন করে যা যা দরকার জানিয়ে সেটা চুপচাপ নিয়ে আসা। অর্থাৎ নিজের নিরাপদ দূরত্ব রক্ষা করে সবকিছু মেইন্টেইন করা যাচ্ছে। আর এতে সংক্রমণের আশঙ্কাও কম। তাই বলা চলে মূলত সামাজিক দূরত্ব নয়, নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখলে চলে।
দেশের বিশাল সংখ্যক জনগোষ্ঠীকে সেবা দেওয়ার সামর্থ্য সরকারের থাকা উচিত। এমনকি নিম্নআয়ের দেশগুলোতে জনগণের সুস্থতার ব্যাপারে সরকারের আরো গভীরভাবে ভাবা উচিত। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গেলে নিজে থেকে খরচ বহনের মতো আগাম প্রস্তুতিও নেয়া দরকার।
প্রতিষ্ঠানের উচিত কর্মী অসুস্থ হলে তাকে ছুটি দিয়ে দেয়া। এই সময়ের পারিশ্রমিকও দেয়া উচিত। কোনোভাবেই এই দুর্দিনে বিনা বেতনে ছুটি দেয়া উচিত হবে না। সরকারিভাবে মাস্ক থেকে শুরু করে অন্যান্য সুরক্ষা সামগ্রী উৎপাদনের পথে হাঁটা যেতে পারে। এসব উৎপাদনে ভর্তুকিও দেয়া যেতে পারে। হাসপাতালগুলোতে সুরক্ষা সামগ্রী যথেষ্ট পরিমাণে রাখতে হবে। ব্যক্তি উদ্যোগেও সচেতন হতে হবে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকার পাশাপাশি খেয়াল রাখা দরকার, যেন অন্যের দ্বারা আক্রান্ত না হয়ে যান।
প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে শিক্ষার্থীদের কেবল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই অ্যাকাডেমিক পড়াশোনার ব্যবস্থা থাকে। এই সময়ে ঘরে বসে তারা যেন শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারে, তার ব্যবস্থা রাখা দরকার। তাদেরকে শিক্ষার সামগ্রী সরবরাহ করা উচিত। তারা যেন পড়াশোনার গতি থেকে হুট করেই থমকে না যায়, সেটাও দেখা দরকার।
সর্বোপরি নিজে সচেতন থাকতে হবে। কারো সঙ্গে হাত মেলানো, কোলাকুলিসহ সকল প্রকার সামাজিক মেলামেশা থেকে বিরত থাকা দরকার। অহেতুক মুখমন্ডল স্পর্শ না করাই ভালো। হাঁচি-কাশিতে জীবাণু থাকে। সাবান কিংবা হ্যান্ডওয়াশ ব্যবহার করতে হবে।
সর্বশেষ : সৃষ্টিকর্তার ওপর সম্পূর্ণ আস্তা ও বিশ্বাস রেখে তাঁর আদেশ-নিষেধ মেনে চলতে হবে। পাশপাশি সময়ে সময়ে সরকারের বেধে দেয়া নিয়মগুলি সুচারুভাবে মেনে চলতে হবে। আমাদের উচিত এখনই খাস তওবা করে সকল পাপ কাজ থেকে নিজেকে মুক্ত করা। পাশাপশি স্রস্টার সকল আদেশ নিষেধ মেনে চলা। করোনা আপনার বিবেকের ভাবনার একটি দিগন্ত।
শাহ সুফি সৈয়দ আবদুল হান্নান আল হাদী
চেয়ারম্যান, ইসলামিক বুদ্ধিজীবী ফ্রন্ট
৭৩/১, এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা ১২০৫।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন