ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন যখন পাস হয় (২০১৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর) তখন সম্পাদক পরিষদসহ সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন এবং মানবাধিকার সংস্থার তরফে এই মর্মে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয় যে, এই আইনের এমন কিছু ধারা আছে, যা বাকস্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও গণমাধ্যমের জন্য হুমকিস্বরূপ। সংবিধানের সঙ্গেও কিছু ধারা সাংঘর্ষিক। এ আইনের অপব্যবহারের আশঙ্কা ব্যক্ত করা হয় এবং ২৫ ও ২৯ সহ চিহ্নিত ধারাগুলো সংশোধনের দাবি জানানো হয়। সে সময় সরকারের পক্ষ থেকে আশ্বস্থ করা হয়, আইনের কোনো অপব্যবহার হবে না। কিন্তু বাস্তবে এ আশ্বাসের কোনো কার্যকারিতা লক্ষ্য করা যায়নি। এই আইনে যথেচ্ছ মামলা দায়ের হয়েছে, যার অধিকাংশই হয়রানিমূলক বলে অভিহিত। দু’বছরে মামলার সংখ্যা এক হাজার ছাড়িয়েছে। মামলাগুলোর বেশিরভাগই হয়েছে আইনটির ২৫ ও ২৯ ধারায়। স্মরণযোগ্য, আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫ ও ২৯ ধারা আসলে একই। রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ণ ও মানহানির অভিযোগে এ দু’ধারায় মামলা দায়ের করা হয়। মামলা দায়ের করার অধিকার প্রত্যেক সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিরই আছে। এ ব্যাপারে প্রশ্নের অবকাশ নেই। কিন্তু দেখা গেছে, সংক্ষুব্ধ নয় বা সংক্ষুব্ধ হওয়ার সুযোগ নেই, এমন ব্যক্তিও অন্যের পক্ষে মামলা করেছে। কখনো কখনো পুলিশ মামলার বাদী হয়েছে। কাউকে তোষন কিংবা, কারো অনুকম্পা পাওয়ার আশায় ‘মানহানি’, ‘গুজব রটনা’ বা অন্য কোনো অভিযোগে একজনের পক্ষে অন্যজনের মামলা দায়ের কতটা ন্যায়োচিত ও যৌক্তিক, সেটা অবশ্যই প্রশ্নসাপেক্ষ ব্যাপার। পর্যবেক্ষকদের মতে, অনেক ক্ষেত্রে শুধুমাত্র হয়রানির উদ্দেশ্যেই মামলা দায়ের করা হয়। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়েছে, আইসিটি আইন ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়েরকৃত মামলার বেশিরভাগেরই অভিযোগ প্রমাণিত হচ্ছে না।
আইসিটি আইন ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এ যাবৎ যত মামলা হয়েছে, তার একটা উল্লেখযোগ্য অংশই হলো সংবাদপত্র বা সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে। এমনিতেই সংবাদপত্রগুলোর আর্থিক অবস্থা অত্যন্ত নাজুক; করোনাকালে সেটা আরো শোচনীয় অবস্থায় এসে উপনীত হয়েছে। সংবাদপত্র যে সব সময় সব কথা বলতে পারে, এমনও নয়। নানাদিক থেকে সংবাদপত্রের ওপরে খড়গ ঝুলে আছে। জনগণের কথা, জনগণের জানতে চাওয়ার কথা অনেক সময়ই সংবাদপত্র বলতে বা প্রকাশ করতে পারে না। বাধ্য হয়ে সাংবাদিকদের সেল্ফশিপের আশ্রয় নিতে হয়। এর ওপর যদি সর্বক্ষণ আইসিটি আইন বা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো নিবর্তন মূলক আইন সক্রিয় থাকে এবং তার লাগাতার অপব্যবহার হয় তবে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকরা যাবে কোথায়? টিআইবি’র হিসাবে জানা যায়, ২০১৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১৮০ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। অন্য এক তথ্যে জানা যায়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কার্যকর হওয়ার পর থেকে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ৫০টি মামলা হয়েছে। ওইসব মামলায় ৩৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সম্পাদক পরিষদ এক বিবৃতিতে বলেছে, জুন পর্যন্ত ৪০ জন সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, যাতে গ্রেফতার করা হয়েছে ৩৭ জনকে। সাংবাদিকরা, বলার অপেক্ষা রাখে না, আইনের ঊর্ধ্বে নয়। তারাও অন্যায়-অপরাধ করলে তার শাস্তি তাদের পেতে হবে। কিন্তু যখন তথাকথিত মানহানির নামে বা অন্য কোনো অভিযোগ কেবলই হয়রানির জন্য মামলা করা হয় তখন, এ আইনের অপব্যবহার নিয়ে কথা না বলে পারা যায় না। ডিজিটাল নিরাপত্তার জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। ডিজিটাল মাধ্যমে কারো বিরুদ্ধে অপকথা বলা, মিথ্যাচার করা, অপপ্রচার চালানো, তার সম্মান ও মর্যাদাহানি করা কিংবা ব্ল্যাকমেইল করা নিঃসন্দেহে গর্হিত অপরাধ। এসবের যথোচিত শাস্তি হোক, সবাই সেটা চায়। তবে নিতান্তই হয়রানির উদ্দেশ্যে কারো বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ আনা হবে, তা কারো কাম্য হতে পারে না।
মামলা হতে হবে উপযুক্ত প্রতিকার ও সুবিচার পাওয়ার জন্য, কারো হয়রানির উদ্দেশ্যে নয়। কিন্তু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এই হয়রানির সুযোগ রয়েছে। সরকারের সমালোচনা ও ব্যক্তির ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ণ করার অভিযোগে এন্তার মামলা হচ্ছে। অভিযোগ তদন্ত করে খতিয়ে দেখা পর্যন্ত হচ্ছে না। অধিকাংশ মামলা করছে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী ও ক্ষেত্র বিশেষে পুলিশ। সঙ্গে সঙ্গে গ্রেফতার ও রিমান্ডও হচ্ছে। আইনে পরোয়ানা ছাড়াই পুলিশকে গ্রেফতারের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। আইনের ১৪টি ধারা অজামিনযোগ্য। এ সুযোগটিও পূর্ণভাবে কাজে লাগনো হচ্ছে। উল্লেখ করা যেতে পারে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৩, ২৮, ২৯ ও ৩২ ধারা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে দায়ের করা একটা রিট আবেদন নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে। আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, ধারাগুলো বাতিল হলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের করা প্রায় সব মামলাই বাতিল হয়ে যাবে। যতদিন পর্যন্ত হাইকোর্টের সিদ্ধান্ত না আসছে এবং ধারাগুলো সংশোধিত না হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত কথিত ধারাগুলোর অপপ্রয়োগ রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। পুলিশ হেফাজত মৃত্যুর বিষয়ে প্রথমবারের মতো আদালত পুলিশের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ঘোষণা করেছেন। এতে পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর সংখ্যা কমবে বলে আশা করা যায়। অনেকেই এখন এ ধরনের মৃত্যুর ক্ষেত্রে পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করার বিষয়ে উৎসাহী হয়ে উঠেছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে হয়রানিমূলক মামলা কিংবা একের হয়ে অন্যের মামলা করা রহিত হলে অথবা তার শাস্তি হলে এ আইনের অপব্যবহার কমবে। আমরা আশা করব, এ আইনের বিতর্কিত ধারাগুলো অচিরেই সংশোধন বা বাতিল কর হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন