গোবিন্দগঞ্জ (গাইবান্ধা) উপজেলা সংবাদদাতা : গাইবান্ধা জেলার একমাত্র ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠান গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার মহিমাগঞ্জে অবস্থিত রংপুর চিনি কল। ১৯৫৫ সালে প্রতিষ্ঠিত এই চিনিকলের একমাত্র কাঁচামাল আখের চাহিদা মেটাতে গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সাপমারা ও কাটাবাড়ী ইউনিয়নের মাদারপুর, রামপুরা, সাপমারা, নরেংগাবাদ ও ফকিরগঞ্জ মৌজায় ১৮৪২.৩০ একর জমি তৎকালীন সরকার রংপুর চিনি কলের অনুকূলে অধিগ্রহণ করে ইক্ষু খামার গড়ে তোলে। সরকারীভাবে প্রথমে সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামার নাম দেয়া হলেও পরে এর নামকরণ করা হয় সাহেবগঞ্জ বাণিজ্যিক খামার। তবে এলাকার লোকজন এখামারকে বাগদা ফার্ম নামে ডাকে। এখামারের উৎপাদিত আখে চালু হয় রংপুর চিনিকল। খামারে আখ উৎপাদন রক্ষণাবেক্ষণ ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য খামারের কেন্দ্রস্থলে অফিস, গোডাউন, গ্যারেজ, আবাসিক ভবন, ডরমেটরী, মসজিদ ও স্কুল, পোষ্ট অফিসসহ বিভিন্ন স্থাপনা গড়ে তোলা হয়। স্থায়ী, অস্থায়ী ও মাস্টাররোল মিলে প্রায় দেড় হাজার লোকের কর্মসংস্থান হয় এ খামারে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ধারাবাহিকভাবেই চলছিল চিনিকলটি। কিন্তু অনিয়ম, দুনীতি ও অব্যবস্থাপনার পাশাপাশি মুক্তবাজার অর্থনীতির সাথে তাল মেলাতে না পারায় চিনিকলটির লোকশানের বোঝা বাড়তে থাকে। এমাতোবস্থায় ২০০৪ সালে বিরাষ্ট্রীয়করণ নীতিমালার আওতায় সরকার এই চিনিকল লে-অফ ঘোষণা করে। যা পরের মৌসুমে সরকার পুনরায় চিনিকলটি চালু করে। এরপর চিনিকল কর্তৃপক্ষ কিছুটা লোকশান পুষিয়ে নিতে সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামারের প্রায় ৭/৮ শত একর জমি ৮০% আখ আবাদের বাধ্যতামূলক শর্তে এক সনা লীজ প্রদান করে। লীজ গ্রহীতারা ৮০% আখ আবাদের বাধ্যতামূলক শর্ত না মানাসহ লীজের টাকা প্রদানে গড়িমসি করায় চিনিকল কর্তৃপক্ষ খামারের জমি লীজ প্রথা বাতিল করে খামার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আখ চাষ শুরু করে। এতে চরম ক্ষুব্ধ হয় লীজ গ্রহীতা চক্রটি। এরপর ওই চক্রটি সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্ম ভ‚মি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটি গঠন করে। ভ‚মি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির ব্যানারে চক্রটি মাদারপুর, রামপুরা, সাপমারা, নরেংগাবাদ ও ফকিরগঞ্জ মৌজায় ১৮৪২.৩০ একর জমি যাদের কাছ থেকে তৎকালীন সরকার রংপুর চিনিকলের অনুকূলে অধিগ্রহণ করেছিল তাদের নিকট আত্মীয়দের জঙ্গি কায়দায় মগজধোলাই করে বলে “খামারের জমি আমাদের বাপ-দাদার সম্পত্তি, তাদের অনুপস্থিতে এ জমির মালিক এখন আমরা” আমাদের সাথে আন্দোলনে শরিক হয়ে বাপ-দাদার রেখে যাওয়া সম্পতির অধিকার ফিরে নিন। এলাকার সহজ সরল মানুষরা তাদের কথায় বিশ্বাস স্থাপন করে ওই চক্রের আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত হয়। শুরু হয় নতুন খেলা প্রতি শনিবার খামার এলাকার কাটামোড়ে বিক্ষোভ-সমাবেশ হতে থাকে জমি উদ্ধারের দাবীতে। আর এর ব্যয় মেটাতে বাপ-দাদার সম্পতির দাবীদারদের কাছ থেকে নেয়া হয় মোটা অংকের চাঁদা। যা টাকার অংকে দুই কোটি টাকা ছেড়ে যাবে বলে এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে। অনেকেই আছে যারা দিন আনে দিন খায় এ চক্রের খপ্পরে পরে তাদের শেষ সম্বল রিকশা-ভ্যান বিক্রি করে অথবা এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে দাবীকৃত চাঁদা পরিশোধ করেছে। যার মধ্যে সাওতাল সম্প্রদায়ের অধিবাসীরাও রয়েছে। এভাবে প্রায় দুই বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর গত ১ জুলাই অদৃশ্য প্রভাবশালী শক্তির ইশারায় ইক্ষু খামারের মাদারপুর, হরিনমারী ও মেরী এলাকায় শতাধিক একর জমি অবৈধ দখল করে সাওতাল, হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের কয়েক শত লোক বসতি স্থাপন করে। ১ জুলাই থেকে ঈদুল আযহার ছুটি থাকায় ১২ জুলাই জমি অবৈধ দখল মুক্ত করতে প্রশাসন অভিযান চালালে দখলকারীরা তীর-ধনুকসহ দেশীয় অস্ত্র নিয়ে প্রশাসনের উপর হামলা চালালে প্রশাসন ফিরে আসে এবং দখলকারীরা খামার অফিসে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাঙচুর লুটপাট চালায়। এরপ্রেক্ষিতে খামার অফিসে পুলিশের অস্থায়ী ক্যাম্প বসানো হয়। গত ৭ আগস্ট সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্ম ভ‚মি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির শাহজাহান আলী প্রধান, ফিলিমন বাস্কে, স্বপন চন্দ্র, সুফল, নগেন, সরেন মার্ডির নেতৃত্বে প্রায় ২/৩ শ’ মানুষ বিক্ষোভ মিছিল বেড় করে। পুলিশ বিক্ষোভ মিছিল থেকে এজাহারভুক্ত দুই আসামিকে গ্রেফতার করে। এতে মিছিলকারীরা ক্ষিপ্ত হয়ে তীর-ধনুক, বল্লম, হাসুয়া, লাঠিসোঁটাসহ নানা ধরনের দেশীয় অস্ত্র নিয়ে খামারে স্থাপিত অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্পে হামলা করে। এসময় তারা ক্যাম্পের চেয়ার-টেবিল, জানালা দরজা ভাঙচুর করে বেশ কিছু মালামাল নিয়ে যায়। পরে গাইবান্ধা পুলিশ সুপার আশরাফুল ইসলাম বিপিএম ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। ৯ আগস্ট মঙ্গলবার ইক্ষু খামারের অফিস সংলগ্ন হরিনমারী নামক স্থানে তথাকথিত ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটি আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের এবং রংপুর চিনিকলের শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন ও আখ চাষী কল্যাণ সমিতিও একই স্থানে একই সময়ে বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করায় দুইপক্ষের মধ্যে চরম উত্তেজনা দেখা দেয়। এ প্রেক্ষিতে আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও উপজেলা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ আব্দুল হান্নান গত ৮ আগস্ট সোমবার সন্ধায় এক আদেশে ৯ আগস্ট মঙ্গলবার ভোর ৬টা হতে হরিনমারী নামক স্থানের চতুর্দিকে ১ কিলোমিটার এলাকায় ১৪৪ ধারা জারী করেন। ১৪৪ ধারা জারি থাকায় ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটি এবং রংপুর চিনিকলের শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন ও আখ চাষী কল্যাণ সমিতির কোন পক্ষই ওই স্থানে কর্মসূচি পালন করতে পারেনি। তবে খামারের জমি অবৈধ দখলদার মুক্ত করার দাবীতে মিলগেটে শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন ও আখ চাষী কল্যাণ সমিতি সমাবেশ করেছে। আর তথাকথিত ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটি সমাবেশ না করে দখলকৃত প্রায় একশত বিঘা জমিতে আমনের চারা রোপণ শুরু করেছে। অবৈধ দখলদাররা প্রতিদিন নতুন বসতি স্থাপনসহ জমিতে হালচাষ করলেও হাজার কোটি টাকার সরকারী এ ভ‚সম্পত্তি উদ্ধারে কার্যকর কোন পদক্ষেপ না নেয়ায় উপজেলাবাসীর মাঝে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। কেননা এই অবৈধ দখলদাররা দখলকৃত এলাকায় রাষ্ট্রীয় আইনকে অবজ্ঞা করে বেআইনীভাবে নিজস্ব কতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে জনসাধারণের চলাচলের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করছে। এভাবে চলতে থাকলে অচিরেই ইক্ষু খামারটি ভ‚মি দস্যুদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে যা পুনরুদ্ধারে সরকারকে যথেষ্ট বেগ পেতে হবে। কোন কারণে এ ইক্ষু খামারে যদি আখ আবাদ না হয় তবে কাঁচামালের অভাবে রংপুর চিনিকল এমনিতেই বন্ধ হয়ে যাবে। তাই সময় থাকতেই পদক্ষেপ নিতে হবে সরকারকে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন