সড়কে আবারও মৃত্যুর মিছিল। প্রতিদিনই ঝরছে অসংখ্য তাজা প্রাণ। কোনোভাবেই সড়ক দুর্ঘটনায় লাগাম টানা যাচ্ছে না। শিক্ষার্থীদের একক আন্দোলনের মুখে নতুন সড়ক আইন করা হলেও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। উল্টো দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ও মৃত্যু দুটোই আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। বিদায়ী ২০২২ সালে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৮৭৬ জন শিক্ষার্থী। অর্থাৎ সড়ক দুর্ঘটনায় গত বছর যতো মানুষের মৃত্যু হয়েছে, তাদের ১৪ শতাংশই শিক্ষার্থী। সড়ক দুর্ঘটনায় এমন মৃত্যুকে হত্যা বলে মনে করছেন সড়ক পরিবহণ বিশেষজ্ঞরা।
অন্যদিকে রাজধানীর যমুনা ফিউচার পার্ক এলাকায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নর্দান ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী নাদিয়ার সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুতে দ্বিতীয় দিনের মতো দক্ষিণ কাওলায় সড়ক অবরোধ করে শিক্ষার্থীরা। সড়ক অবরোধ কর্মসূচিতে চার দফা দাবি ঘোষণা করে সড়ক থেকে অবরোধ তুলে নেন শিক্ষার্থীরা। গতকাল সোমবার দুপুর পৌনে ২টার দিকে পুলিশের আশ্বাসে সড়ক থেকে অবরোধ কর্মসূচি তুলে নেন তারা।
সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের দায়িত্বহীনতা ও অব্যবস্থাপনার কারণে সড়কে মৃত্যু কমছে না। অথচ সরকার এর দায় নিচ্ছে না। পরিবহণ খাতের দুর্নীতি, চাঁদাবাজি ও নৈরাজ্য বন্ধ করতে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা বাস্তবে কতটা রয়েছে, সে প্রশ্নও তুলেছেন তারা। সড়ক দুর্ঘটনার সমস্যাটি রাজনৈতিক। কারিগরিভাবে এ সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। যারা সড়কে বিশৃঙ্খলার সুবিধাভোগী, তারাই নীতিনির্ধারণী বিভিন্ন কমিটিতে বসে আছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের একজন শিক্ষক সোমবার ইনকিলাবকে বলেন, সড়ক দুর্ঘটনার অনেক তথ্য পত্রপত্রিকায় আসে না। গণমাধ্যমে যে পরিমাণ তথ্য প্রকাশিত হয়, প্রকৃত দুর্ঘটনা তার চেয়ে চার বা পাঁচ গুণ বেশি। সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে শুধু কমিটি গঠনে বেশি মনোযোগ না দিয়ে এবং সুপারিশ করার চক্র থেকে বেরিয়ে আসতে হবে সরকারকে। এসবের চেয়ে বেশি জরুরি জনবান্ধব পরিবহণ কৌশল প্রণয়ন করা।
দুর্ঘটনার পেছনের কারণ : গত বছর যত দুর্ঘটনা, তার ৬২ শতাংশের কারণ যানবাহনের বেপরোয়া গতি। এ ছাড়া চালকদের অদক্ষতা, মহাসড়কে স্বল্প গতির যানবাহনের চলাচল, ফুটপাত হকারের দখলে থাকা, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, সরকারি সংস্থা বিআরটিএর সক্ষমতার ঘাটতি, গণপরিবহণ খাতে চাঁদাবাজি এবং সড়ক ব্যবহারকারীদের মধ্যে অসচেতনতার কারণে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটেছে। সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে সড়ক পরিবহণ আইন-২০১৮ সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন করা, গণপরিবহণে চাঁদাবাজি বন্ধ, দক্ষ চালক তৈরি, চালকের বেতন ও কর্মঘণ্টা নির্ধারণ, বিআরটিএর সক্ষমতা বৃদ্ধি, মহাসড়কে স্বল্প গতির যানবাহন চলাচলের জন্য সার্ভিস রোড নির্মাণ করাসহ বেশ কিছু সুপারিশ করেছেন পরিবহণ বিশেষজ্ঞরা।
নিরাপদ সড়ক নিয়ে কাজ করছেন কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ। তিনি বলেন, দুর্ঘটনার পর সঠিক তদন্ত ও বিচার না হওয়ার কারণেই সড়ক দুর্ঘটনা কমছে না। দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সব সড়কে সিসি ক্যামেরা স্থাপনসহ আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তা নিতে হবে। প্রযুক্তির মাধ্যমে দুর্ঘটনার কারণ চিহ্নিত করতে হবে। দ্রæত তদন্ত শেষ করে দোষীদের আইনের আওতায় আনতে হবে। দোষী ব্যক্তির শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে অন্যরাও সচেতন হবে। আর এর ফলে সড়ক দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর হার কমবে। জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের ১১১টি সুপারিশ বাস্তবায়নেরও তাগিদ দেন এই তিনি। এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন হলে সড়কে দুর্ঘটনা কমে আসবে বলে তিনি মনে করেন।
ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) মো: মুনিবুর রহমান ইনকিলাবকে বলেন, সড়ক দুঘর্টনা কমিয়ে আনতে হলে চালকদের সঠিক প্রশিক্ষণ ও ট্রাফিক আইন সম্পর্কে জ্ঞান থাকতে হবে। একই সাথে পথচারীসহ সবাইকে সড়কে চলাচলের সময় সচেতন হতে হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা প্রতিনিয়ত যানবাহন মালিক ও চালক-হেলপারদের সাথে সড়কের আইনসহ সার্বিক বিষয় নিয়ে মতবিনিময় করে থাকি। একই সাথে বেপরোয়া গাড়ি চালনোর বিষয়েও সচেতন করা হয়। তাছাড়া ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের সাথে সম্পৃক্ত পুলিশ কর্মকর্তাদের সড়ক দুঘর্টনা প্রতিরোধ এবং রাস্তায় যানবাহনের শৃঙ্খলা বজায় রেখে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়।
চার দফা দাবি ঘোষণা শিক্ষার্থীদের :
আন্দোলনরত নর্দান ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী আশরাফ জাহিদ বলেন, আমাদের বোন মারা গেছে, একজন শিক্ষার্থী মারা গেছে; কিন্তু এ বিষয়ে কারো কোনো দায়িত্ব নেই? আমাদের ৪ দফা দাবি মানতে হবে। নয়তো আবারও সড়ক অবরোধে নামবে শিক্ষার্থীরা।
তিনি বলেন, আগামী ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় দেয়া হলো। এর মধ্যে আমাদের ঘোষিত চার দফা দাবির বাস্তবায়ন দেখতে চাই। এই সময়ের মধ্যে আমাদের দাবি পূরণ না হলে আবারও সড়কে নামতে বাধ্য হবো। ভিক্টর ক্লাসিকের কোনো বাস সড়কে চলতে পারবে না। সোমবার থেকেই ভিক্টির ক্লাসিকের বাস চলাচল রুট পারমিট বন্ধ করতে হবে। যদি আবারও ভিক্টর ক্লাসিকের কোনো বাস সড়কে চলাচল করে তবে আমরা সঙ্গে সঙ্গে সড়কে নামতে বাধ্য হবো।
শিক্ষার্থীদের দাবির বিষয়ে ডিএমপির উত্তরা বিভাগের ডিসি মো. মোর্শেদ আলম বলেন, শিক্ষার্থীদের একটি দাবি ছিল বাসচালক ও হেলপার গ্রেফতার করা। তাদের পুলিশ গ্রেফতার করেছে। শিক্ষার্থীরা দাবি জানিয়েছেন ভিক্টর ক্লাসিক বাসের রুট পারমিট বাতিল ও এই পরিবহণের বাস যেন সড়কে না চলে। ভিক্টর ক্লাসিক পরিবহণের বাস যেন সড়কে না চলে, সে বিষয়ে আমরা আজ থেকে ব্যবস্থা গ্রহণ করছি। এছাড়া রুট পারমিট বাতিলের বিষয়টি একটু সময়ের ব্যাপার।
তিনি বলেন, শিক্ষার্থীরা আরও দাবি জানিয়েছে ভুক্তভোগী নাদিয়ার পরিবারকে ক্ষতিপূরণ ও কাওলা এলাকায় নাদিয়ার নামে একটি বাস স্টপেজ করা। ক্ষতিপূরণের বিষয়ে পরিবারের সঙ্গে আমরা কথা বলব। এছাড়া ভিক্টর ক্লাসিক পরিবহণের কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও এ বিষয়ে কথা বলব। আর স্টপেজ নির্মাণের বিষয়টি সিটি করপোরেশন দেখবে। রোববার ভাটারা এলাকায় ভিক্টর পরিবহণের একটি বাসের চাপায় নাদিয়া নামে এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী নিহত হন। এ ঘটনার প্রতিবাদে দক্ষিণখান কাওলা এলাকার সড়কে শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ ও মিছিল করেন। নিহত নাদিয়া নর্দান ইউনিভার্সিটির ফার্মেসি বিভাগের প্রথম সেমিস্টারের ছাত্রী।
চালক-হেলপার গ্রেফতার : বাসচাপায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী নাদিয়ার মৃত্যুর ঘটনায় বাসচালক ও হেলপারকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। সোমবার সকালে এই দু’জনকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার দু’জন হলোÑ ভিক্টর পরিবহণের বাসচালক মো. লিটন (৩৮) ও হেলপার মো. আবুল খায়ের (২২)। বাসচালক ও তার সহকারীকে দুই দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছেন আদালত। সোমবার বিকেলে শুনানি শেষে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ মোস্তফা রেজা নূরের আদালত এই আদেশ দেন।
ডিএমপির গুলশান বিভাগের ডিসি মো. আ. আহাদ জানান, দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ঘটনায় ভাটারা থানার মামলা দায়েরের পর অভিযানে নামে পুলিশ। এসময় বাস চালক ও তার সহকারীকে গ্রেফতার করা হয়। এছাড়া ভিক্টর পরিবহণের ঘাতক বাসটি (ঢাকা মেট্রো ব ১৫-৩১৯০) জব্দ করা হয়েছে। এর আগে, এ ঘটনায় বাদী হয়ে মামলা করেন নাদিয়ার বাবা জাহাঙ্গীর আলম। সড়ক পরিবহণ আইনে ভাটারা থানায় মামলা করেন তিনি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন