দৃশ্যটি রোমহর্ষক। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, পরিকল্পিতভাবে মারতে মারতে সিনিয়র এএসপি আনিসুল করিমকে মাটিতে ফেলে দেয়া হয়েছে। দুই-চার মিনিটের মধ্যেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। যেন চলচ্চিত্রের সুপরিকল্পিত হত্যাকান্ডের দৃশ্য! ঘটনাস্থলটিও যেন হাসপাতাল নয়, মনে হয় মৃত্যুকূপ। টর্চার সেলের মতো একটি কুঠুরী। যেখানে দিনে-দুপুরে হত্যাকান্ডটি ঘটলো। খোদ পুলিশের একজন সিনিয়র এএসপিকে চিকিৎসার নামে দলবদ্ধভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। রাজধানীর আদাবরের মাইন্ড এইড হাসপাতালের কোনো অনুমতি ছিল না। কেমন করে এসব জঘন্য অন্যায় করা সম্ভব হচ্ছে? কোনো অনুমতি বা প্রয়োজনীয় সনদ ছাড়াই হাসপাতাল খুলে বসা যাচ্ছে। চিকিৎসার নামে ভুয়া সনদ, নকল সরঞ্জাম দিয়ে মানুষের জীবনকে বিপন্ন করা যাচ্ছে। এমনকি, ইচ্ছা হলে পিটিয়ে মেরেও ফেলতে পারছে। কেমন করে এসব সম্ভব হচ্ছে, তা এক বিরাট প্রশ্ন।
অন্যদিকে হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত ১০ জনকে গ্রেফতারের পর ৭ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। সিনিয়র এএসপি আনিসুল করিম শিপনের মৃত্যুর ঘটনায় তার বাবা ফয়েজ উদ্দিন বাদী হয়ে আদাবর থানায় একটি হত্যা মামলা করেছেন। গতকাল বিকেলে আদাবরের মাইন্ড এইড হাসপাতালে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে পুলিশ। আনিসুল করিমের ভাই রেজাউল করিম জানান, গত সোমবার সকালে আদাবরের ওই হাসপাতালে যাওয়ার পর একটি রুমে বসে নাস্তা খান এএসপি আনিসুল করিম। কিছুক্ষণ পর তিনি ওয়াশরুমে যেতে চাইলে বেলা আনুমানিক পৌনে ১২টার দিকে হাসপাতালের মার্কেটিং ম্যানেজার আরিফ মাহমুদ জয় তাকে দ্বিতীয় তলায় নিয়ে যান। এ সময় এএসপি আনিসুল করিমের সঙ্গে তার বোন উম্মে সালমা ওপরে যেতে চাইলে আরিফ ও রেদোয়ান সাব্বির তাকে বাধা দিয়ে দ্বিতীয় তলার কলাপসিবল গেট আটকে দেন। বেলা ১২টার দিকে আরিফ মাহমুদ নিচে এসে তার বোনকে উপরে যাওয়ার জন্য ডাক দেন। এরপর তার বোনসহ পরিবারের সদস্যরা উপরে গিয়ে একটি কক্ষের মেঝেতে আনিসুল করিমকে নিস্তেজ অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন। এরপর পরিবারের সদস্যরা আনিসুল করিমকে উদ্ধার করে অ্যাম্বুলেন্স যোগে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক ১২টা ৫৮ মিনিটে তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
পরবর্তীতে হাসপাতালের সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, পৌনে ১২টার দিকে হাসপাতালের কয়েকজন স্টাফ আনিসুল করিমকে মারতে মারতে দ্বিতীয় তলার একটি কক্ষে নিয়ে যান। তাকে কক্ষের মেঝেতে জোরপূর্বক উপুড় করে ফেলে ৩ থেকে ৪ জন হাঁটু দিয়ে পিঠের উপর চেপে বসেন। কয়েকজন পিঠমোড়া করে একটি ওড়না দিয়ে তার দুই হাত বেঁধে ফেলেন। কয়েকজন কনুই দিয়ে এএসপি আনিসুল করিমের ঘাড়ে ও মাথায় আঘাত করতে থাকেন। একজন তার মাথার উপরে চেপে বসেন এবং সবাই মিলে তাকে উপর্যুপরি মারধর করতে থাকেন। একপর্যায়ে ১২টার দিকে তিনি নিস্তেজ হয়ে পড়েন।
ঢাকা জেলার সিভিল সার্জন মঈনুল আহসান সাংবাদিকদের বলেন, হাসপাতালটি অনুমোদন চেয়ে আবেদন করেছিল। কিন্তু অনুমোদন দেয়া হয়নি। তাই এটা কোনো হাসপাতালই না।
তবে হাসপাতালের সহকারী ম্যানেজার আল আমিনের দাবি, উশৃঙ্খল আচরণ করায় হাসপাতালের কর্মচারীরা পুলিশ কর্মকর্তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছিলেন। এরই মধ্যেই কী থেকে কী হয়ে গেল, বুঝা মুশকিল।
ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের ডিসি হারুন অর রশীদ বলেন, পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে এখন পর্যন্ত হাসপাতালটির কোনো বৈধ কাগজপত্র পাওয়া যায়নি। তাই অবৈধ হাসপাতালটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ স্বাস্থ্য অধিদফতরের কোনো অনুমতি আছে তা দেখাতে পারেনি। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কোনো লাইসেন্স নেই। একটি মানসিক হাসপাতাল চালানোর জন্য যা যা দরকার তার কোনো কিছু দেখাতে পারেনি। হাসপাতালে কোনো ডাক্তার নেই। ওয়ার্ড বয়, কো-অর্ডিনেটর ও ম্যানেজার মিলেই ডাক্তারের কাজ করে সেখানে। অন্যান্য যারা কাজ করেন তারাও কেউ উচ্চ শিক্ষিত নন। তাহলে কীভাবে একটি হাসপাতাল চলতে পারে। তাই আমাদের কাছে মনে হয়েছে এটি স্পষ্ট হত্যাকান্ড।
হারুন বলেন, কীভাবে একজন মানুষকে সবাই মিলে হত্যা করল। এভাবেই তারা মানুষকে ধরে বেধে চিকিৎসার নামে টাকা হাতিয়ে থাকে। সিনিয়র এএসপি আনিসুলকে হত্যার পাশাপাশি আরও যাদের হয়রানি করেছে তাদেরও তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। এক প্রশ্নের জবাবে ডিসি বলেন, যেহেতু এটি একটি হত্যাকান্ড তাই হত্যা মামলা রুজ্জু করা হয়েছে।
জানতে চাইলে শেরেবাংলা নগর থানার ওসি জানে আলম মুন্সি বলেন, হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের খাতায় লেখা রয়েছে ‘ব্রট ডেড’, অর্থাৎ হাসপাতালে নিয়ে আসার আগেই আনিসুলের মৃত্যু হয়েছিল। আনিসুল করিম ৩১তম বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে পুলিশ ক্যাডারে যোগ দেন। সবশেষ তিনি বরিশাল মহানগর পুলিশে কর্মরত ছিলেন। তার বাড়ি গাজীপুরের কাপাসিয়ায়। তিনি এক সন্তানের জনক। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের ৩৩ ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন।
১০ আসামি ৭ দিনের রিমান্ডে
মানসিক হাসপাতালে পুলিশের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) আনিসুল করিমকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় ১০ আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে ৭ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। গতকাল মঙ্গলবার শুনানি শেষে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট শহিদুল ইসলাম এ আদেশ দেন। এদিন মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা আদাবর থানার পুলিশ পরিদর্শক মো. ফারুক মোল্লা আসামিদের আদালতে হাজির করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন। আবেদনের শুনানি নিয়ে বিচারক এ আদেশ দেন। রিমান্ডে যাওয়া আসামিরা হলেন-মাইন্ড এইড হাসপাতালের মার্কেটিং ম্যানেজার আরিফ মাহমুদ জয়, কো-অর্ডিনেটর রেদোয়ান সাব্বির, কিচেন সেফ মাসুদ, ওয়ার্ড বয় জোবায়ের হোসেন, তানিফ মোল্লা, সজীব চৌধুরী, অসীম চন্দ্র পাল, লিটন আহাম্মদ, সাইফুল ইসলাম পলাশ ও ফার্মাসিস্ট তানভীর হাসান।
শোকের ছায়া কর্মস্থলে
বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের (বিএমপি) ট্রাফিক বিভাগের সহকারী কমিশনার মোহাম্মদ আনিসুল করিমের মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে তার কর্মস্থলে। তার কর্মস্থলে থাকা কক্ষটি এখন ফাঁকাই পড়ে রয়েছে। তবে সেখান রয়েছে তার স্মৃতি বিজরতি চেয়ার-টেবিল, টেলিফোন ও ফাইলপত্র। আনিসুল করিম একজন সৎ, নিষ্ঠাবান ও মেধাবী অফিসার ছিলেন বলে জানিয়েছেন সহকর্মীরা। পাশাপাশি সৌহার্দ্যপূর্ণ ও ভালো আচরণ বজায় রাখতেন বলেও জানান তারা। তার এভাবে মৃত্যু যেমন সহকর্মীদের মানতে কষ্ট হচ্ছে, তেমনি পুলিশের এই মেধাবী কর্মকর্তার মৃত্যুর ঘটনায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিও করেছেন সহকর্মীরা।
বিএমপি’র ট্রাফিক বিভাগের পরিদর্শক মো. আব্দুর রহিম জানান, সহকারী কমিশনার আনিসুল করিম একজন নিষ্ঠাবান, সৎ ও দায়িত্বশীল কর্মকর্তা হিসেবে সবার কাছে পরিচিত ছিলেন। সহকর্মীদের সঙ্গেও তার খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। আর তাই পুলিশের এই কর্মকর্তার অস্বাভাবিক এ মৃত্যু কোনভাবেই মেনে নিতে পারছে না।
ডিসি জাকির হোসেন জানান, সহকারী কমিশনার আনিসুল করিমের সঙ্গে সবার ভালো সম্পর্ক ছিল। তিনি যেমন সকলের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছেন। তেমনি দায়িত্বে প্রফেশনাল ও সৎ ছিলেন। ৯ নভেম্বর থেকে তিনি ১০ দিনের ছুটিতে যাওয়ার আগের দিন ৮ নভেম্বরও নিজ কর্মস্থলে নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৩ সালের ১৫ জানুয়ারি পুলিশ বিভাগে যোগদান করেন মোহাম্মদ আনিসুল করিম। এরপর বিভিন্ন স্থানে দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে গত ৭ সেপ্টেম্বর বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশে যোগা দেন। এক সন্তানের জনক হয়ে পরিবার নিয়ে তিনি কর্মস্থলেই বসবাস করতেন।
বিচার দাবিতে হাসপাতালের সামনে মানববন্ধন
আদাবরের মাইন্ড এইড হাসপাতালের সামনে মানববন্ধন করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষার্থী। তাদের অভিযোগ, এই হাসপাতালে জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) আনিসুল করিমকে হত্যা করা হয়েছে। তারা এই ঘটনার দ্রুত বিচার দাবি করেছেন। আনিসুল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র। মাইন্ড এইড হাসপাতালটি আদাবরের বায়তুল আমান হাউজিংয়ের ২ নম্বর রোডের ২৫১ নম্বর বাড়িতে অবস্থিত। হাসপাতালটির সামনে গতকাল বেলা পৌনে দুইটার দিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ২৫ জন প্রাক্তন-বর্তমান শিক্ষার্থী জড়ো হন। তারা সেখানে মানববন্ধন করেন।
প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা: আল্লাহ আমাকে বাঁচান
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, এএসপি আনিসুল করিম বেশ ভদ্রভাবে হেঁটে উপরে আসেন। তিনি কোনো ধরনের উশৃঙ্খল আচরণ করেননি। হেঁটে আসার সময় কারো সঙ্গে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ও করেননি। দ্বিতীয় তলায় আসার পর কিছু বুঝে উঠার আগেই তাকে মারধর শুরু করে একটি ছোট কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়।
দ্বিতীয় তলাতে ২০ দিন ধরে চিকিৎসাসেবা নিচ্ছিলেন কক্সবাজারের বাসিন্দা আরিফুল হক চৌধুরী নামে একজন। তিনি জানান, যখন এএসপি আনিসুল করিমকে উপরে নিয়ে আসেন তখন তিনি বসা ছিলেন। আনিসুল করিমের হাতে একটি জুসের বোতল ছিলো। এসময় ৭ থেকে ৮ জন মিলে তার সঙ্গে কথা বলার একপর্যায়ে তাকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে টেনে-হিঁচড়ে একটি ছোট কক্ষে নিয়ে যান।
তিনি বলেন, পুরো ঘটনাই আমি জানালা দিয়ে দেখছিলাম। যখন তাকে টেনে ওই রুমে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তিনি যেতে চাচ্ছিলেন না। তাকে টেনে-ধাক্কা দিয়ে উপুড় করে ফেলে দেয়া হলে তিনি চিৎকার করে বলছিলেন ‘আল্লাহ আমাকে বাঁচান’। এর মধ্যে তার দুই হাত ওড়না দিয়ে পেছন দিকে বেঁধে ফেলা হয়। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এএসপি আনিসুল করিম কাউকে মারধর করবেন কেন, তিনিতো কোন সুযোগই পাননি। তিনি কোনো উশৃঙ্খল আচরণও করেননি। কারো সঙ্গে খারাপ আচরণ করেননি। তিনি শুধু বলছিলেন আপনারা আমাকে কেন নিয়ে যাচ্ছেন। তিনি ভেতরে যেতে চাচ্ছিলেন না, তাই জোর করে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়।
হাসপাতালের পরিচালক গ্রেফতার
সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) আনিসুল করিমের হত্যা মামলায় মাইন্ড এইড হাসপাতালের পরিচালক নিয়াজ মোর্শেদকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৫টার দিকে রাজধানীর নিউরো সাইন্স হাসপাতাল এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। এ নিয়ে ঘটনার দুই দিনের মাথায় মোট ১১ জনকে গ্রেফতার করা হলো।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন