মুস্তাক মুহাম্মদ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১ - ১৯৪১) বাংলা সাহিত্যের পুরোধা ব্যক্তিত্ব। যিনি বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বদরবারে উচ্চাসনে আসীন করেছেন। সাহিত্যের সব শাখায় তিনি স্বচ্ছভাবে পদচারণা করেছেন শুধুমাত্র মহাকাব্য ছাড়া। প্রত্যেক প্রাণীর মৃত্যু আছে। জন্মগ্রহণ করলে তাকে অবশ্যই মৃত্যুবরণ করতে হবে। মৃত্যু সবচেয়ে সত্য। মৃত্যু চিন্তা থাকলে মানুষ অন্যায় কাজ করতে পারে না। কিন্তু আমরা অধিকাংশ সেটা বেমালুম ভুলে যাই। যতদিন আমাদের যৌবন আছে ততদিন মৃত্যুকে পাশ কাটিয়ে চলতে চাই আমরা। মৃত্যুর কথা তেমন মনে করতে চাই না। অথবা আমরা মনে করলে আমলে নিই না। কিন্তু যখন বয়েস হয়ে যায়, মাথার চুল কালো থেকে সাদা রঙ ধারণ করে, গায়ের বল কম হয়ে যায়, শরীর আর আগের মত চলে না তখন আমাদের মৃত্যু চিন্তা বেশি আসে। তার আগেও আসে কিন্তু আমরা তা তেমন আমলে নিই না। কমবেশি সকলেই জীবনে অসংখ্যবার মৃত্যুকে নিয়ে ভাবি। কবিতার শৈল্পিক আবরণে বিশ্বকবি আমাদের রবি, কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মৃত্যু কথা প্রকাশ করে অসংখ্য কবিতা লিখেছেন। পৃথিবীতে সবচেয়ে কঠিন সবচেয়ে সত্য মৃত্যু। তিনি এই জন্য বলতে পেরেছিলেন - সত্য যে কঠিন কঠিনেরে ভালবাসিলাম, সে কখনো করে না বঞ্চনা। হ্যাঁ তিনি জেনেই অমোঘ সত্যকে ভালবেসেছিলেন। এই জন্য সুস্পষ্টভাবে তা স্বীকার করেছেন। তবু আশাবাদী মানুষ আশা রাখে, বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করে। তবে মৃত্যুকে অবহেলা করে নই। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেই আমরা এগিয়ে চলি। এটাই আমাদের ধর্ম। আজ আমরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতায় মৃত্যু চিন্তা কিভাবে উঠে এসেছে তা প্রত্যক্ষ করার চেষ্টা করব।
মৃত্যু সত্য। তাই বলে মৃত্যুকে নিয়ে বেশি ভাবলে বেঁচে থেকেও মৃত্যুর মত থাকতে হয়। তখন মৃত্যু এমনি আসে। গ্রাস করে। আমরা যখন দেখি চুল-দাড়ি পেকে সাদা রঙ ধারণ করেছে তখন আমাদের হুশ হয় Ñ বয়েস হয়েছে। আর হয়তো বেশি দিন বাকি নেই। পরপারে যাওয়ার সময় এসেছে। আমাদের বাংলাদেশে বর্তমান গড় আয়ু সাতষট্টি বছর। সেখানে যাট পার হলেই আমরা ধরে নিই আমাদের সময় শেষ হয়ে এসেছে। কিন্তু মানুষ আরও অনেক দিন বাঁচতে পারে। আর এই বয়েসে একবার মৃত্যু চিন্তা চলে আসলে সে ভয়ে অনেকে ডাক্তার-কবিরাজ করতে থাকে। কারণ তারা মৃত্যুবরণ করতে চায় না। সুন্দর মায়াময় পৃথিবীতে থাকতে চায়। তবু বেশি দুশ্চিন্তা মৃত্যু দিকে ঠেলে দিতে পারে। বাঁচার জন্য বিভিন্ন পথ্য খেতে শুরু করে। কিন্তু মৃত্যু যখন হবে কোনো পথ্যই কাজ হয় না। ‘আয়না দেখেই চমকে বলে’ কবিতার পঙ্ক্তিতে কবিগুরু মৃত্যুভাবনাকে পরিহাস করে লিখেছেন - “আয়না দেখেই চমকে বলে, / ‘মুখ যে দেখি ফ্যাকাশে, / বেশিদিন আর বাঁচব না তো - ’ / ভাবছে বসে একা সে।/ ডাক্তারেরা লুটল কড়ি, / খাওয়ায় জোলাপ, খাওয়ায় বড়ি, / অবশেষে বাঁচল না সেই / বয়স যখন একাশি। ”
হ্যাঁ, গুরুকবি ভেবেই রেখেছেন আশি পার হওয়া একজন মানুষের জীবন শুধু মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করে সময় ক্ষেপণ ছাড়া আর কিছুই না। তিনি নিজেও আশিতে গত হয়েছেন। কি সুদূরপ্রসারী চিন্তা না তিনি করেছিলে ! মৃত্যু এমন যে সবাইকে গ্রহণ করতে হবে। রাজা-বাদসা, অত্যাচারী-মজলুম, ক্ষমতাবান, পরাক্রমশালী বীর্যবান, নাস্তিক-আস্তিক সব প্রাণীকে তা গ্রহণ করতে হবেই। আর মৃত্যুর পর কোনো জাত-বর্ণ পরিচয় থাকে না। তখন সবার সাধারণ একটি মাত্র পরিচয় লাশ। সেখনে কোনো জাতি ভেদ থাকে না। শাসক-শাসিত থাকে না। ছোট-বড়, ছোঁয়াচে-আছোঁয়াচে থাকে না। যমদূত এই সব কিছুই মানে না। সে সকল দম্ভ-অহংকার চূর্ণ-বিচূর্ণ করে মাটির বুকে শুয়ে দেয়। অথবা চিতার আগুনে ভস্ম করে দেয়। তখন কারোর কোনো পরিচয় থাকবে না। তাই সময় থাকতে সবার সাথে মিশে চলতে হবে। পৃথিবীকে সুন্দর করার চেষ্টা করতে হবে। মানুষের কোনো ক্ষমতা নেই মৃত্যুকে রোধ করার। সুতরাং পৃথিবীতে একমাত্র মৃত্যুই সাম্য প্রতিষ্ঠা করে। এ ক্ষেত্রে কবিগুরুর ‘দুর্ভাগা দেশ’ শিরোনামের কবিতায় কয়েকটি চরণ প্রণিধানযোগ্য। তিনি লিখেছেন- ‘দেখিতে পাও না তুমি মৃত্যুদূত দাঁড়ায়ে দ্বারে - / অভিশাপ আঁকি দিল তোমার জাতির অহংকার। / সবারে না যদি ডাকো, / এখনো সরিয়া থাকো, / আপনারে বেঁধে রাখো চৌদিকে জড়ায়ে অভিমানে - / মৃত্যু - মাঝে হবে তবে চিতাভস্মে সবার সমান।’
কেউ পারে না চিরকাল বেঁচে থাকতে। তার কর্ম বেঁচে থাকে। তাহলে কিসের বড়াই আমাদের। পূজা-অর্চনা-মানত কিছুই মৃত্যুদূতের কাছে কিছুই না। সময় আসলে শত পূজা দেবতারে দিলেও মৃত্যু রোধ করা যায় না। দেবতাদের সে ক্ষেত্রে কিছু করার থাকে না। কোনো নৈবেদ্য নিয়ে দেবতা খুশি হয় না। মায়ের ভালবাসা পৃথিবীতে অদ্বিতীয়। সন্তানের জন্য মা-জননী সব করতে পারে। সেই মাও শত চেষ্টা করে যমদূতকে রুখতে পারে না। যমদূতের জয় হয় সব ক্ষেত্রে। সেখানে কোনো চেষ্টা শক্তি ক্ষমতা তার পথরোধ করে তাকে নিবৃত্ত করতে পারে না। কোনো দেবতারও সে শক্তি নেই। মৃত্যুদূতকে খুশি করে আজীবন বেঁচে থাকা কারোর পক্ষে সম্ভব নয়। ‘বিসর্জন’ শিরোনামের কবিতায় মাতৃচেষ্টা ব্যর্থ করে যমদূত কেড়ে নিয়ে যায় সন্তানের প্রাণ। যাকে আশ্রয় করে বেঁচে থাকতে চেয়েছিল মা। দেবীর পূজা দিতেও কোনোরূপ কার্পণ্য করেননি তিনি। শেষে দেবীর হাতে তুলে দেছে একমাত্র সন্তানকে তবু শেষ রক্ষা হয়নি। তার আত্মসমর্পণ তাকে কিছু ফিরিয়ে দিতে পারেনি। চাঁদ সওদাগর মনসা দেবীরে পূজা দেয়নি বলে তার ছেলেকে সাপে কেটে ছিল। মৃত্যুও বরণ করে ছিল। কিন্তু স্ত্রী বেহুলা স্বর্গে দেবতাদের খুশি করে স্বামীরে ফিরিয়ে আনে। চাঁদ সওদাগর পরাজয় বরণ করেনি। মৃত্যুকে ভয় পায়নি। দেবতা বা দেবীর কাছে পরাজয় বরণ করেননি। বিসর্জন দেননি সন্তানকে। যেখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিসর্জন দিয়েছেন সন্তানকে। দেবীকে বিশ্বাস করেছেন। কিন্তু দেবী তার বিশ্বাসের সামান্য মূল্য দেয়নি। সন্তানকে কেড়ে নিয়েছেন। ‘বির্সজন’ কবিতার কয়েক ছত্র উল্লেখ করছিÑ “একমাত্র ধন মোর দিনু তোর পায়ে / এক Ñ মনে। এত বলি সমর্পিল জলে / অচেতন শিশুটিরে লয়ে করতলে? চক্ষু মুদি। বহুক্ষণ আঁখি মেলির না; / ধ্যানে নিরখিল বসি মকরবাহনা / জ্যোতির্ময়ী মাতৃমূর্তি ক্ষুদ্র শিশুটিরে / কোলে ক’রে এসেছেন, রাখি তার শিরে / একটি পদ্মের দল; হাসিমুখে ছেলে / অনিন্দিত কান্তি ধরি দেবী Ñ কোল ফেলে / মার কোলে আসিবারে বাড়ায়েছে কর।/ কহে দেবী, ‘ও দুঃখিনী, এই তুই র্ধ / তোর ধন তোরে দিনু।’ রোমাঞ্চিকতায় / নয়ন মেলিয়া কহে, ‘কই মা !... কোথায় !’ / পরিপূর্ণ চন্দ্রালোকে বিহ্বলা রজনী; / গঙ্গা বহি চলি যায় করি কলধ্বনি।/ চীৎকারী উঠিল নারী, ‘দিবি নে ফিরায়ে?’ / মর্মরিল বনভূমি দক্ষিণের বায়ে।” (কাহিনী)
শেষ পর্যন্ত মৃত্যুদূতের কাছে দেবীর পরাজয় বরণ করতে হয়েছে। এখানে ‘জন্মিলে মরিতে হবে / অমর কে কোথায় কবে’ এই চিরন্তন বাক্যটি সত্য প্রমাণিত হয়েছে। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও আমরা কর্মের মাধ্যমে বেঁচে থাকতে পারি। দেহের মরণ আছে কিন্তু আত্মার মরণ নেই। তাই মরার আগে মানুষের উচিত যত পারা যায় শুভ কর্ম করে যাওয়া। আর যারা শুভ কর্ম করে যেতে পারে তারা সফল। কবিগুরু তাই যত পেরেছেন পৃথিবীকে দেওয়ার তা দিয়ে মিনতি করেছেন কঠিন পৃথিবীর কাছে। আমাকে ভুলে যাও কিন্তু তার আগে আমার নৈবেদ্য গ্রহণ কর। তোমার কাছে আমার আর চাওয়ার কিছুই নেই। আমাদের জীবনকে মানব কল্যাণে ব্যয় করা উচিত। কবিগুরু যা করেছেন। সত্যি! পৃথিবী বিশ্বকবি - আমাদের রবির চাওয়া পূরণ করেছেন। এই জন্য এখনো তিনি আমাদের মাঝে প্রাসঙ্গিক Ñ বেচেঁ আছেন। তাঁর ‘পৃথিবী’ নামক কবিতার শেষ চার পঙ্ক্তি এক্ষেত্রে যোজন করছি - ‘হে উদাসীন পৃথিবী, / আমাকে সম্পূর্ণ ভোলবার আগে / তোমার নির্মম পদপ্রান্তে / আজ রেখে যাই আমার প্রণতি।’
মৃত্যু সত্য। এই অখ-নীয় সত্যকে কবিগুরু খুব সহজে স্বীকার করে নিয়েছেন। তিনি বিদ্রোহ করেনি। তবে তিনি সব কিছুর নশ্বরতার মধ্যে অবিনশ্বর হওয়ার পথও বাতলে দিয়েছেন। সুকীর্তি মানুষকে অবিনশ্বরতা দান করে। আমাদেরকে সুকর্ম করে পৃথিবীকে সুন্দর করতে হবে। তাহলে দেহের মৃত্যু হলেও মহৎ কর্মের মাধ্যমে আমরা মানবের মাঝে থাকতে পারব। সত্য মৃত্যুকে মেনে নিয়েই আমাদেরকে এগিয়ে যেতে হবে। মৃত্যুই আমাদেরকে পেছন থেকে তাড়িত করবে, আর বলবে Ñ সময় কম কাজ বেশি, যত পারো ছোটো বেশি। তাহলে মানব জীবন সার্থক হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন