ইনকিলাব ডেস্ক : দেশে তীব্র গ্যাস সংকট চলছে প্রায় এক দশক ধরে। তবে এ সংকট নিরসনে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান পেট্রোবাংলার নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার বা কূপ খননের বিষয়ে বড় কোনো উদ্যোগ নেই। যদিও ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি তহবিল নিয়ে অলস বসে আছে প্রতিষ্ঠানটি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশে গ্যাসের চাহিদা ও উৎপাদনের মধ্যে পার্থক্য ক্রমেই বাড়ছে। এর প্রভাব পড়ছে গ্যাসনির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্র ও শিল্পোৎপাদনে। সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রাখা হচ্ছে পর্যাপ্ত গ্যাসের অভাবে। চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস পাচ্ছে না সার কারখানাও। সরবরাহ বাড়াতে না পারায় দাম বাড়িয়ে চাহিদা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে পেট্রোবাংলা। তবে গ্যাসের ভবিষ্যৎ চাহিদা মেটাতে ১২ হাজার ৮০০ লাইন কিলোমিটার দ্বি-মাত্রিক ও ২ হাজার ৮৪০ বর্গকিলোমিটার ত্রি-মাত্রিক জরিপ পরিচালনার পরিকল্পনা রয়েছে পেট্রোবাংলার। এর মধ্যে চলতি অর্থবছর ৩ হাজার লাইন কিলোমিটার দ্বি-মাত্রিক ও ৬০০ বর্গকিলোমিটার ত্রি-মাত্রিক জরিপ পরিচালনা করতে চায় প্রতিষ্ঠানটি।
এছাড়া চলতি অর্থবছর ১৭টি কূপ খননের পরিকল্পনা রয়েছে। এর মধ্যে অনুসন্ধান কূপ ছয়টি, উন্নয়ন কূপ পাঁচটি ও ওয়ার্কওভার কূপ ছয়টি। পাশাপাশি ২১ কিলোমিটার গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণকাজ সম্পন্ন করার পরিকল্পনাও রয়েছে। যদিও দেশের গ্যাস সংকট মেটাতে এসব উদ্যোগ যথেষ্ট নয় বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. ম. তামিম বলেন, পেট্রোবাংলা বিকল্প হিসেবে ২০১০ সাল থেকে এলএনজি আমদানির উদ্যোগ নেয়, যা ২০১৮ সাল নাগাদ আসবে। দেশে গ্যাসের সংকটের বিষয়টি জানা থাকলেও এ প্রক্রিয়া সম্পন্নে প্রায় আট বছর সময় নিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। এটি তাদের অদক্ষতাই প্রকাশ করছে। তবে এদেশে গ্যাসের দাম এখনো তুলনামূলক অনেক কম। প্রাকৃতিক এ সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো গ্যাসের দাম যৌক্তিক পর্যায়ে বাড়ানো প্রয়োজন। জানা গেছে, সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তির পর সাগরে তেল-গ্যাসের অনুসন্ধান শুরু করে দিয়েছে মিয়ানমার ও ভারত। সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে এরই মধ্যে ২০টি কোম্পানি নিয়োগ দিয়েছে মিয়ানমার। বাংলাদেশে এক্ষেত্রে উল্লেখ করার মতো কোনো অগ্রগতি নেই।
মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রবিরোধ নিষ্পত্তির পর তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে কয়েক দফা দরপত্র ডাকে পেট্রোবাংলা। অধিকাংশ ব্লকেই দরপত্র জমা পড়েনি। কয়েকটি ব্লকে জমা পড়ে একক দরপত্র। বহুজাতিক কোম্পানির আগ্রহ বাড়াতে উৎপাদন অংশীদারিত্ব চুক্তি (পিএসসি-২০১২) এক দফা সংশোধনও করা হয়। তাতেও আগ্রহ না বাড়ায় নিয়মের বাইরে গিয়ে কাজ দেয়া হচ্ছে। যদিও ফুরিয়ে আসছে দেশে আবিষ্কৃত গ্যাসের মজুদ।
গ্যাস সংকট নিরসনে বড় কোনো উদ্যোগ দেখা না গেলেও পেট্রোবাংলার তহবিলে অলস পড়ে আছে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি। প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, পেট্রোবাংলার গ্যাস উন্নয়ন তহবিলে (জিডিএফ) অর্থের পরিমাণ ৩ হাজার ৭২ কোটি টাকা। এছাড়া ৬ হাজার ২১১ কোটি টাকা রয়েছে আয়ের সঞ্চিতি হিসেবে। মূলধন সঞ্চিতিও রয়েছে ১ হাজার ৬৯৪ কোটি টাকার। সব মিলিয়ে প্রতিষ্ঠানটির তহবিলের পরিমাণ ১০ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে গ্যাস উন্নয়ন তহবিলের অর্থ থেকে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে ১৯টি প্রকল্প।
তবে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ইশতিয়াক আহমেদ এ প্রসঙ্গে বলেন, বিনিয়োগযোগ্য কোনো অর্থ পেট্রোবাংলার কাছে নেই। গ্যাস উন্নয়ন তহবিলের যে অর্থ, তা এরই মধ্যে বিভিন্ন প্রকল্পে আগাম বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। সরবরাহ ঘাটতির কারণে শিল্প স্থাপন করেও অনেকে গ্যাস সংযোগ পাচ্ছেন না। যদিও দীর্ঘদিন বন্ধ রাখার পর গত বছরের মাঝামাঝি শিল্পে গ্যাস সংযোগের ঘোষণা দেয় সরকার। কিন্তু গ্যাসের পর্যাপ্ত চাপ না থাকায় তা সম্ভব হয়নি। এর মধ্যেই প্রস্তাব এসেছে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির।
মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবকে অযৌক্তিক বলছেন ব্যবসায়ীরা। তাদের দাবি শিল্প, বিশেষ করে বস্ত্র খাতের অধিকাংশ কারখানাই সচল রাখা হয় নিজস্ব উৎস (ক্যাপটিভ) থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতে। আর ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় সরকারের কাছ থেকে গ্যাস কিনেই। ক্যাপটিভে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম বাড়ালে এর প্রভাব পড়বে শিল্পোৎপাদনে।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সহসভাপতি ফজলুল হক বলেন, স্বল্পমূল্যে গ্যাস ছিল বস্ত্র খাতের মূল প্রণোদনা। এক বছরেরও কম সময়ে গ্যাসের মূল্য ৩০০ শতাংশের বেশি বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এটা শিল্প তথা অর্থনীতির জন্য মারাত্মক বিপর্যয়ের ইঙ্গিত। গ্যাস সংকটের বিষয়টি বাস্তব ও অনুধাবনযোগ্য। তাই বলে রাতারাতি মূল্যবৃদ্ধি কোনো সমাধান হতে পারে না। আমাদের প্রত্যাশা ছিল সরকার মূল্যবৃদ্ধির দিকে মনোযোগী না হয়ে গ্যাসের নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরি করবে। কিন্তু তাতে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, এখন পর্যন্ত দেশে গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার হয়েছে ২৬টি। এর মধ্যে ২৪টি অনশোরে ও দুটি অফশোরে। বর্তমানে ২০টি গ্যাসক্ষেত্র উৎপাদনে আছে, যার সবই স্থলভাগে। এ-যাবৎ আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্রের উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের মজুদ ২৭ দশমিক ১২ ট্রিলিয়ন ঘনফুট। এর মধ্যে ১৩ দশমিক ৬৩ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস বিভিন্ন খাতে ব্যবহার করা হয়েছে। অবশিষ্ট মজুদের পরিমাণ ১৩ দশমিক ৪৯ ট্রিলিয়ন ঘনফুট। ২০১৫ সালে দেশে গ্যাসের চাহিদা ছিল দৈনিক ৩ হাজার ২৭৪ মিলিয়ন ঘনফুট। পেট্রোবাংলার পূর্বাভাষ অনুযায়ী, এ চাহিদা চলতি বছর ৩ হাজার ৬৬৪ মিলিয়ন ঘনফুটে দাঁড়াবে। আর ২০১৭ সালে তা ৩ হাজার ৮২৩, ২০১৮ সালে ৩ হাজার ৯৭৯ ও ২০১৯ সাল নাগাদ ৪ হাজার ২৩ মিলিয়ন ঘনফুটে পৌঁছাবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন