শামীম চৌধুরী : অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালে এসে ধাক্কা খাওয়ার অতীতটা নুতন নয়। এর আগে তিন বার (২০০৬, ২০০৮ ও ২০১২) কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে সেই তিনটি ম্যাচেই হতাশ হতে হয়েছে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দলকে। ২০০২ সালে অনুষ্ঠিত অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে প্লেট সেমিফাইনালে নেপালের কাছে হার ও ১৪ বছর পর বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছিল মেহেদী হাসান মিরাজের দলকে। নেপাল পেস বোলার দিপেন্দ্র আইরিকে লং অনের উপর দিয়ে জাকিরের ছক্কায় ১৪ বছর আগের হারের বদলা’র সঙ্গে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো সেমিফাইনাল নিশ্চিত করেছে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দল। ওই শটের সঙ্গে সঙ্গে বাউন্ডারি রোপের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা ক্রিকেটারদের সে কি দৌঁড়! যেনো এক একজন উসাইন বোল্ট, আসাফা পাওয়েল।
সেরা দল নিয়ে ২০০৬ এ কোয়ার্টার ফাইনালের হার্ডল পেরুতে পারেননি সাকিব, মুশফিক, তামীমরা। ১০ বছর পর সাকিবদের সে কষ্ট লাঘব করতে পেরে তাই ভীষণ উৎফুল্ল অনূর্ধ্ব-১৯ দলের অধিনায়ক মেহেদী হাসান মিরাজÑ ‘খুব ভালো লাগছে। আমরা এই প্রথম অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে উঠছি। এই আসরে অন্ততঃ সেমিফাইনাল খেলব, টুর্নামেন্ট শুরুর আগে সে লক্ষ্য ছিল আমাদের। সে লক্ষ্য পূরণ করতে পেরেছি। চাপের মধ্যে ভাল খেলতে পারি। সবার ভেতর সে বিশ্বাস ছিল এবং আমরা তা পেরেছি।’
স্কোরশিটে ৯৮ উঠতে ৪ উইকেট হারানোর পর ১৩১ বলে ১১৪ রানের টার্গেট মোটেও সহজ মনে হয়নি। সেখান থেকে জাকিরকে নিয়ে ১১৭ রানের অবিচ্ছিন্ন পার্টনারশিপ, সামনে থেকে অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত’র ব্যাটিংয়ে দলকে নেতৃত্ব দেয়ায় প্রেসিডেন্ট বক্স থেকে এক এক করে বিসিবি’র সভাপতিসহ সব পরিচালক মাঠে পর্যন্ত নেমেছেন, দলকে অভিনন্দিত করেছেন। চলমান অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে প্রতিটি ম্যাচেই শুরুটা হচ্ছে না প্রত্যাশিত, তারপরও একটার পর একটা ম্যাচে প্রত্যাশিত জয় পাচ্ছে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দল। কোয়ার্টার ফাইনালেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। এই ম্যাচেও মিডল অর্ডার দিয়েছে ভরসা। অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের এই আসরে জাকিরের প্রথম ফিফটির (৭৫ নট আউট) পাশে অধিনায়ক মেহেদী হাসান মিরাজের দ্বিতীয় ফিফটি (৫৫ নট আউট)। ৫ম জুটিতে অবিচ্ছিন্ন ১১৭। পার্টনার জাকিরকে তাই ধন্যবাদ দিতেই হচ্ছে মিরাজকেÑ ‘জাকির অবিশ্বাস্য একটি ইনিংস খেলেছে। ঠিক ভাইটাল সময়ে ভাইটাল ইনিংস। আমি যখন ব্যাটিং করতে যাই, তখন ও (জাকির আমাকে একটা কথাই বলেছে, শুরুতে বড় শটে না যেয়ে বরং সিঙ্গলে খেলে স্ট্রাইক রোটেড করা ভাল, চার-ছয়ের জন্য যাব না। এ কথাই সে মনে করিয়ে দিয়েছিল আমাকে। ওর ওই কথায় কাজ দিয়েছে। আমি আর জাকির যখন খেলছিলাম, তখন শেষ ১০ ওভারে ৭০ রানের মত লাগত, আমরা কিন্তু ১০ বল আগেই শেষ করেছি।’
মিরাজ উইকেটে থাকলে রান আসবেই, এ বিশ্বাস বদ্ধমূল অনূর্ধ্ব-১৯ দলের কোচ মিজানুর রহমান বাবুলের। স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে নাজমুল হোসেন শান্তকে নিয়ে ৪র্থ উইকেট জুটিতে ১০০ এবং একই জুটিতে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ৫৯ এ দলকে নির্ভরতা দেয়া মেহেদী হাসান মিরাজের উপর তাই ছিল আস্থা। সে আস্থার প্রতিদান দিয়েছেন মিরাজ।
ইনফর্ম শান্ত’র দ্রæত ফিরে যাওয়ায় তাই দূর্ভাবনা বাসা বাধেনি তার। চাপ সামলে দলকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে পারেন মিরাজ, এ পরীক্ষা অতীতে দিয়েছেন বহুবার। গতকাল সে পরীক্ষাটা একটু বেশিই চ্যালেঞ্জ ছিল মিরাজের। নিজের নেতৃত্বেই শুধু নয়, মিরাজের ব্যাটিংয়ে সেমিফাইনালে উঠে নুতন ইতিহাস রচনা করতে পেরেছে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দল। চাপের মুখে ক্যাপ্টেনসি উপভোগের মন্ত্রটাই তার প্রধান দর্শন বলে জানিয়েছেন মিরাজÑ‘ অধিনায়ক হিসেবে আমি সবসময় দলকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে চাই। দল যেন সবসময় ভালো ফল করে এবং আমি যেন তাতে অবদান রাখি। আমি কখনোই চাপ নেই না। উপভোগ করি সবসময়। দলের সবাই আমাকে খুব সাহায্য করে, সবাই খুব ভালো। ’
হোক না অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ ক্রিকেট, স্বাগতিক দলের খেলা দেখতে প্রতিটি ম্যাচেই আসছে দর্শক। নেপালের বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালে দর্শক উপস্থিতি প¦ার্শচাপের কারন হয়নি। বরং দর্শকে প্রেরনা পেয়েছে মিরাজÑ ‘এত দর্শকের সামনে কখনও খেলা হয়নি। আজ খুব ভালো লেগেছে। সবাই আমাদের সমর্থন জানিয়েছে। আমাদের মনের ভেতর খুব ভালো অনুপ্রেরণা জেগেছে যে সবাই খেলা দেখছে। আমরা চাপ নেইনি। মজা পাচ্ছিলাম, মাঠের ভেতর উপভোগ করেছি।’
নেপালের হার্ডল পেরিয়েছে ঠিকই বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দল। তবে চেনা ভেন্যুতে খেলতে এসে নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়ার অভাবটা কিন্তু ধরা পড়েছেন এদিন। রানিং বিট্যুইন দ্য উইকেটে পিনাক-জয়রাজের ভুল বোঝাবুঝি সে চিত্রটাই করেছে উন্মোচন। তার কারণটা ধরতে পেরেছেন মিরাজÑ ‘এখানে মাঠ একটু অন্যরকম। অনেক সময় বোঝ যায় না। আমরা হয়ত ডিফেন্স করলাম, বল গ্যাপে গেল কি গেল না, ঠিক বোঝা যায় না। মাঠ অনেক বড় বলে ভালোমত বোঝা যায় না। একটা-দুটি ম্যাচে হতেই পারে এরকম। তবে এটা বড় সমস্যা বলে মনে হয় না আমার কাছে।’
প্রতিটি ম্যাচেই বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দলকে চাপে ফেলছে টপ অর্ডার। কোয়ার্টার ফাইনালে বিগ শট খেলবে টপ অর্ডাররা,অধিনায়কের দেয়া সেই কথা রাখেননি অনূর্ধ্ব-১৯ দলের টপ অর্ডাররা। বরং প্রথম রাউন্ডের রেসিপি মেনেই খেলেছে বাংলাদেশ যুবারা এই ম্যাচ। কোয়ার্টার ফাইনালের বাধা পেরিয়ে সে সরল স্বীকারোক্তি মিরাজেরÑ‘আমাদের পরিকল্পনাই থাকে ১০-১৫ ওভারে বেশি শট খেলব না। ধরে খেলব। এভাবেই চলছে। সামনের ম্যাচগুলোয় আশা করি ভালো হবে।’
অধিনায়ক মিরাজ নিজেও হারিয়েছেন মনোযোগ, জয়ের খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে স্ট্যাম্পিংয়ের সুযোগ পর্যন্ত দিয়েছিলেন। মিরাজ নিজেই সেই ভুলের কথা স্বীকার করেছেনÑ‘ওই সময় মনোযোগ একটু হারিয়ে ফেলেছিলাম। মিড অফ সামনে ছিল, চেষ্টা করছিলাম বেরিয়ে মারার জন্য। পরে যখন স্টাম্পিং টা মিস হলো, তখন জাকির আমাকে এসে বোঝায় যে এখনও রিল্যাক্সড হওয়ার কিছু নেই। এরপর আর সমস্যা হয়নি।’
ব্যাটিং ফ্রেন্ডলি উইকেটে নেপালকে ২১১’র মধ্যে আটকে ফেলায় ম্যাচ জয়ে সহায়ক হয়েছে বলে মনে করছেন মিরাজÑ‘নেপাল কিন্তু প্রথম দিকে অনেক রান করেছে, আমাদের বোলাররা ভালো বোলিং করে ওদের রান কমে আটকে রেখেছে। এটা ছিল ২৭০-২৮০ রানের উইকেট। আমাদের বোলাররা ভালো করে ওদের কমে আটকে রেখেছে। শান্তর দারুণ ফিল্ডিংয়ে একটি রান আউট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ওরপর থেকেই আমরা কামব্যাক করতে পেরেছি। ওদের অধিনায়কের রান আউট টার্নিং পয়েন্ট ছিল। জবাব দিতে এসে শুরুতে আমাদের উইকেট পড়ে যাওয়ায় একটু সমস্যা হয়েছে। কিন্তু আমি আর জাকির সেট হওয়ার পর কিন্তু ভালো ব্যাট করেছি। সমস্যা মনে হয়নি।’
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন