শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

এবার বস্তা কেনায় বাণিজ্য

কুড়িগ্রামে খাদ্য বিভাগ দুর্নীতিতে জর্জরিত

শফিকুল ইসলাম বেবু, কুড়িগ্রাম থেকে | প্রকাশের সময় : ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০, ১২:০১ এএম

কুড়িগ্রামে এবার খাদ্য শস্য সংগ্রহের বস্তা ক্রয়ে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে খাদ্য বিভাগের বিরুদ্ধে। নতুন বস্তার পরিবর্তে ছেড়া-ফাঁটা ও নিম্ন মানের প্রায় ৮ লাখ বস্তা ঠিকাদার সরবরাহ করে জেলার বিভিন্ন খাদ্য গুদামে। দুর্নীতি ধামাচাপা দিতে নিম্ন মানের ২ লাখ বস্তা রংপুর ও নীলফামারী জেলায় পাঠানো হলে সংশ্লিষ্ট খাদ্য গুদাম সেগুলো গ্রহণ না করেই ফিরিয়ে দেয়। ফলে ফাঁস হয়ে যায় কুড়িগ্রাম জেলা খাদ্য বিভাগের বস্তা কেলেঙ্কারী।

পুরাতন বস্তা গুদামজাত করতে কুড়িগ্রাম সদর খাদ্য গুদাম কর্মকর্তাসহ জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক ও উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক এবং অফিস খরচ বাবদ প্রতি বস্তায় ১৬ টাকা করে প্রায় এক কোটি ২৮ লাখ টাকা উৎকোচ নেয়ার অভিযোগ উঠেছে সংশ্লিষ্ট খাদ্য বিভাগ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। এর আগে গত অর্থবছরে গম, ধান ও চাল ক্রয়ে কুড়িগ্রাম খাদ্য বিভাগের বিরুদ্ধে কেলেঙ্কারীর লিখিত অভিযোগ ওঠে। এবার নতুন করে বস্তা কেলেঙ্কারী খবরে জেলায় আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

রংপুর আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় গত ৮ সেপ্টেম্বর কুড়িগ্রাম থেকে নীলফামারীতে এক লাখ (৩০ কেজি ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন) খালি বস্তার চলাচল সূচি জারি করে। ১৩ সেপ্টেম্বর নীলফামারী সদর খাদ্য গুদামে খালি বস্তার চারটি গাড়ি প্রবেশ করে। নীলফামারী খাদ্য বিভাগ পুরাতন ও ছেড়া-ফাঁটা বস্তা হওয়ায় তা ফেরত দেয়। পরে নীফামারী সদর এলএসডির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা লিখিত অভিযোগে জানান, কুড়িগ্রাম সদর এলএসডি থেকে পাঠানো বস্তা গুলো ২০১৫-১৬ সালে মহিলা বিষয়ক অধিদফতরের বিভিন্ন খাতে ব্যবহৃত হওয়া। অধিকাংশই ছেঁড়াফাটা ও মেরামত করা বস্তা। ব্যবহারের অনুপযোগী এক লাখ বস্তা কুড়িগ্রামে ফেরত পাঠায় এবং বিষয়টি লিখিত ভাবে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের মাধ্যমে মহাপরিচালককে অবগত করেন।

একইভাবে কুড়িগ্রাম থেকে ২ ট্রাক বস্তা রংপুর শঠিবাড়ীতে পাঠানো হয়। সেখানকার গুদাম কর্মকর্তা রাশেদুজ্জামান রাশেদ নিম্নমানের বস্তা গ্রহণ না করে কুড়িগ্রামেই ফেরত পাঠান। একই ধরনের ঘটনা ঘটেছে কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী থেকে রংপুরের কাউনিয়াতে পাঠানো আরো ২ ট্রাক বস্তার ক্ষেত্রেও। অর্থাৎ কুড়িগ্রাম খাদ্য বিভাগ থেকে পাঠানো ২ লাখ বস্তা নীলফামারী ও রংপুর জেলা খাদ্য বিভাগ ব্যবহার অনুপযোগী আখ্যা দিয়ে ফেরত পাঠিয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ঢাকা খাদ্য বিভাগ টেন্ডারের মাধ্যমে কুড়িগ্রাম জেলায় ৮ লাখ বস্তা সরবরাহ করে। এর মধ্যে কুড়িগ্রাম সদর এলএসডি’র ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কানিজ ফাতেমা উৎকোচের বিনিময়ে ৫ লাখ বস্তা গ্রহণ করে শত ভাগ ভাল হিসেবে সার্টিফিকেট দেন। তিনি বস্তা প্রতি ৬ টাকা হিসাবে ৩০ লাখ টাকা উৎকোচ নেন। একই ভাবে অন্যান্য গোডাউনের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা উৎকোচ গ্রহণ করে নিম্নমানের বস্তা গ্রহণ করেন। জেলা খাদ্য কর্মকর্তাকে দিতে হয়েছে ৭ টাকা দর হিসাবে ৮ লাখ বস্তায় ৫৬ লাখ টাকা। টিসিএফ ও অন্যান্য অফিস খরচ বাবদ ৩ টাকা হারে ২৪ লাখ টাকা বিতরণ করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। তবে কোন পক্ষই উৎকোচের এই এক কোটি ২৮ লাখ টাকার দায় স্বীকার করেননি। নতুন বস্তার টেন্ডারে দর ছিল ৬০/৮০ টাকা। কিন্তু সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বাইরে থেকে পুরাতন বস্তা ১০/১৫ টাকা দরে কিনে নিয়ে চালিয়ে দেয়।

ফুলবাড়ি এলএসডি’র ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হামিদুল ইসলাম সরবরাহকৃত বস্তা ছেড়া-ফাঁটা ও নিম্নমানের হওয়ার কথা স্বীকার করেন। তার গ্রহণকৃত প্রায় এক লাখ নিম্ন মানের বস্তার বিষয়টি উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ নজরে রয়েছে বলে জানান। তবে এ ব্যাপারে তিনি কোন প্রশ্নের জবাব দেননি। নীলফামারী সদর খাদ্য গুদাম কর্মকর্তা শাহ মোহাম্মদ শাহেদুর রহমান বলেন, নিম্নমানের এক লাখ বস্তা কুড়িগ্রামে ফেরত পাঠানো হয়েছে। এ ব্যাপারে একটি লিখিত জবাব ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবর দেয়া হয়েছে।
দুর্নীতির অভিযোগ ওঠা কুড়িগ্রাম সদর এলএসডি’র ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কানিজ ফাতেমা এই বিষয়ে কোন কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান। উল্টো অনুমতি না নিয়ে এখানে ঢুকতে কে দিয়েছে বলে হুংকার ছাড়েন তিনি। গত এক সপ্তাহ ধরে তিনি সাংবাদিকদের ফোন রিসিভ করছিলেন না। এমনকি অফিসেও তার সাক্ষাৎ পাওয়া যায়নি। দিনভর অপেক্ষা করে তার দেখা মিললেও তিনি খাদ্য বিভাগ ও অনিয়ম-দুর্নীতির ব্যাপারে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।

বস্তা কেলেঙ্কারীর সাথেও এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ডিলারদের থেকে উৎকোচ নিয়ে পঁচা চাল কেনার অভিযোগ উঠেছে। তথ্য মতে, গত ১৬ সেপ্টেম্বর তার স্বাক্ষরিত ১৯-২০ অর্থ বছরের আমন চালের ৬২৯ বস্তা (৩১দশমিক ২৫০ টন) চাল রৌমারী খাদ্য বিভাগে পাঠানো হয়। এসব বস্তায় পঁচা দুর্গন্ধযুক্ত চাল সরবরাহ করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন সেখানকার এক খাদ্য কর্মকর্তা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি আরো বলেন, কানিজ ফাতেমা এসব চাল ডিলারের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের উৎকোচের বিনিময়ে কিনে রৌমারী খাদ্য গুদামে পাঠিয়েছেন।

কুড়িগ্রাম জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মিজানুর রহমান পুরাতন ও ছেড়া-ফাঁটা বস্তা খাদ্য গুদামে সরবরাহের অভিযোগ পাওয়ার কথা স্বীকার করেন। এ বিষয়ে গঠিত দুটি তদন্ত কমিটি মৌখিক ভাবে অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে বলে তিনি জানান। তবে বস্তা বাণিজ্যে উৎকোচসহ অন্যান্য অনিয়মের অভিযোগ তিনি অস্বীকার করেন।

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন