দেশের প্রকৃতির সৌন্দর্যে শোভিত অপরূপ এক লীলাভূমির নাম সিলেট। তার সাথে প্রকৃতির অসাধারণ রূপ-লাবণ্যে ঘেরা সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার ‘বিছনাকান্দি। বর্ষার দিনে, গরমের অস্বস্তি থেকে প্রকৃতির কোলে শান্তি পেতে প্রকৃতিকন্যা সিলেটের জাফলং আর জাফলংয়ের অপ্সরাখ্যাত বিছনাকান্দি। জাফলংয়ের মায়াবী ঝর্ণা, পিয়াইন নদের স্বচ্ছ জলের স্রোতধারা, ওপারে নদীর ওপর ঝুলন্ত ব্রিজ, সমতল ভূমিতে চা-বাগান, তামাবিল জিরো পয়েন্ট ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের খাসিয়া পল্লি সবকিছুই প্রকৃতি প্রেমীদের খুব সহজেই আকৃষ্ট করে। করোনাভাইরাসের কারণে গত মার্চ থেকে দেশের বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্রের পাশাপাশি জাফলংয়েও পর্যটকদের আগমনে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। এর ফলে বর্ষা মৌসুমে জাফলং পর্যটকশূন্য হয়ে পড়ে। তবে গত সেপ্টেম্বর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ায় প্রকৃতির এই অপরূপ সৌর্ন্দয্য উপভোগ করতে দেশি-বিদেশি পর্যটকরা ছুটে আসছেন।
প্রাকৃতিক গ্যাস, তেল, চুনাপাথর, কঠিন শিলা, বালুসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদে অনন্য একটি জেলা সিলেট। খনিজ সম্পদ আহরণের পাশাপাশি পর্যটন ক্ষেত্রে মনোনিবেশ করলে বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করে প্রচুর পরিমাণে রাজস্ব আয় করা সম্ভব হবে। শুধু রাজস্বই নয় পর্যটন শিল্পের বিকাশে ও যথাযথ উপভোগে দেশজ পর্যটকগণের মনেও প্রবাহিত করা যেতে পারে অফুরান আনন্দের ফল্গুধারা।
সিলেটের জেলা প্রশাসক কাজী এমদাদুল হক ইনকিলাবকে বলেন, করোনার কারণে জাফলংসহ সিলেটের বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রগুলো বন্ধ ছিল। বর্তমানে কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার কারণে পর্যটক প্রেমিকদের ভিড় বাড়তে শুরু করেছে। এসব এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ভালোভাবে মনিটরিং করছেন।
সরেজমিন ঘুরে জানা গেছে, মহান সাধক হযরত শাহজালাল (র.) ও হযরত শাহপরাণ (র.)সহ ৩৬০ আউলিয়ার পুণ্যভূমি সিলেট একটি প্রাচীন জনপদ। চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ এর ৬৪০ খ্রিষ্টাব্দের ভ্রমণ বিবরণী থেকে এ জেলা সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়। ১৪ শতকে ইয়েমেনের সাধক পুরুষ হযরত শাহজালাল (র.) সিলেট জয় করেন এবং ইসলাম প্রচার শুরু করেন। তাছাড়া মুঘলদের সাথে যুদ্ধ, নানকার বিদ্রোহ, ভাষা আন্দোলন সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধে এ জেলার অবদান অপরিসীম। প্রাচীনকাল হতে এ জেলা পাথর (শীল) ও হাটের (ব্যবসা ও বানিজ্যের) প্রাধান্য ছিল বলে ‘শীল’ ও ‘হাট’ শব্দদ্বয় মিলে সিলেট শব্দের উৎপত্তি হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন।
ঔপনিবেশিক আমল থেকেই সিলেট দ্রুত বিকাশ লাভ করতে থাকে। চা বাগানের বিস্তৃতি এবং ১৯৫০-৬০ দশক থেকে সিলেটের প্রবাসীদের অবদানে এ জেলার উন্নয়ন দ্রুত ঘটতে থাকে যা এখনো অব্যাহত আছে।
সুরমা-কুশিয়ারা, খোয়াই ও মনুসহ আরও অনেক ছোট বড় নদীবেষ্টিত এ জেলায় রয়েছে অনেক হাওর-বিল, ছোট বড় টিলা কানন। রয়েছে দেশের সর্ববৃহৎ হাওর হাকালুকির অংশ বিশেষ। সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার প্রকৃতিকন্যা জাফলং। সারা বছরই এই এলাকায় পর্যটকদের আনাগোনা চোখে পড়ার মতো। ঈদ মৌসুম থেকে শুরু করে বিশেষ কোনো দিনে এখানে হাজারো পর্যটকে মুখর থাকত। প্রকৃতির অকৃপণ রূপ লাবণ্যে ঘেরা গোয়াইন ঘাটের বিভিন্ন স্থান। বর্ষায় আর বৃষ্টিতে পাহাড়-টিলা, নদী, চা-বাগানে সবুজের হাতছানি। নয়নাভিরাম এসব সৌন্দর্য দেখতে ঈদ পরবর্তী সময়ে পর্যটকেরা ছুটে আসতেন প্রকৃতিকন্যা জাফলংয়ে। দেশের একমাত্র মিঠা পানির জলারবন সোয়াম্প ফরেস্ট রাতারগুল, প্রকৃতির অপ্সরাখ্যাত বিছনাকান্দি, অপার সৌন্দর্যমন্ডিত গ্রাম পান্তুমাই, জাফলংয়ের মায়াবী ঝর্ণাধারায়। যেখানে পর্যটকেরা মুগ্ধ হন, প্রেমে পড়েন শীতল প্রকৃতির এই লীলাভূমির। এখানকার নৈসর্গিক প্রাকৃতিক শোভা অতি সহজে মুগ্ধ করে যে কাউকে। বিশেষ করে ঈদপরবর্তী সময়ে কয়েক লক্ষাধিক পর্যটকের পদচারণে মুখর হয়ে ওঠে এ পর্যটনকেন্দ্র। গোয়াইনঘাটে চারটি পর্যটনকেন্দ্র রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পর্যটক ভিড় করতেন প্রকৃতিকন্যা জাফলং ও প্রকৃতির অপ্সরাখ্যাত বিছনাকান্দিতে। জাফলংয়ের মায়াবী ঝর্ণা, পিয়াইন নদের স্বচ্ছ জলের স্রোতোধারা, ওপারে নদীর ওপর ঝুলন্ত ব্রিজ, সমতল ভূমিতে জাফলং, চা-বাগান, তামাবিল জিরো পয়েন্ট ও আদিবাসী স¤প্রদায়ের খাসিয়াপল্লি সবকিছুই খুব সহজেই আকৃষ্ট করে আগত পর্যটকদের।
বর্ষাকালে সব রূপ-যৌবন আর আভিজাত্য নিয়ে যেন হাজির হয়। ছোট-বড় নৌকা নিয়ে জাফলংয়ের জিরো পয়েন্ট, মায়াবী ঝর্ণা, চা-বাগানে পর্যটকেরা নৌকা নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। আর জাফলংয়ে বেড়াতে আসা পর্যটকদের গাইড, চলার বাহন নৌকা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন কয়েকশ’ লোক। বর্ষা এলে পর্যটনকে ঘিরে জেগে উঠত জাফলংয়ের অর্থনীতি। তবে বর্তমানে করোনার এই সময়ে পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে সুনসান নীরবতা লক্ষ করা গেলেও তা এখন আর নাই। এখনও কিছু পর্যটন বন্ধ থাকায় পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরাও বিপাকে পড়েছেন। এলাকার লোকজনের আয় রোজগার না থাকায় তাঁরা এখন মানবেতর জীবন যাপন করছেন। তবে গত দুই মাসের তুলনায় এখন বিনোদন প্রেমিকরা ছুটছেন।
জাফলংয়ের বিভিন্ন বিপণিবিতান, ট্যুরিস্ট গাইড, খাবার হোটেল, আলোচিত্রীসহ কর্মসংস্থান হয় উপজেলার কয়েক হাজার মানুষের। তবে এবার করোনাভাইরাসের কারণে সবকিছুই যেন থমকে গেছে। স্থানীয় ব্যক্তিরা পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় করে নৌকা তৈরি করলেও পরিবেশ-পরিস্থিতি বিবেচনায় গত ঈদ মৌসুমে পর্যটক শূন্য রয়েছিল প্রকৃতিকন্যা জাফলং। করোনাভাইরাস চলতি বছরের মার্চে ছড়িয়ে পড়ে। এরপরই সারাদেশের পর্যটনকেন্দ্রের পাশাপাশি জাফলংয়েও পর্যটকদের আগমনে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। এর ফলে বর্ষা মৌসুমে পর্যটকশূন্য হয়ে পড়ে।
নৌকা মালিক মো. ফজলু রহমান ইনকিলাবকে বলেন, অনেক টাকা খরচ করে পর্যটকদের জন্য নতুন নৌক তৈরি করেছিলাম। করোনা পরিস্থিতির কারণে পর্যটকদের আগমন নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় এখন নৌকা চলাচল বন্ধ ছিল। বর্তমানে আগের তুলনায় পর্যটক আসা শুরু করেছে। বর্ষায় মৌসুম আয়-রোজগারের একমাত্র উৎস এটি। দেশের চলমান পরিস্থিতির কারণে দীর্ঘদিন থেকে ব্যবসা বন্ধ। জাফলং ট্যুরিস্ট গাইড ও পর্যটন নৌকার চালক যুব সংঘের সভাপতি বাছির মিয়া বলেন, বর্ষায় জাফলংয়ে পর্যটকদের আনাগোনাকে কেন্দ্র করে শতাধিক নৌকা শ্রমিক কাজের সন্ধানে বের হয়। কিন্তু এবার করোনা পরিস্থিতিতে পর্যটকদের আনাগোনা নিষিদ্ধ হওয়ায় কর্মহীন হয়ে পড়েছেন এসব নৌ-যান পেশায় যুক্ত হাজারো মানুষ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন