মেছতা একটি ত্বকজনিত চর্মরোগ এবং মহিলাদের জন্য এটি খুবই বিরক্তিকর। বিশেষ করে নারীদের, মুখে, থুতনিতে, কপালে ও গালে হালকা বাদামি, কালো বা লালচে ছোপ দেখা যায়, যা মেছতা নামে পরিচিত। মেছতা পুরুষ ও মহিলাদের উভয়েরই হতে পরে তবে নারিদের ক্ষেত্রে এর আধিক্য দেখা যায়। মূলত ত্বকের রঞ্জক পদার্থ মেলানিনের পরিমাণ বেড়ে যাওয়াই এর কারণ। দিন যত যায়, রঙের গাঢ়ত্ব তত বাড়ে এবং রোগী এক বিবত্রকর সমস্যায় পড়ে যান। আমাদের দেশে ২০ থেকে ৫০ বছর বয়সী বিশেষ করে চল্লিশোর্ধ্ব নারীরা মেছতায় বেশি আক্রান্ত হয়। এর আসল নাম মেলাজমা। অনেক ভিন্ন ভিন্ন নারীদের ক্ষেত্রে মুখ ছাড়াও চিবুক ও বাহুর উপরিভাগেও মেছতার কালো ছোপ পড়তে পারে। বর্তমানে মেছতার উন্নত চিকিৎসা আছে, তাই দুশ্চিন্তার কিছু নেই। সাধারনত গর্ভধারণের সময় হরমোনের প্রভাবে অনেক সময় মুখে মেছতা দেখা দিতে পারে। এছাড়া বংশগতির প্রভাব, অতিরিক্ত সূর্যালোক, জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি এর ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। হরমোনের সমস্যা, যেমন থাইরয়েড বা ডিম্বাশয়ের সমস্যায় এটা হতে পারে।
ত্বকের কালো রঙের জন্য দায়ী যে মেলানিন নামের রঞ্জক পদার্থ, এতে সেই পদার্থের পরিমাণ বেড়ে যায়। মেছতার প্রাসঙ্গিক কোনো উপসর্গ নেই। কোনো চুলকানি বা ব্যথা কিছু হবে না। শুধু মেছতার মতো অনেক সময় কালো দাগ তৈরি করতে পারে। কতগুলো তিলজাতীয় জিনিস রয়েছে। যেমন- লিভাস নোটা, লিভাস আইটো। দেখতে অনেকটা কালো দাগ, তবে আসলে মেছতা নয়। সাধারণত এটি এক পাশে হয়ে থাকে। মেছতা দু’পাশেই হয়। এটি ছাড়া আর অন্য কোনো রোগ বিশেষ জড়িত নয়। মেছতা সাধারণত একটি বিশেষ বয়সে হয়। আবার বিশেষ কারণেও হয়ে থাকে। সে কারণগুলোর ভেতরে হরমোনের প্রাধান্যই বেশি। বিশেষ করে গর্ভাবস্থায়। তবে ছেলেদের যে মেছতা হয় না, তা নয় কিন্তু মেয়েদের আনুপাতিক হারে বেশি হয়। মেয়েদের বেশি হওয়ার কারণগুলোর মধ্যে গর্ভাবস্থা- গর্ভাবস্থায় কিছু হরমোন প্রাধান্য দায়ী করা হয় এছাড়া মেনোপজের জন্য হয়ে থাকে। আবার কোনো সময় হরমোনের ওষুধ খাওয়ার জন্য হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি খাওয়ার ফলে মেছতা বেশি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। অন্য বিশেষ কিছু কারণ মেছতা হতে পারে। যেমন- সূর্যের আলোর প্রভাব। সূর্যের আলোতে যারা বেশি থাকে, তাদের আলট্রাভায়োলেট রশ্মি মুখে পড়ার কারণে মেছতা বেশি হয়। অতিরিক্ত প্রসাধনী ব্যবহারের কারণে মেছতা হতে পারে, ডাক্তারি ভাষায় একে বলা ‘মেলাজমা কসমেটিকা’। যকৃতের জটিলতার কারণে যে মেছতা হয় তাকে বলা হয় ‘মেলাজমা হেপাটিকা’ বর্তমানে কেমিক্যাল পিলিং, মাইক্রোডার্মাবেশন ও পিআরপি থেরাপির মাধ্যমে মেছতার চিকিৎসা করা হচ্ছে। কিছু আধুনিক মলম ও মুখে খাওয়া ট্যাবলেটও মেছতা চিকিৎসায় কার্যকর। মেছতা সাধারনত দুই ধরনের হয়। এপিডারমাল মেলাজমা ও ডারমাল মেলাজমা। ত্বকের উপরের অংশে যে মেছতা হয় তাকে এপিডারমাল মেলাজমা বলা হয়। আর ডারমাল মেলাজমা হয় ত্বকের ভেতরের অংশে। এপিডারমাল মেলাজমার চিকিৎসা সহজ তবে ডারমাল মেলাজমার চিকিৎসা একটু জটিল হয়। সুন্দর মুখ মানেই দাগহীন কোমল মসৃন ত্বক। সেই মুখশ্রীতে অনেক সময় আমাদের কিছু ভুলের কারণে বা নানাবিধ কারণে সৃষ্টি হয় অনাকাংক্ষিত দাগ। এই দাগ সৌন্দর্যহানি ও বিব্রতকর। এমনই একটি সাধারণ দাগ হলো মেছতা। মেছতাকে মেলাজমা, ক্লোয়াজমা ফেসি বলা হয়। জরিপে দেখা গেছে, তুলনামূলকভাবে মেয়েদের মেছতা বেশি হয় এবং রিপ্রোডাকটিভ এজেই বেশি দেখা দেয়। নারী-পুরুষের অনুপাত ৯:১। পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মেছতার প্রকোপ বেশি।
মেছতা থেকে পরিত্রানে করনীয় :
গর্ভধারণকালে ত্বকে যে মেছতা দেখা দেয়, তা সন্তান জন্মের পর এমনিতেই কমে যায়। রোদে বা বাইরে বের হলে উচ্চ এসপিএফযুক্ত সানব্লক ব্যবহার করুন। প্রচন্ড রোদে বাইরে বের হলে ছাতা ব্যবহার করুন। হরমোনের সমস্যা আছে কি না, শনাক্ত করে চিকিৎসা নিন। হাইড্রোকুইনোন সমৃদ্ধ ব্লিচিং ও ভিটামিন এ যুক্ত ক্রিম অনেক সময় ব্যবহার করতে দেওয়া হয়। এ ছাড়া মেথিমাজোল, এজেলিক অ্যাসিড, স্টেরয়েড ক্রিম ইত্যাদিও ব্যবহৃত হয়। কিন্তু মনে রাখবেন, এগুলো প্রসাধন ক্রিম নয়, এগুলো ওষুধ। তাই ব্যবহারের আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে কেমিক্যাল পিলিং এবং লেজার চিকিৎসাও দেওয়া হয়।
মেছতা মূলত ত্বকের একটি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা। সাধারণত বাদামি বর্ণের হলেও ত্বকের গভীরতা, ত্বকের ধরন অনুযায়ী রঙের হালকা তারতম্য হতে পারে। ত্বকের স্তরর ও মুখমন্ডলের বিভিন্ন অংশ, পরিসরের ওপর ভিত্তি করে মেছতা শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছে। গভীরতা অনুযায়ী এপিডার্মাল, ডার্মাল ও মিক্সড মেলাজমা নামকরণ করা হয়েছে। সেন্ট্রোফেসিয়াল মেলাজমা থুতনি, কপাল ও নাকে হয়। এ ধরনের মেলাজমার হার বেশি। ৬ ভাগ মেলাজমাই সেন্ট্রোফেসিয়াল। ম্যালার মেলাজমা দুই চিবুকে সমানভাবে আর ম্যান্ডিবুলার টাইপ চোয়ালের নিচে হয়। মেছতা মুখ ছাড়াও হঠাৎ করে দুই বাহুতে হতে পারে। তবে এর হার খুবই কম। মেলানোসাইট সেল দিয়ে তৈরি বাড়তি মেলানিনের কারণেই সৃষ্টি হয় মেছতার। এর অসংখ্য কারণ রয়েছে। এর মধ্যে বংশগত কারণটি প্রধান। কিছু কিছু রোগেও মেছতা বৃদ্ধি পায়। উদাহরণস্বরূপ হাইপোথাইরয়েডিজম। গর্ভাবস্থায় মেছতার হঠাৎ আবির্ভাব হয় বলে একে মাস্ক অব প্রেগনেন্সি বলা হয়। আমাদের দেশে অধিকাংশ নারী জন্মনিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা হিসেবে বেছে নেন জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি। বার্থ কন্ট্রোল পিল দিয়ে জন্মনিয়ন্ত্রণ হচ্ছে। তবে অন্যদিকে আক্রান্ত হচ্ছেন মেছতায়। জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ির মতো পোস্ট হরমোনাল থেরাপিও মেছতার একটি কারণ। সূর্যের ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মির সংস্পর্শে, চুলার তাপ মেলানিন তৈরির উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে। সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য যেসব প্রসাধনী ব্যবহার করা হয় অথবা হালকা মেছতা মেকআপ দিয়ে ঢাকার জন্য যেসব প্রচেষ্টা চালানো হয়, সেসব প্রসাধনীর ক্ষতিকর কেমিক্যাল, ফ্রেগ্রনেন্স মেছতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
শুধু চোখে দেখেই মেছতার ডায়াগনোসিস সম্ভব। এ ছাড়া সাহায্য নেওয়া যায় উড্স ল্যাম্পের। উড্স ল্যাম্পে এপিডার্মাল ও ডার্মাল-এর পার্থক্য স্পষ্টভাবে বোঝা যায়। এপিডার্মাল উড্স ল্যাম্পে গাঢ় ও ডার্মাল হালকা দেখায়।এক সময় মেছতার চিকিৎসায় স্কিন লাইটেনিং ক্রিম লোশন, সেরাম ব্যবহার করা হতো। এদের মধ্যে দুই ভাগ বা চার ভাগ হাইড্রোকুইননই বেশি জনপ্রিয়। হাইড্রোকুইননের সঙ্গে ট্রেটিনয়িক এসিড (০.২৫ ভাগ বা ০.০৫ ভাগ), হাইড্রোকর্টিসন যোগ করা হলে চমৎকার ফল পাওয়া যায়। তবে গর্ভাবস্থায় ট্রেটিনয়িক এসিড ব্যবহার নিষিদ্ধ। একসময় এজোলিক এসিডের ব্যবহার করা হতো। সময়ের সঙ্গে যুগের চাহিদা অনুযায়ী মেছতার অনেক আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে। ইদানীং মাইক্রোডার্মাব্রাসন ও ডায়ামন্ড পিল বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। কখনো কখনো মাইক্রোডার্মাব্রাসনের সঙ্গে বা শুধু একা কেমিকেল পিল-এর পরামর্শ দেন ডার্মাটোলজিস্টরা। ৩০ ভাগ থেকে ৭০ ভাগ গ্লাইকোলিক এসিড বেশি ব্যবহৃত হয়। এসব পদ্ধতি কয়েক সেশন লাগে। পিআরপি, মাইক্রোনিডলিং লেজার-এর মতো আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি বিশ্বের অন্যান্য উন্নত দেশের মতো আমাদের দেশেও শুরু হয়েছে। এসব চিকিৎসার সঙ্গে অবশ্যই ৩০ বা ৫০ এসপিএফ যুক্ত সানস্ক্রিন ব্যবহার করতে হবে। মেছতার প্রধান চিকিৎসা হলো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ যথাযথভাবে মেনে চলা। এর পরামর্শে, ওর পরামর্শে বাজার থেকে ইচ্ছেমতো প্রসাধন ব্যবহার করলে মেছতা থেকে পরিত্রান পাওয়া দূরহ। পরিশেষে বলতে পারি কোনো চিকিৎসাই কার্যকরী হবে না যদি আপনি নির্দেশাবলি মেনে না চলেন।
ডাঃ জেসমিন আক্তার লীনা
সহকারি অধ্যাপক (চর্ম ,যৌন ও অ্যালার্জি)
স্যার সলিমুল্লাহ্ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা ।
প্রয়োজনে-০১৭২০১২১৯৮২।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন