ভুয়া মামলা ও ভুয়া ওয়ারেন্টের কারণে হাজার হাজার মানুষ জুলুম ও হয়রানির শিকার হচ্ছে। বাদী নেই, আসামী আছে, মামলা নেই, ওয়ারেন্ট আছে -এমন মামলা যেমন আছে তেমনি বাদী আছে কিন্তু আসামীকে চেনে না, আসামীও বাদীকে চেনে না, এমন মামলাও আছে। এধরনের উদ্দেশ্যমূলক গায়েবী মামলায় অনেকে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে দিন কাটাচ্ছে। অনেকে পালিয়ে বেড়াতে বাধ্য হচ্ছে। অনেকের বিরুদ্ধে একটা-দুটো নয়, ১০-১৫ টা কিংবা তারও বেশি মামলা আছে। কারাগারে আটক থাকা অবস্থায়ও কারো কারো বিরুদ্ধে নতুন মামলা হওয়ার নজির আছে। ভুয়া মামলা ও ভুয়া ওয়ারেন্টের শিকার হয়ে যারা কারাগারে আছে কিংবা কারাগারের বাইরে পালিয়ে আছে, তাদের পরিবার-পরিজনের দুর্ভোগের অন্ত নেই। কেউ হয়তো পরিবারের অভিভাবক ও একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি, তার কারাগারে বা পালিয়ে থাকার কারণে পরিবার আর্থিক ও নিরাপত্তাজনিত সমস্যায় ভুগছে। তারা কী ধরনের সমস্যা, ভোগান্তি ও অসুবিধার সম্মুখীন, তা ভুক্তভোগী ছাড়া কারো পক্ষে আন্দাজ করা কঠিন। এই ভুয়া মামলা ও ভুয়া ওয়ারেন্টের যাতনা কতটা সীমাহীন হলে ভুক্তভোগী কিছু পরিবার সুপ্রিমকোর্টে প্রাঙ্গনে সমবেত হয়ে প্রধান বিচারপতির দৃষ্টি আকর্ষণ ও প্রতিকার প্রার্থনা করতে পারে, সেটা সহজেই উপলব্ধি করা যায়। গত ২৬ নভেম্বর এরকম অন্তত ২৫ পরিবারের সদস্য জড়ো হয় সুপ্রিমকোর্ট প্রাঙ্গনে। তাদের অবশ্য সেখানে দাঁড়াতে দেয়া হয়নি। তাদের কথাও শোনা হয়নি।
সাধারণত বিপদে ফেলা, হয়রানি করা, প্রতিশোধ নেয়া ও ক্ষতিগ্রস্ত করার উদ্দেশ্যে ভুয়া মামলা হয় কিংবা ভুয়া ওয়ারেন্টে গ্রেফতার হয়। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমন, সম্পত্তি দখল প্রভৃতি কারণেও মামলা-গ্রেফতার হয়। অনেক সময় আদালত অবমাননা, মানহানি, রাষ্ট্রদ্রোহিতা ও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের কারণ দেখিয়ে ভুয়া মামলা ও গ্রেফতার করা হয়। ভুয়া মামলা ও ভুয়া ওয়ারেন্টের উদ্যোক্তা তো থাকেই। তাকে সহযোগিতা করে আদালতের এক শ্রেণীর কর্মচারী এবং পুলিশের কিছু অসাধু সদস্য। তাদের যোগসাজসের মধ্যদিয়ে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেটই ভুয়া মামলা ও ভুয়া ওয়ারেন্টের কারিগর। রাজনৈতিক উদ্দেশে ভুয়া মামলা ও গ্রেফতারের পেছনে ক্ষমতাসীনদের হাত থাকার অভিযোগ বহুল উচ্চারিত। বিরোধী দল বিশেষত: বিএনপি’র নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে অসংখ্য ভুয়া মামলা ও হাজার হাজার নেতাকর্মী গ্রেফতারের অভিযোগ দলটির তরফ থেকে বরাবরই করা হয়। অন্যান্য ক্ষেত্রে ভুয়া মামলার সংখ্যাও কম নয়। পুলিশ সদর দফতরের এক পরিসংখ্যান মতে, ২০১০ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত ৭ বছরে নারী নির্যাতনের মামলা হয়েছে প্রায় এক লাখ ২৯ হাজারের মতো। এসব মামলার ৯০ শতাংশই ভুয়া বলে পুলিশী তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে। দেশের আদালতসমূহে দীর্ঘদিন ধরে মামলার যে জট লেগে আছে তার জন্য ভুয়া মামলা বিশেষভাবে দায়ী। ভুয়া মামলা মামলার সংখ্যাই শুধু বাড়ায়নি বা বাড়াচ্ছে না। গুরুত্বপূর্ণ মামলার বিচার প্রক্রিয়াকেও শ্লথ করে দিয়েছে বা দিচ্ছে। মামলা নেয়ার ক্ষেত্রে আদালত যদি যাচাই-বাছাইয়ের কাজটি খুব সর্তকতার সঙ্গে ও ভালোভাবে করেন, তবে ভুয়া মামলার সংখ্যা কমতে পারে। ফৌজদারী কার্যবিধিতে মামলা রুজুর আগে যাচাই-বাছাই করার যে বিধান ছিল, সেটা বাতিল করা হয়েছে। তার ফল ভালো হয়নি। অন্যদিকে ওয়ারেন্টের ক্ষেত্রে যাচাই-বাছাই, নথি-তথ্যের সমর্থন এবং অভিযুক্তকে ওয়ারেন্ট প্রদর্শন করার বিধি অনেক সময় মান্য করা হয় না। থানায় কেউ অভিযোগ নিয়ে এলেই প্রাথমিকভাবে যাচাই ছাড়াই তা গ্রহণ করতে হবে। এমন কোনো বাধ্যবাধকতা থাকা উচিৎ নয়। অনেকেই হয়তো লক্ষ্য করে থাকবেন, মামলার একটা উপলক্ষ এলেই থানা ও আদালত ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে, যার ফল অনেক ক্ষেত্রেই হয় নেতিবাচক।
ভুয়া মামলা ও ভুয়া ওয়ারেন্ট এমন একটা সমস্যা, যাতে প্রতিবছর অসংখ্য মানুষ ক্ষতি ও হয়রানির সম্মুখীন হচ্ছে। অন্যদিকে কিছু মানুষ ভুয়া মামলা ও ভুয়া ওয়ারেন্টের আশ্রয় নিয়ে তাদের অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার সুবিধা নিচ্ছে। থানা ও আদালতকেন্দ্রিক দুষ্টচক্রও এর সুযোগ গ্রহণ করছে। এই ‘দুই ভুয়া’ বন্ধ হওয়া উচিৎ জনস্বার্থেই। ভুয়া বা গায়েবি মামলার বিষয়ে ২০১৮ সালে হাইকোর্টে একটি রিট হয়। ওই সালের ১ থেকে ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন থানায় যে তিন হাজার ৭৩৬টি ভুয়া বা গায়েবি মামলা হয়েছে বলে রিটে উল্লেখ করা হয়, তার তদন্ত চাওয়া হয়। এজাহার পর্যবেক্ষণ আদালতের তরফে তখন বলা হয়, এ ধরনের মামলায় পুলিশের ভাবমর্যাদা ও বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হয়। যাহোক, আদালত রিটের বিভক্ত আদেশ দেন, যা তৃতীয় বেঞ্চ বাতিল করে দেয়। ওই ব্যাপারে নির্দেশনা বা মিললেও ভুয়া ওয়ারেন্টের বিষয়ে চলতি বছর অক্টোবরে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা মিলেছে। এক ভুক্তভোগীর রিটের প্রেক্ষিতে আদালত সাত দফা নির্দেশনা দিয়েছে। এসব নির্দেশনা যথাযথভাবে প্রতিপালিত হচ্ছে না। আইন নেত্তারা মনে করেন, নিদের্শনা হুবহু অনুসরণ ও মান্য করা হলে ভুয়া ওয়ারেন্টের জঞ্জাল দূর করা অসম্ভব হবে না। অনুরূভাবে ভুয়া মামলার কারবারও কমে যাবে আদালতে প্রাথমিক যাচাই-বাছাইয়ের কাজটি ঠিক মতো করলে। আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ থানা-পুলিশ ও আইন-আদালতে তেমন অভ্যস্থ নয়। এক্ষেত্রে বরং তাদের নিরুৎসাহ ও অনীহা রয়েছে যথেষ্ট। কিন্তু সমাজে দুষ্ট লোকের অভাব নেই। তাদের প্ররোচনায় অনেকেই ভুয়া অভিযোগে থানা ও আদালতের দ্বারস্থ হয়। তাই ভুয়া মামলা বন্ধ করতে আদালতের সতর্কতা যেমন দরকার তেমনি ভুয়া মামলাকারী ও তার সহযোগী বা সহযোগিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। মিথ্যা মামলা আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আদালতে এ অপরাধ প্রমাণিত হলে মামলা করা যায়। আদালত মিথ্যা মামলায় ক্ষতিগ্রস্তকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার আদেশ দিতে পারেন। কোনো পুলিশ কর্মকর্তা আমলযোগ্য নয়, এমন কোনো মামলা মিথ্যা প্রতিবেদন দিলে ভিকটিম তার বিরুদ্ধেও ক্ষতিপূরণের মামলা করতে পারে। বিদ্যমান আইনের যথাযথ প্রয়োগ হলে ভুয়া মামলার ও ভুয়া ওয়ারেন্টের জুলম লক্ষ্যযোগ্যভাবে কমে আসতে পারে। এব্যাপারে নতুন আইনের প্রয়োজন হলে তাও করতে হবে। যেভাবেই হোক ভুয়া মামলা ও ভুয়া ওয়ারেন্ট বন্ধ করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিষয়টি আমলে নিয়ে নির্দেশনা দিলে দ্রুত সুফল পাওয়া যাবে বলে আশা করা যায়। আমরা তাঁর সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন