বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সাহিত্য

কবিতার কতিপয় অপরিহার্য অনুষঙ্গ

প্রকাশের সময় : ১৯ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১:১৮ এএম, ১৯ আগস্ট, ২০১৬

ফাতিমা আলী
কবিতার অনুষঙ্গ আলোচনার পূর্বে কবিতা কী এটি নিয়ে সামান্য আলোকপাত করা প্রাসঙ্গিক। মানুষের অন্তরের চিন্তা-চেতনা যখন ভাবানুভূতির বর্ণবৈচিত্র্যে যথোপযুক্ত শব্দবিন্যাসে সুবিন্যস্ত চিত্রে ও ছন্দিত বিন্যাসে উপস্থাপিত হয় তখনই সে হ’য়ে ওঠে কবিতা। ডড়ৎফংড়িৎঃয-ভাষায়, ‘চড়বঃৎু রং ঃযব ংঢ়ড়হঃধহবড়ঁং ড়াবৎভষড়ি ড়ভ ঢ়ড়বিৎভঁষ ভববষরহমং.’ এদেশের কবিদের মধ্যে কবিতার সংজ্ঞা নিয়ে মতপার্থক্য আছে। জগন্নাথ বলেন, ‘যে শব্দ রমণীয় অর্থের প্রতিপাদক, তাহাই কাব্য’ (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা : ১১)। শ্রীশচন্দ্র দাশ বলেন, ‘অসংখ্য শব্দ যখন কবির লেখনীÑ  মুখে ভিড় করিয়া আসে, তন্মধ্যে একটিমাত্র যথাযথ শব্দই কবিতায় ব্যবহারোপযোগী অপরিহার্য শব্দ; এই জাতীয় শব্দ লেখকের কল্পনা বা অনুভূতি-¯িœগ্ধ হইতে স্বতঃউৎসারিত বলিয়া ভাব প্রকাশের পক্ষে ইহা একান্ত উপযোগী’ (সাহিত্য-সন্দর্শন, পৃষ্ঠা : ২৯)। ঈড়ষৎরফমব বলেছেন, ‘নবংঃ ড়িৎফং রহ ঃযব নবংঃ ড়ৎফবৎ’। মেকলে বলেছেন, ‘কবিতা হচ্ছে সেই রচনা যেখানে শব্দ এমনভাবে ব্যবহৃত হয়, যাতে পাঠকের কল্পলোকে ঐ শব্দ একটি চিত্রিত সৌন্দর্যের বিশ্ব উন্মুক্ত করে দিতে পারে (বাংলা সাহিত্যের নানারূপ, পৃষ্ঠা : ৬৯)। বস্তুত মানুষের বিশেষ ও তীক্ষè ভাবানুভূতি বা ওসধমরহধঃরড়হ-ই কবিতা সৃষ্টির মূল উপাদান। অনেক কবিই একমত যে কবিতার মূল উপজীব্য বুদ্ধি বা হৃদয় নয়, তার শক্তিশালী কল্পনা, ভাব-বিলাসিতা বা তার চিত্রকল্প। কবিতা কখনও এতই বলিষ্ঠ হয়ে ওঠে যে, তার ভাবানুভূতি কবিতার পশ্চাতে সর্বাধিক মুখ্য ও দীপ্রভাবে ক্রিয়া করে। শরতের আকাশ কবিকে প্রেমিকা, নদী এবং কাশফুলের কল্পলোকে বিচরণ করাতে সক্ষম। একজন সার্থক কবি প্রচ- রকমের কল্পনাবিলাসী হন। আধুনিক কবি তিনি যিনি, ‘বিশিষ্ট কবি-প্রতিভা বিশিষ্ট কল্পনাবলে বিশিষ্ট সাহিত্যরূপ সৃষ্টি করেন। অর্থাৎ বিষয়বস্তুকে পরিবেশন করিবার কবিদৃষ্টি বিশেষভাবেই বিশেষ হইয়াই নির্বিশেষ। সাহিত্যে কাব্যের বিষয়বস্তু অপেক্ষা উহার বিশিষ্ট রূপসাধনাই অধিকতর গৌরবের দাবি করিতে পারে, (সাহিত্য-সন্দর্শন, শ্রীশচন্দ্র দাশ, পৃষ্ঠা : ৩২)। এই বিশিষ্ট রূপদান শুধুমাত্র কবির কল্পনা শক্তির দ্বারাই সম্ভবপর। এটিই হচ্ছে ঈৎবধঃরাব রসধমরহধঃরড়হ.        
একটি কবিতার পিছনে থাকে তার সততা ও শুদ্ধতা। তাকে ভাব ও ভাষার আশ্রয় নিতে হয়। কবিতা শব্দাশ্রয়ী হলেও তাকে সালংকারা না দেখলে যেন কিছুটা নিরাভরণ বা সাদাসিধে মনেই হতে পারে। এ ছাড়া আধুনিক কবিতায় পাঠক একটি ন্যূনতম চিত্রকল্প আশা করেন। এ ছাড়া কবিতাকে ছন্দাশ্রয়ীও হতে হবে। কবিতা হচ্ছে কবির নিজস্ব এক সুশৃঙ্খল ভাবনার অভিব্যক্তি। তাই তা সর্বদাই ছন্দোবদ্ধ, ব্যঞ্জনাম-িত ও প্রয়োজনীয় শব্দের বাহক। হয়তো এ জন্যই ডড়ৎফংড়িৎঃয বলেছেন, কবিতা ‘ঃধশবং রঃং ড়ৎরমরহ ভৎড়স বসড়ঃরড়হ ৎবপড়ষষবপঃবফ ঃৎধহয়ঁরঃরষরঃু.
কবিতার ক্ষেত্রে কেউ এর ভাষা আবার কেউ কেউ এর বিষয়বস্তুকে প্রাধান্য দিয়েছেন। তবে কবিতার ভাষা ও বিষয়বস্তু দুটিরই যথেষ্ট গুরুত্ব আছে। নচেৎ কবিতার শরীর দুর্বল হতে বাধ্য। ফরাসি কবি স্তেফান মালার্মে (ঝঃবঢ়যধহব গধষষধৎসব) এই ধারণার অনুসারী। আমাদের মুখনিসৃত ভাষা ও গদ্যের ভাষা এ দুটির ভাষা থেকে পৃথক। কবিতা ছন্দোবদ্ধ বলেই আমাদের মুখ নিসৃত কথ্য বা চলিত ভাষার সঙ্গে এর একটা পৃথক বৈশিষ্ট্য আছে। কবিতা অনেকেই গদ্যের মতো বড় কলেবরে লেখেন। তবু এটি কবিতাই, কারণ এর ছন্দ কবিতার মতোই। তবে অন্তমিলের কবিতা এভাবে লেখা সম্ভব না। কবিতার প্রবাহমানতা বা গদ্য ছন্দের জন্যই তা সম্ভবপর। এ ছাড়া কবি যা লেখেন সেটুকুই কবিতা নয়। এর মধ্যে থাকতে পারে কিছু অনুক্ত বক্তব্য। এটাই আধুনিক কবিতার বিশেষ বৈশিষ্ট্য। ফলে ‘শব্দের প্রয়োগমূল্যের চেয়েও কবিতায় ব্যবহৃত শব্দের অর্থব্যঞ্জনার মূল্য অনেক বেশি।’ (কবিতা ও প্রসঙ্গ কথা, মাহফুজউল্লাহ, পৃষ্ঠা : ১৭)। গদ্য কবিতার ভাষা যে কিছুটা পৃথক এ কথা স্বয়ং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই স্বীকার করে গেছেন। তিনি সেক্ষেত্রে ‘তার’, ‘সনে’, ‘মোর’ এ জাতীয় শব্দ পরিহার করেছেন। ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে কবির স্বাধীনতা আছে। বাংলা সাধু ও চলিত ভাষার সংমিশ্রণে গদ্য দোষযুক্ত হয়। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা অপরিহার্য হতে পারে। যেমনÑ কবি জীবনানন্দ দাশ তার ‘বনলতা সেন’ কবিতায় লিখেছেন, ‘হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি, পৃথিবীর পথে’। এখানে কবি হাঁটিতেছি না লিখে যদি চলিত ভাষা হাঁটছি লিখতেন তাহলে ছন্দ পতন হতো। ছন্দের অপরিহার্যতার জন্য কবিতায় সাধু-চলিতের ব্যবহার হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। কবিতার ভাষা তাই, ‘মুখের ভাষা থেকে আলাদা, আবার গদ্যের ভাষা থেকেও বিশিষ্ট’ (গদ্যরীতি পদ্যরীতি, পবিত্র সরকার, পৃষ্ঠা : ১)। যেমন কবি জীবনানন্দ দাশের ‘আট বছর আগের এক দিন’ কবিতায় তিনি যা লিখেছিলেন তার অতিরিক্ত এক অনুক্ত কথা পাঠককে ভাবায় তাকে চিন্তার অতলে টেনে নিয়ে যায়। যেমনÑ
                                   কোনদিন জাগিবে না আর
                                   জাগিবার গাঢ় বেদনার
                                   অবিরাম---অবিরাম ভার
                                   এইকথা বলেছিল তারে
                                   চাঁদ ডুবে চলে গেলে- অদ্ভুত আঁধারে
                                   যেন তার জানালার ধারে
                                   উঠের গ্রীবার মতো কোন এক নিস্তব্ধতা এসে।
ফলে কবিতা হতে পারে প্রতিকাশ্রয়ী, রূপকাত্মক, ধ্বনিবহুল, চিত্রবহুল কিংবা সালংকরা। তিনি ‘বনলতা সেন’-এ লিখেছেন, ‘সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন সন্ধ্যা আসে’;
কবি নির্মলেন্দু গুণ তার ‘অগ্নিসঙ্গম’ কবিতায় লিখেছেন,
                     ‘আমি কীভাবে অগ্নির সঙ্গে সঙ্গম করেছিলাম, সেই গল্পটা বলি
                      ঝড়ের রাতে ঈশ্বর এসে উপস্থিত হলেন আমার ঘরে
                      আমি সারাদিনের পরিশ্রম শেষে, তক্তপোষে আরাম করে শুয়ে
                      নিজের মনে, নিজের সঙ্গেই খেলা করছিলাম আমার গাত্র
                      এবং মন উভয়ই ছিল নিরাভরণ। তিনি আমার ঘরে প্রবেশ করলেন,                     
                      একটি চমৎকার দৃষ্টিনন্দন আলোকবর্তিকার রূপ ধরে এবং
                      গায়িবি ভাষায় বললেন : আমি আপনাকে শিশু মুক্ত করতে এসেছি
                      দয়া করে আপনি দ্রুত প্রস্তুতি গ্রহণ করুন।
 কবিতা মূলত গদ্যের ছন্দিত রূপ। কবিতায় স্বরবিত্ত ছন্দ, মাত্রাবিত্ত ছন্দ, অক্ষরবিত্ত ছন্দ ছাড়াও ত্রিপদী  ছন্দ, গৈরিশ ছন্দ, মুক্তক ছন্দ এসবের মিশ্রিত বিভিন্ন ছন্দ আছে। এরপরেই গদ্য ছন্দের স্থান। মাইকেল মধুসুদন দত্ত যেমন স্বার্থক অমিত্রাক্ষর ছন্দে বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছেন, পরে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মুক্তক ছন্দ এবং গদ্য ছন্দের মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে এক ভিন্ন মাত্রা দান করেছিলেন। ‘গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদের সময় তিনি অন্তমিলের পরিবর্তে মুক্ত ছন্দ ব্যবহার করেন। এই বিষয়টিই তাকে গদ্য ছন্দ লিখতে অনুপ্রাণিত করে। গদ্য ছন্দে পর্ব সৃষ্টিতে যথেষ্ট স্বাধীনতা থাকে। পদ্যের পর্ব যতিনির্ভর বলেই তাকে ধ্বনিপর্ব বলা হয়। কিন্তু গদ্য ছন্দে আবেগ ও ভাবের ওপর নির্ভর করে পর্ব তৈরি হয়। যেজন্য একে অর্থপর্ব বা ভাবপর্ব বলা হয়ে থাকে। যেমন কবি আল মাহমুদ তার শিল্পের ফলক কবিতায় লিখেছেন,
                       ‘আবার পুরোনো দৃশ্যে ফিরে গিয়ে দেখি;
                       সমস্ত বোতাম খোলা, শিশুর মুখের কাছে
                       ফলভারে সুঠাম কামনা। শিয়রে রেহেল রাখা
                       আল্লাহর আদেশ।’
ভাব, ভাষা বা ছন্দের পর এর চিত্রকল্প নিয়ে আলোচনা করা যাক। এর আবিষ্কারক কে ছিলেন তা নিয়ে মতানৈক্য রয়েছে। ডা. শ্যামকুমার ঘোষ, বুদ্ধদেব বসু প্রমুখ লেখকবৃন্দ মনে করেন, শব্দটির প্রথম উদগাতা কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। তবে কবিতায় চিত্রকল্প থাকাটা অত্যাবশ্যক নয়। চিত্রকল্পবিহীন বহু কবিতাও জনপ্রিয়তা লাভ করেছে ইংরেজি শুদ্ধ ‘ওসধমব’কে বাংলায় চিত্রকল্প আখ্যায়িত করা হয়েছে। সিসিল লে লুইস বলেছেন, ‘ওসধমব রং হড়ঃযরহম নঁঃ ধ ঢ়রপঃঁৎব সধফব ড়ঁঃ ড়ভ ড়িৎফং’. তবে আধুকিক কবি ও সমালোচকবৃন্দ কবিতায় ‘চিত্রকল্প’কে সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণই না, আবশ্যিকও মনে করেন। এই ‘চিত্রকল্প’ শব্দ বলতে আমরা কী বুঝি? খুব সাধারণ ভাষায় বলা যায়, কবিতায় শব্দবিন্যাসের প্যাটার্ন বা আকারকে ‘চিত্রকল্প’ বলা হয়। অর্থাৎ কবির ভাবানুতির চিত্রই ‘চিত্রকল্প’। ড. জীবন্ত্র সিংহ রায় এ প্রসঙ্গে খুব চমৎকার সংজ্ঞা দিয়েছেন, ‘যদি কোনো অলংকারের মধ্যবর্তিতায় বা অন্য কোনো ধরনের তুলনায় সূত্রে একটি চিত্র থেকে অধিক দূরসঞ্চারী ও গূঢ়গম্ভীর আরেকটি চিত্র পাওয়া যায় তবে তাকেই বলে চিত্রকল্প। কবি জীবনানন্দ দাশ তার ‘ঘাস’ কবিতায় লিখেছেন,
                            এই ঘাসের শরীর ছানি-চোখে চোখ ঘষি
                            ঘাসের পাখনায় আমার পাজক,
                            ঘাসের ভিতরে ঘাস হয়ে জন্মাই কোনো এক নিবিড় ঘাস মাতার
                            শরীরের সুস্বাদ অন্ধকার থেকে নেমে।’
কবি ঊুৎধ চড়ঁহফ-এর ভাষায়, ‘অহ রসধমব রং ঃযধঃ যিরপয ঢ়ৎবংবহঃং ধহ রহঃবষষবপঃঁধষ ধহফ বসড়ঃরড়হধষ পড়সঢ়ষবী রহ ধহ রহংঃধহঃ ড়ভ ঃরসব.’ ফলে একথা বলা যায় যে, উপমা যদি একটি মাত্র গুণ অথবা শব্দের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকে, ‘চিত্রকল্প’ সেখানে সবটুকু অভিজ্ঞতা বা বিষয়বস্তুকে তুলে নিয়ে আসে। চিত্রকল্প দুই ধরনের হয়ে থাকে। যে চিত্রকল্প উপমা-উৎপ্রেক্ষার সংযোগে পরিস্ফুট হয়ে ওঠে তাকে বলা হয় প্রত্যক্ষ চিত্রকল্প। যেমনÑ ‘মুখখানি তার ঢলঢল ঢলেই যেত পড়ে/ রাঙা ঠোঁটের লাল বাঁধনে না রাখলে তায় ধরে।’ অন্যদিকে যে চিত্রকল্প কবিতার শরীরে গুপ্ত থাকে, পাঠক যখন বিষয়টি অনুধাবন করে পুলকিত হন তাকেই পরোক্ষ চিত্রকল্প বলে। যেমন,
                     শিশির শরীর ছুঁয়ে সমুজ্জ্বল ভোরে
                     দেখেছি যা হল হবে মানুষের যা হবার নয়---
                     শাশ্বত রাত্রির বুকে সকলি সূর্যোদয়।
এখানে ‘দেখেছি যা হল হবে মানুষের যা হবার নয়’ বক্তব্যে কবি যা প্রকাশ করেছেন তার বাইরেও অনুক্ত কথা আছে। যা পাঠককে ভাবায় এবং বিষয়টি অনুধাবন করতে পারলে এক অনাস্বাদিত পুলক অনুভব করে।
কবিতার আরও একটি অনুষঙ্গ এর অলংকার। লেখক হাবিব রহমান তার ‘বাংলা ছন্দ ও অলংকার’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘সংস্কৃত “অলম” থেকে অলংকার শব্দটির জন্ম। অলম শব্দের একটি অর্থ হলো ভূষণ। কাজেই যা দিয়ে ভূষণ করা হয় তাই-ই অলংকার।’ সাহিত্যে অলংকারের ব্যবহার বহু আগে থেকেই হয়ে আসছে। প্রাচীন যুগের বোদ্ধারা বিষয়টি নিয়ে এতটাই উদগ্রীব ছিলেন যে, এটি যেন এক আলাদা শাস্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ফলে একে অলংকার শাস্ত্র বলা হতো। একে সৌন্দর্যবিজ্ঞান বা ‘অবংঃযবঃরপ ড়ভ ঢ়ড়বঃৎু’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছিল। তারা ভাবতেন কাব্যসৃষ্টির ক্ষেত্রে অলংকার অপরিহার্য। তবে আধুনিক যুগের কবিরা মনে করেন অলংকার ছাড়াও কাব্য সৃষ্টি করা সম্ভব। ধ্বনিবাদীরা এই ধারণার অধিকারী। তাদের ধারণা কবিতা তখনি কবিতা হয়ে ওঠে যখন সেখানে বস্তু, রস ও অলংকার ধ্বনি সংযুক্ত হয়। সাধারণত বাক্যের অন্তর্বর্তী শব্দ উচ্চারণের সময় এর ধ্বনিরূপ (ংড়ঁহফ) কর্ণগোচর হয় এবং সেই সঙ্গে এর অন্তর্গত অর্থ বা (ংবহংব) অনুমিত হয়। “শব্দের ধ্বনিরূপ আমাদের কর্ণগোচর হয়, আর অর্থ হয় আমাদের মনোগোচর (হাবিব রহমান, বাংলা ছন্দ ও অলংকার)। অর্থাৎ এর সুসংযত ও সুশ্রাব্য সংশেষ যেমন কানকে পরিতৃপ্ত করে তেমনি অর্থের অভূতপূর্ণ ব্যঞ্জনা আমাদের মনকেও মুগ্ধ করে তোলে। ধ্বনিরূপ ও অর্থরূপের সাহায্যে দুই ধরনের অলংকার সৃষ্টি হয়-শব্দালংকার এবং অর্থালংকার। শব্দালংকারের মধ্যে আনুপ্রাস, যমক, শেষ, বক্রোক্তি ও পুনরুক্তবদাভ্যাস প্রধান।
আপাতত অর্থালংকার নিয়েই কিঞ্চিৎ আলোকপাত করতে চাই। কবিতায় তার অভিজ্ঞতার আলোকে সৃষ্টি হয় যে নির্মিতি সেখানে উপমার একটি বিশেষ স্থান আছে। এ প্রসঙ্গে সৈয়দ আলী আহসান তার ‘কবিতার রূপকল্প’ পুস্তকে উল্লেখ করেছেন, ‘কাব্য শব্দ বা বাক্য একটি বিশেষ সংহতি এবং ধ্বনিবৃত্তির সাহায্যে বক্তব্যকে মুক্ত করে। যে কৌশল অবলম্বন করে একজন কবি তার বক্তব্যকে বিশেষ বিশেষ পদ্ধতিতে প্রকাশ করেন তার মধ্যে উপমা একটি আশ্চর্য কৌশল।’ আধুনিক কবিতায় উপমা-উৎপ্রেক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। যখন কোনো বাক্যে বিশেষ গুণ, ধর্ম বা ক্রিয়ার ভিত্তিতে ভিন্ন জাতীয় দুটি বস্তুর মধ্যে সাদৃশ্য বা তুলনা করা হয় তখন উপমা অলংকার তৈরি হয়। কবি মোহিতলাল মজুমদার তার ‘সাহিত্য-বিচার’ গ্রন্থে লিখেছেন, “এক বস্তুকে অপর বস্তুর দ্বারা রূপকে ভাবে এবং ভাবকে রূপে; সাদৃশ্য যোগে ফুটাইয়া তোলার যে কাব্য সৃষ্টি তাকেই উপমা বলিতেছি।” উপমাকে কবি জীবনানন্দ দাশ অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘উপমাই কবিতা’। উপমা কবিতার শরীর ও প্রাণও বটে। উপমাকে যথার্থরূপে প্রয়োগ করতে পারলে তা অত্যন্ত সুষমাম-িত ও ঋদ্ধ মনে হয়। কোলরিজ বলেছেন যে, কবিতা যদি ‘সুন্দরতম শব্দের সুষম বিন্যাস হয় তাহলে কবিতায় উপমা অপরিহার্য।’ কখনও কখনও কবিতায় উপমা এত ঋদ্ধ হয়ে ওঠে যে উপমাই যেন একটি কবিতা হয়ে ওঠে। যেমন,
               সমস্ত মৃত নক্ষত্রেরা কাল জেগে উঠেছিল আকাশে একতিল ফাঁক ছিলো না
               পৃথিবীর সমস্ত ধূসর প্রিয় মৃতদের মুখও সেই নক্ষত্রের ভিতর দেখেছি আমি;
                 অন্ধকার রাতে অশ্বথের চূড়ায় প্রেমিক চিলপুরুষের শিশির-ভেজা
                 চোখের মতো ঝলমল করছিলো সমস্ত নক্ষত্রেরা;
                জ্যোৎ¯œারাতে বেবিলনের রানীর ঘাড়ের ওপর চিতার উজ্জ্বল
                চামড়ার শালের মতো জ্বলজ্বল করছিলো বিশাল আকাশ
                কাল এমন রাত ছিল।
                              (হাওয়ার রাত, জীবনানন্দ দাশ)
কবি এখানে প্রকাশ করেছেন যে, আকাশের সমস্ত নক্ষত্রেরা ঝলমল করছিল শিশির-ভেজা প্রেমিক চিলপুরুষের চোখের মতো। তিনি অন্ধকারে জেগে থাকা রিরংসু চিলপুরুষের চোখের সঙ্গে নক্ষত্রের আলোর তুলনা করেছেন। এক অসাধারণ উপমা। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে উপমা গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে। তাই উপমা হলেই চলবে না উপমার মধ্যে এক ধরনের গ্রহণযোগ্যতা থাকাটাও বেশ জরুরি।
অন্যদিকে উৎপ্রেক্ষা শব্দের অর্থ উৎকট জ্ঞান। কখনও সংশয় বা মিথ্যা কল্পনা। উৎপ্রেক্ষার নানাবিধ বৈশিষ্ট্য আছে। যেমন (১) উপমান, (২) উপমেয়, (৩) তুলনামূলক শব্দ এবং (৪) সাধারণ ধর্ম। যেমনÑ ‘রোদের রঙ শিশুর গালের মতো লাল’। এখানে শিশুর গাল-উপমান (যাকে তুলনা করা হয়), রোদের রং- উপমেয় (যাকে তুলনা করা হয়), সাধারণ ধর্ম-লালিমা (যে গুণ, ক্রিয়া বা ধর্মের সঙ্গে তুলনা করা হয়) এবং তুলনামূলক শব্দ-মতো (এ ছাড়া যেন, হেন, মম, ন্যায়, যথা, প্রায়, তুল্য ইত্যাদি শব্দ দ্বারা তুলনামূলক শব্দ প্রকাশ করা হয়)। তবে উপমায় এই চারটি বৈশিষ্ট্যই একসঙ্গে অপরিহার্য নয়। যেমনÑ ‘বন্যেরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃক্রোরে। এখানে শিশুরা-উপমান, বন্যেরা-উপমেয়, সুন্দর-সাধারণ ধর্ম। কিন্তু তুলনামূলক বা সাদৃশ্যবাচক কোনো শব্দ নেই।
            ‘তড়িত-বরনী হরিণ-নয়নী
             দেখিনু আঙিনা মাঝে’
এখানে তড়িত-বরনী ও হরিণ-নয়নী হচ্ছে উপমেয়। এখানে উপমান, সাধারণ ধর্ম এবং তুলনামূলক শব্দ নেই। যার বর্ণনা করা হয়েছে তিনি রাধা। আবার উপমেয় একটি হলেও উপমান একাধিক হতে পারে। যেমন,
              ‘আমার হৃৎপি-ের মতো
              আমার সত্তার মতো
              আমার অজানা ¯œায়ুতন্ত্রের মতো
              সর্বক্ষণ সত্য আমার দেশ’।
                                                                                      এখানে দেশ উপমেয়, উপমান একাধারে হৃৎপি-, সত্তা, অজানা ¯œায়ুতন্ত্রী। তুলনামূলক শব্দ মতো। তবে সাধারণ ধর্ম অনুপস্থিত। উৎপ্রেক্ষা কবিতার মানকে উচ্চাঙ্গে পৌঁছে দেয়। উপমানের অভিনবত্ব এবং দক্ষতার ওপর এর আলংকারিক সৌন্দর্য পাঠককে বিমোহিত করে তোলে। উৎপ্রেক্ষা সর্বদাই পঠকের অনুভূতি ও কল্পনাকে বিশেষ ব্যঞ্জনা দান করে। তিনি যেন এক নতুন ব্যাখ্যা খুঁজে পান। কবি ফিরোজ আহমদ তার ‘বাঁশি ও বৃশ্চিক’ গ্রন্থের ‘নগরে চন্দ্রালোকে’ কবিতায় লিখেছেন,
                        মানুষের চেতনার মতো দেখি ঘন বন                                                          
                         আর ঘন বনের মতো দেখি নগরে নগরে
                         অগণিত মানোবিক চাঁদ- - -
এছাড়া
                          আর তার কিশোর দেহের কি আশ্চর্য মহিমা
                          দুচোখ প্রজ্ঞার মহিমা
                          কণ্ঠস্বর যেন
                          স্বর্গীয় সংকেতে ঋদ্ধ শব্দাবলী ছড়ায় দু’পাশে
                          দেখে দেখে মনে হয় কোনো নব পয়গম্বর যেন।
                               (কবি আহসান হাবীব, মেঘ বলে চৈত্রে যাবো)
উৎপ্রেক্ষা যেন অর্থালংকারের মাঝে এক দ্বৈত দ্যোতনা। উৎপ্রেক্ষায় উপমেয়কে কোনোভাবে তুচ্ছ জ্ঞান না করে তাকে বরং আপন করে উপমানকে কল্পলোকে অবিরত দোলায়িত করে এক জাতীয় তুলনা বা বিষদৃশ্য তুলনা করে অর্থালংকার তৈরি  করা হয়। কবিতা কবির হৃদয় মন্থিত কল্পনা, স্মৃতি, বাসনা, আকাক্সক্ষা ও প্রজ্ঞার সজ্ঞান ঢেউয়ে এক বিমূর্ত অনুভূতি তৈরির প্রচেষ্টা। কবি এখানে অবগুণ্ঠিত সৌন্দর্যকে বের করে নিতে প্রতিজ্ঞ। যা দিয়ে তিনি পাঠককে পুলকিত, আলোড়িত এবং উদ্দীপ্ত করে থাকেন। কবিতার শব্দ যদি হয় শরীরের অঙ্গ-প্রতঙ্গ; উপমা-উৎপ্রেক্ষা হচ্ছে এর হৃৎপি-ের মতোÑ যা তাকে সজীব ও আকর্ষণীয় করে তোলে। তাই আধুনিক কবিতা সচেতন শব্দ, চিত্রকল্প, বৈশিষ্ট্যপূর্ণ অর্থ, ছন্দ ও উপমা-উৎপ্রেক্ষার সংমিশ্রণে গঠিত একটি সুগঠিত রচনা। এখনকার কবিতা যতটা দেখা বা শোনার, তার চেয়েও যেন বেশি উপলব্ধির। বনলতা সেনের চোখ শুধুমাত্র চোখ নয়, পাখির নিড়ের মতো কবির এক নিরাপদ আশ্রয়-শান্তির নিবাস। ক্ষুধিত মানুষের কাছে একটি রুটি যেন পূর্ণিমার চাঁদের মতো ঝলসানো-ক্ষুধাকে নিবৃত করে না। তাই অতীতের কবিতার চেয়ে আধুনিক কবিতা আরও বেশি দার্ঢ্য আরও বেশি বাঙময়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন