শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

নজরুল কাব্যে নবীপ্রেম

ড. আবুল কালাম | প্রকাশের সময় : ৩০ অক্টোবর, ২০২০, ১২:০২ এএম

নজরুল কাব্যে রসুলুল্লাহ (সা.) এর নূর সৃষ্টি ও আল্লাহর আরশে আদম আ. এর সেই নূরকে দেখা থেকে শুরু করে মক্কী-মাদানী জীবনের ঘটনাবিশেষের নানান চিত্র ফুটে উঠেছে। আরশে মুহাম্মদ (সা.) এর নাম দেখে আদম (আ.) অবাক বিস্ময়ে আল্লাহকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, কে এই মুহাম্মদ (সা.)? কবির ভাষায়: 

কেবা এ পুরুষ, কেন এ উদিল আমার ললাট-তীরে,

ধন্য করিলে কেন এ মধুর বোঝা দিয়ে মোর শিরে?
আল্লাহ প্রতি উত্তরে বলেন, এই ব্যক্তির নাম মুহাম্মদ (সা.)। সে আমার প্রিয় বন্ধু, আমার হাবিব ও খলিল। সকল বিশ্ববাসীর জন্য রহমত। সমস্ত বিশ্ববাসী তাঁর প্রশংসার পঞ্চমুখ হবে। আর তিনিই আমার শেষ নবী হবেন। তাঁর কণ্ঠে জগতবাসী শুনবে আমার অমূল্য বাণী। কবি ভাষায়:

আমার হাবিব-বন্ধু এ প্রিয়; মানব-ত্রাণের লাগি
ইহারে দিলাম তোমাতে-হইতে মানব-দুঃখ-ভাগী।
মোহাম্মদ এ, সুন্দর এ, নিখিল প্রশংসিত,
ইহার কণ্ঠে আমার বাণী ও আদেশ হইবে গীত।
আদম আ. থেকে হজরত ঈসা আ. পর্যন্ত সকল নবী তাঁর গুণগান গেয়েছেন। দিয়েছেন তাঁর আবির্ভাবের সুসংবাদ,
সে সিদ্দিক ও আমীন খুঁজিছে বাইবেলে আর ঈসা
তওরাত দিল বারে বারে যেই মোহাম্মাদের দিশা,
পাপিয়া কণ্ঠ দাউদ গাহিল যার অনাগত গীত।
হজরত ঈসা (আ.) এর ৫৭০ বছর পরে ১২ রবিউল আউয়াল মাসে সোমবার সকালে রসূলের শুভ আবির্ভাবের দিকে ইঙ্গিত করে কবি বলেন:

মসীহের পঞ্চশত সপ্তমী এক বর্ষ পরে
সোমবার জ্যেষ্ঠ প্রথম ধরার মানব ত্রাণের তরে,
আসিলেন বন্ধু খোদার মহান উদার শ্রেষ্ঠ নবী
মার্হাবা সৈয়দে মক্কী মদনী আল-আরবি।
এই নবাগত শিশু যিনি খালিকের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি তাঁকে দেখবার জন্য শুধু আত্মীয়-স্বজনই নয় বরং আকাশ বাতাস, তরুলতা, হুর জেন-পরী, অসংখ্য ফেরেশতার ভীড় অদৃশ্যভাবে উপচে পড়ে মা- আমিনার প্রসব কক্ষে। আর বয়ে যায় সালামের বন্যা। কবির ভাষায়:

ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ এলরে দুনিয়ায়
আয়রে সাগর আকাশ বাতাস, দেখবি যদি আয়।
পূর্ণিমা চাঁদের থেকে উজ্জ্বল ও সুন্দর, সুদৃশ্য, নয়নাভিরাম এই নবাগত শিশু। তাই দাদা আব্দুল মুত্তালিবের ঘরে আন্দের বাঁধ ভেঙেছে। এখন শিশুর নামকরণের পালা। কবি বলেন:
কহিল মুত্তালিব বুকে চাপি নিখিলের সম্পদ
নয়নাভিরাম, এ শিশুর নাম রাখিনু মোহাম্মাদ।
নাম শুনি কহে আমিনা-স্বপ্নে হেরিয়াছি কাল রাতে
‘আহ্মদ’ নাম রাখি যেন ওর! জননী, ক্ষতি কি তাতে
হাসিয়া কহিল পিতামহ, ‘এই যুগল নামের ফাঁদে,
বাঁধিয়া রাখিনু কুটিরে মোদের তোমার সোনার চাঁদে!’
চার বছরের শিশু মুহাম্মদের জীবনে একটি অপূর্ব অলৌকিক ঘটনা ঘটে। একদিন কে যেন তাঁকে পাহাড়ের পাদদেশে নিয়ে যায়। দুধ-মা হালিমা খুঁজে খুঁজে হয়রান। আল্লাহর ইশারায় সেখানে ফেরেশতারা তাঁর ‘সিনা চাক তথা বক্ষ উন্মোচন’ করেন। কবি বলেন:

ধুইল হৃদয় পবিত্র ‘আব জমজম’ দিয়ে জিব্রাইল
বলিল, ‘আবার হলে পবিত্র জ্যোতি মহান, তোমার দিল।
শিশু নবী চাচার সঙ্গে শ্যামদেশে (অধুনা সিরিয়া) গেলেন। সেখানে ছিলেন বোহায়রা নামে আল্লাহর এক ওলী, সাধক। তিনি শিশু মুহাম্মদকে দেখে বলেন-

আল্লার এই শেষ ‘রসূল’
পাপের ধরায় পুণ্যফুল,
দীন দুনিয়ার সর্দার এই, ইহার আদি অন্ত নেই।
আল্লাহর এ রহমত রূপ, নিখিল খুঁজে পায় না যেই।
হজরত মুহম্মদের তরুণ বয়সে পবিত্র কাবাঘর সংস্কারের পরে ‘হাযরুল আসওয়াদ’ রাখা নিয়ে শুরু হয় জটিল সমস্যা। এই বিরোধ গড়ায় রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের দিকে। অতঃপর যুবক মুহাম্মদ (সা.) এর হাতেই এর সুষ্ঠু সামাধান হয়। কবি বলেন:

আমার উত্তরীয় দিয়া এরে বাঁধিয়া তাহার পর
একসাথে এরে রাখিব কাবায়। কহে সবে- সুন্দর
সুন্দর এই মীমাংসা তব, আমীন, হেজাজ ধন্য
তুমি রাখ এই পাথর একাই, ছুঁইবে না কেহ অন্য।
রসুলুল্লাহ (সা.) এর চল্লিশ বছর বয়সে হেরা গুহায় ধ্যানমগ্ন অবস্থায় হযরত জিব্রাইল (আ.) নিয়ে আসলেন সত্যের শওগাত, নবুওয়াতের ঐশী বাণী। জিব্রাইলকে প্রথম দেখে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে কম্পিত পদে পথ চলার দৃশ্যটি কবি নজরুল সুন্দর ভাবে এঁকেছেন:

হেরা হতে হেলে দুলে নূরানী তনু ও কে আসে হায়,
সারা দুনিয়ার হেরেমের পর্দা খুলে খুলে যায়
সে যে আমার কমলিওয়ালা, কমলিওয়ালা।নবুওয়াত প্রাপ্তির পর তিনি ইসলামের শাশ্বত সত্য বাণী মক্কার দুয়ারে দুয়ারে পৌঁছে দিতে লাগলেন। যার কারণে তাঁর উপর নেমে আসে ইসলাম বিরোধীদের অকথ্য অত্যাচার। তবু শত বাধা সত্তে¡ও দলে দলে লোক ইসলামের শান্তির ছায়াতলে আশ্রয় নিতে লাগল। কাফের মুশরিকদের অত্যাচারে মক্কায় জীবন বিপন্ন হয়ে গেল। তখন আল্লাহর আদেশ হলো মদীনায় হিজরতের। মদীনাবাসীরা তাঁকে জনালেন শুভসম্ভাষণ ও আন্তরিক অভিনন্দন। এই চিত্রকে কবি চিত্রাঙ্কন করছেন এই ভাবে:

চাঁদ উদিত হয়েছে
উদিত হয়েছে সে
আলোকিত হবে যাত্রাপথে
চির আলোকের পথ।
মদীনাবাসী নারী ও পুরুষ বিভিন্ন গীত গেয়ে তাঁকে মোবারকবাদ ও অভিবাদন জানালেন। কবির ভাষায় তারই প্রতিধ্বনি:

ঐ হের রসূলে খোদা এল ঐ।
গেলেন মদিনা যবে হিযরতে হযরত
মদিনা হলো যেন খুশিতে জিন্নত,
ছুটিয়া আসিল পথে মদ ও আওরত
লুটায়ে পায়ে নবীর, গাহে সব উম্মত
ঐ হের রসুলে-খোদা এলো ঐ।।
নবুওয়াতের দায়িত্ব সম্পন্ন হওয়ার পরে রসুলুল্লাহ ইহজগত থেকে পর্দা নিলেন। রসূলের ইন্তেকালের পরে সমস্ত সাহাবা দিশেহারা। কবির ভাষায়:
বহে শোকের পাথার আজি সাহারায়
‘নবীজী নাই’ উঠল মাতম মদিনায়।

মৃত্যু দৃশ্য বড়ই সকরুণ। সব অঘটনীয় আজ ঘটে গেল। হযরত জিব্রাইল আজ অশ্রæসিক্ত, আজরাইলের থর থর কম্পন, কার জান নিচ্ছেন! আকাশ বাতাসের মন ভাঙ্গে খান খান। চন্দ্র সূর্য আজ জ্যোতিহীন। কবি নজরুলও কাতরকণ্ঠে গাইছেন:
এই বিস্ময়। আজরাইলেরও জলে ভর ভর চোখ।
বে-দরদ দিল কাঁপে থর থর যেন জ্বর জ্বর শোক।
জান-মারা তার পাষাণ-পাঞ্জা বিলকুল ঢিলা আজ
কব্জা নিসাড়, কলিজা সুরাখ খাক চুমে নীলা তাজ।
কিয়ামতের দিবসে কওসর তাঁরই হাতে হবে। কবি বলেন:

কেয়ামতে যাঁর হাতে কওসর পিয়ালা।
মহিমা যাঁহার জানেন এক আল্লাহ তালা।
উম্মত গোনাহগার। তাই রসূলের শাফায়াতের প্রয়োজন সকলের। শেষ বিচারের দিনে শাফায়াতের জন্য সকলেই থাকবে উৎকণ্ঠিত ও উদগ্রীব। কবি বুকভরা আসা নিয়ে বলেন। কোনো ভায় নাই কারণ আমি মাহবুবে খোদার উম্মত:
উম্মত আমি গোনাহগার
তবু ভয় নাইরে আমার।
আহমদ আমার নবী

যিনি খোদ হাবিব খোদার।।
রাসূল সা. কে নিয়ে নজরুল এত নাত-এ-রাসূল রচনা করেছেন ভাবলে বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না। এ যেন এক অসাধ্য সাধন করেছেন তিনি।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, আরবি বিভাগ, শহীদ নুরুল ইসলাম মহাবিদ্যালয়, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
WASIF ALI ৩০ অক্টোবর, ২০২০, ১২:১৭ পিএম says : 0
Outstanding writing
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন