দীর্ঘস্থায়ী ভয়াবহ বন্যায় ভেঙে পড়েছে দেশের ২৯ জেলার ১৩৫ উপজেলার যোগাযোগ ব্যবস্থা। পানির চাপে ধসে গেছে সড়ক-মহাসড়ক ও অনেক এলাকার গ্রামীণ সড়ক। সেতু-কালভার্টের সংযোগ সড়ক ধসে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে জেলা-উপজেলা-ইউনিয়ন। দীর্ঘদিন পানির নিচে থাকায় উঠে গেছে সড়কের বিটুমিন। এসব ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক মহাসড়ক ও গ্রামীণ সড়ক সংস্কারে উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। মানুষের দুর্ভোগ লাঘবে তাৎক্ষণিক সড়ক সংস্কারের উদ্যোগে এগিয়ে আছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। এলজিইডি সূত্র জানায়, ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামীণ সড়ক পরিদর্শনে দুটি টিম গত ১৪ দিনে ৪৪টি জেলা পরিদর্শন করেছে। পরিদর্শন শেষে তাৎক্ষণিকভাবে মধ্যম বা অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতিগ্রস্ত সড়কের সংস্কার কাজের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। আগামী ৬ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সবগুলো জেলা পরিদর্শনের কাজ শেষ হবে। সেই সাথে সড়ক সংস্কারের কাজেরও অনুমোদন দেয়া হবে।
এ প্রসঙ্গে এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী মো. আব্দুর রশীদ খান ইনকিলাবকে বলেন, বন্যায় সারাদেশেই এলজিইডির সড়কের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি যোগাযোগ ব্যবস্থা অবিরত রাখতে, যাতে মানুষের দুর্ভোগ না হয়। এজন্য তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিশেষ টিম গঠন করা হয়েছে। টিমগুলো মাঠে কাজ করছে। তিনি বলেন, মাননীয় স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সার্বক্ষণিকভাবে মনিটরিং করে যাচ্ছেন। তিনিসহ মন্ত্রণালয়ের অন্যান্য উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের তত্ত্বাবধানে সহকর্মী হিসাবে আমরা মানুষের দুর্ভোগ লাঘবে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছি।
অন্যদিকে, প্রথম দফা বন্যায় ২৮৮ কিলোমিটার আঞ্চলিক মহাসড়ক ও জেলা সড়ক ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফায় কি পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে সে হিসাব এখনও পাওয়া যায়নি। সড়ক ও জনপথ সংশ্লিষ্টদের ধারনা, ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক মহাসড়কের পরিমান ৬শ’ কিলোমিটার ছাড়িয়ে যেতে পারে। সংশ্লিষ্টরা জানান, বন্যায় কোথাও সড়ক তলিয়ে গেছে গভীর পানির নিচে। কোথাওবা ভেসে গেছে বানের তোড়ে। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পরেও কোনো কোনো সড়কে এখনও যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। সবচেয়ে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে জামালপুর ও সুনামগঞ্জে। দেশের ২২টি জাতীয় মহাসড়কের প্রধান ছয়টির কোনো অংশ না ডুবলেও, রাস্তা পাশে বন্যার পানি দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ায় সেগুলো হুমকির মুখে পড়েছিল। এসব সড়ক মহাসড়ক মেরামতে এখনও কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। কিছু কিছু ক্ষতিগ্রস্ত জেলা সড়ক ও ব্রিজ-কালভার্ট সাময়িক মেরামত করা হলেও এখনও বহু স্থানে যান চলাচলের জন্য বিকল্প সড়ক ব্যবহার করা হচ্ছে।
এদিকে, বর্ষায় ক্ষতিগ্রস্ত মহাসড়ক মেরামতের ক্ষেত্রেও সওজের উদাসীনতা লক্ষ্য করা গেছে। বর্ষার আগে থেকেই ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের খানাখন্দ দেখা গেলেও মেরামতের নামে মহাসড়কে বড় বড় পাথর ফেলে রাখা হয়েছে মাস খানেক ধরে। যাত্রাবাড়ীর কুতুবখালী থেকে শনিরআখড়া হয়ে রায়েরবাগ পর্যন্ত মহাসড়কে চলতে গিয়ে দুর্ভোগ পোহাচ্ছে মানুষ। বড় বড় পাথরের উপর দিয়ে চলতে গিয়ে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) তথ্য বলছে, চলমান বন্যা ও তার আগে আম্পানের কারণে সংস্থাটির অধীন প্রায় ১১ হাজার ১৭৮ কিলোমিটার সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একই সঙ্গে ১৬ হাজার ৫০০ মিটার সেতু ও কালভার্ট ভেঙে গেছে। এতে ৪ হাজার ৫৫ কোটি টাকা সরকারের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
চলমান বন্যাকবলিত ৩৩ জেলার মধ্যে এলজিইডির প্রধান কার্যালয় থেকে ২৭ জেলার ক্ষয়ক্ষতির তথ্য পাওয়া গেছে। দীর্ঘতম এ বন্যায় নয় হাজার কিলোমিটার সড়কসহ ১৫ হাজার মিটার সেতু ও কালভার্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যার আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ২ হাজার ৬৩০ কোটি টাকা। তবে বিভিন্ন জেলায় সড়ক থেকে এখনো বন্যার পানি না নামার কারণে আর্থিক ক্ষতির প্রকৃত পরিমাণ নির্ধারণে আরো অপেক্ষা করতে হবে বলে এলজিইডির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
এলজিইডির সূত্র জানায়, সারাদেশে এলজিআরডির আওতায় পাকা সড়ক রয়েছে ১ লাখ ২৫ হাজার কিলোমিটার। বন্যা ও আম্পানে অধিকাংশ সড়ক কোনো না কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গত বছর সড়ক উন্নয়ন ও মেরামতের কাজে ১ হাজার ৯০০ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকলেও সরকার থেকে ১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা প্রদান করা হয়। এরই মধ্যে বরাদ্দকৃত টাকার কাজ শেষ করা হয়েছে। তবে ক্ষতিগ্রস্ত সড়কগুলো দ্রুত মেরামত করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এলজিইডির সড়ক ও সেতু রক্ষণাবেক্ষণ শাখার নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুর রহিম জানান, মধ্যম ক্ষতি ও সামান্য ক্ষতিগ্রস্ত সড়কের সংস্কার কাজ শুরু হয়েছে। এজন্য এলজিইডির প্রধান কার্যালয় থেকে দুটি বিশেষ টিম গঠন করা হয়েছে। টিমগুলো মাঠে কাজ করছে। তারা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করে তাৎক্ষণিক সংস্কারের অনুমোদন দিচ্ছেন। গতকাল পর্যন্ত ৪৪টি জেলা পরিদর্শনের কাজ শেষ হয়েছে। আগামী ৬ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সব জেলা পরিদর্শন শেষ হবে বলে জানান তিনি।
এলজিইডি সূত্র জানায়, সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক সংস্কারের নতুন করে একটি প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। ওই প্রকল্পের মাধ্যমে ৫ হাজার ৪২৮ কিলোমিটার সড়ক সংস্কার ও পুননির্মাণ করা হবে।
অন্যদিকে, সওজ সূত্র জানায়, প্রথম দফা বন্যায় ২৮৮ কিলোমিটার আঞ্চলিক মহাসড়ক ও জেলা সড়ক ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফায় কি পরিমান ক্ষতি হয়েছে তা নিরুপন করতে কাজ করছে সওজ।
সওজ সূত্র জানায়, ৩ দফা বন্যার পানিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে সুনামগঞ্জ জেলায়। সুনামগঞ্জ-ছাতক সড়কের তিনটি পয়েন্ট ভেঙে বিলীন হয়ে গেছে। এতে জেলা শহরের সঙ্গে দোয়ারাবাজার উপজেলার সরাসরি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ওই সড়ক দিয়ে সরাসরি ছাতক উপজেলার লোকজনও যাতায়াত করতে। কিন্তু ওই সড়কটি ভেঙে যাওয়ায় ছাতক উপজেলার মানুষ সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়ক পার হয়ে জেলা শহরের প্রবেশ করতে হয়। বন্যার পানি নেমে গেলেও এখনও শুরু হয়নি সড়কের সংস্কার কাজ। সড়ক মেরামতের কাজ শুরু না হওয়ায় হতাশ দোয়ারাবাজার উপজেলার লোকজন। তবে সড়ক ও জনপথ বিভাগ জানিয়েছে, শুষ্ক মৌসুমের আগে সড়কটি পুরোপুরি মেরামত করা সম্ভব নয়। এমনিভাবে দেশের অনেক এলাকার সড়ক চলাচলের অযোগ্য হলেও সেগুলো তাৎক্ষণিকভাবে সংস্কারের কোনো উদ্যোগ নেয়নি সওজ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন