মামলার কথা শুনলে আমাদের সবারই কম-বেশি গা শিউরে উঠে। কারণ, মামলার ফাঁদে পড়ে অনেক পরিবার নিঃস্ব হয়ে গেছে। তবু থামছে না ভুয়া মামলার হয়রানি। পত্রিকার পাতায় চোখ ভুলালেই এ ধরনের খবর প্রায়ই চোখে পড়ে। ভুয়া মামলার যন্ত্রণা কত নির্মম তা ভুক্তেভোগী ব্যতীত অন্য কেউ অনুধাবন করতে পারে না। কেউ অপরাধ করলে তার বিরুদ্ধে মামলা হবে। সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হবে। অপরাধ প্রমাণিত হলে শাস্তি পাবে। প্রমাণিত না হলে অব্যাহতি পাবে। এটাই আইনের আসল কথা। কিন্তু আমরা দেখছি ঠিক তার উল্টোটা। অপরাধ না করেও কেউ কেউ ফেঁসে যাচ্ছে। প্রতিকার পাচ্ছে না। বিচারপ্রার্থীর দুর্ভোগ বাড়ছে। অর্থ ব্যয় হচ্ছে। ভুয়া মামলা মাথায় নিয়ে হাজারো মানুষ পালিয়ে বেড়াচ্ছে। ভুয়া মামলা দু-একটা হতে পারে! কিন্তু ভুয়া ওয়ারেন্ট কীভাবে জারি হয়। তা বোধগম্য নয়। কারণ, ওয়ারেন্টের যে ফর্ম আছে তা নকল করা কঠিন। এই ফর্ম বিজি প্রেস ছাড়া অন্য কোথাও ছাপার সুযোগ নেই। তাহলে এটি কীভাবে অসাধু চক্রের হাতে চলে যাচ্ছে এই বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের খতিয়ে দেখা উচিত।
আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রে দিন দিন ভুয়া মামলার সাথে ভুয়া ওয়ারেন্টের সংখ্যাও বাড়ছে। কিছু মানুষ নিজেদের স্বার্থ হাসিল করতে কিংবা প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে ভুয়া মামলা দায়ের করছে। যেমন: রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমন, যৌতুক, ভরণপোষণ, খোরপোশ, ধর্ষণ, নারী অপহরণ ও তালাক ইত্যাদি। ভুয়া মামলার আরেক সংস্করণ হচ্ছে গায়েবি মামলা। ডাক্তারের প্রয়োজন আছে। কিন্তু ভুয়া ডাক্তারের কী প্রয়োজন? ডনশ্চয় কোন প্রয়োজন নেই। প্রায়ই আমরা পত্রিকার পাতায় ভুয়া পুলিশ ও ডাক্তারকে হাতকড়া পরা অবস্থায় দেখি। কিন্তু ভুয়া মামলাকারী কিংবা পরোয়ানাজারীকারককে কখনো দেখি না। কেন? তাদেরও ধরে জাতির সামনে হাজির করা প্রয়োজন। ভুয়া মামলার আসামী চেনেন না বাদীকে। বাদী চেনেন না আসামীকে। ভুয়া মামলার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে কয়েক মাস আগে ২৫টি ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গনে জড়ো হয়েছিল। তারা এ ব্যাপারে প্রধান বিচারপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করে। কী কারণে এসব মামলা দায়ের করা হয়েছে তা অনেক পরিবারই জানে না। অথচ, তারা ভুয়া মামলার খেসারত দিচ্ছে।
আদালত থেকে যখন একটি ওয়ারেন্ট থানায় যায়, তখন থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার উচিত পরোয়ানাটি তামিল করার আগে ভালো করে যাচাই করা। এটা সংশ্লিষ্ট আদালতের কিনা। নিশ্চিত হওয়ার পর ওয়ারেন্ট তামিল করা প্রয়োজন। দায়িত্বপ্রাপ্ত কোন কর্মকর্তার গাফিলতি কিংবা অবহেলার কারণে কেউ জেলখানায় বন্দি হলে সংশ্লিষ্ট ওই কর্মকর্তাকেও বিচারের আওতায় আনা প্রয়োজন। কারণ, একটি প্রবাদ আছে, এমন দশজন দোষী মানুষ আইনের শাস্তি থেকে রেহাই পেলেও একজন নির্দোষ মানুষের যেন একদিনেরও সাজা না হয়। ভুয়া মামলার ভুরি ভুরি উদাহরণ আছে। সব ঘটনা লিখলে সমাপ্তি টানা যাবে না। তবে ঘটে যাওয়া দুটো ঘটনার কথা এখানে উল্লেখ করলাম।
বরগুনা সদর উপজেলার ঢলুয়া ইউনিয়নের পোটকাখালী গ্রামের কৃষক বাদল মিয়া। ৫৭ বছর বয়সে জীবনে কখনো ঢাকায় আসেননি। অথচ, ঢাকার এক শিশুকে ধর্ষণের মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানায়(ওয়ারেন্ট) তাঁকে গত ১৪ ডিসেম্বর বরগুনা থানা পুলিশ গ্রেফতার করে। পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তাঁকে যে ওয়ারেন্টে গ্রেফতার করা হয়েছিল তা ছিল ভুয়া। এ কারণে বাদল মিয়াকে ৩৫ দিন কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে কাটাতে হয়েছিল। (সূত্র: যায়যায় দিন ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১)
পিরোজপুরের নেসারাবাদের বাসিন্দা রিপন সমাদ্দার। ২০১৭ সালের ১৪ মে ঢাকার একটি হত্যা মামলায় পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। থানায় নিয়ে যাওয়ার পর সে জানতে পারে, তাঁর বিরুদ্ধে দন্ডবিধির ৩০২/২০১/৩৪ ধারায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ ঘটনা জানার পর সে হতভম্ব হয়ে পড়ে। পরে নেসারাবাদ থানা পুলিশ যখন তাঁকে ঢাকার আদালতে পাঠায়, তখন সে আইনজীবীর মাধ্যমে খোঁজ নিয়ে জানতে পারে, তাঁর বিরুদ্ধে যে হত্যার মামলা দায়ের করা হয়েছে, তা বানোয়াট ও মিথ্যা। এ ধরনের কোনো মামলায় তাঁর নাম নেই। এমনকি তাঁর নামে কোনো পরোয়ানা জারি করেনি আদালত। অথচ, তাঁকে ১১ দিন কারাজীবন ভোগ করতে হয়েছে। (সূত্র: ৩১ জুলাই ২০১৭ এনটিভি অনলাইন)
ভুয়া গ্রেফতারি পরোয়ানা প্রতিরোধে হাইকোর্টের ৭টি নির্দেশনা রয়েছে। গ্রেফতারি পরোয়ানা কার্যকর করার আগে পরোয়ানা ইস্যুকারী আদালতের পক্ষ থেকে নিশ্চিত হওয়ার পর যার বিরুদ্ধে পরোয়ানা ইস্যু করা হবে তার মামলা নম্বর, বিচারকের স্বাক্ষর, সীল মোহর সঠিক কিনা তা যাচাই করে পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণ করার কথা আদেশ বলা হয়েছে। অথচ, আদালতের নির্দেশনা মানা হচ্ছে না। দন্ডবিধির ২১১ ধারা অনুসারে মিথ্যা মামলা করা একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কেউ যদি ক্ষতিসাধনের উদ্দেশ্যে এমনটি করে তবে তাঁর শাস্তি ৭ বছর পর্যন্ত যে কোন মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদন্ড হতে পারে। ফৌজদারী কার্যবিধির ২৫০ ধারা অনুসারে কেউ যদি এমন মোকদ্দমা করে, যা মিথ্যা বা তুচ্ছ ও বিরক্তিজনক, তবে সে মোকদ্দমায় আসামীকে খালাস দিয়েই ম্যাজিস্ট্রেটের নিরস্ত না থেকে ফরিয়াদীকে তার কাজের প্রায়শ্চিত্তের জন্য টাকা খরচের আদেশ কিংবা ক্ষতিপূরণের আদেশ দিতে পারেন। ১৯৮২ সালের ২৪ অধ্যাদেশবলে (৫) উপধারা সংযোজিত করে বাদীকে ক্ষতিপূরণের অতিরিক্ত ৬ মাসের কারাদন্ড অথবা ৩ হাজার টাকা জরিমানার বিধান করা হয়েছে। কিন্তু মিথ্যা মামলা দায়েরকারীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের ও প্রতিকার পাওয়ার দৃষ্টান্ত বিরল। আইন আছে; কিন্তু আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ দেখা যায় না। তবে এমন প্রশ্ন যে কেউ উত্থাপন করতেই পারে, ভুয়া মামলা কেন হচ্ছে? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজলে দেখা যাবে, আইনের শাসন তথা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত না থাকায় কিছু মানুষ অপরাধী হয়ে উঠছে। পৃথিবীর কোন দেশই শতভাগ অপরাধমুক্ত, তা বলা যায় না। প্রত্যেক দেশে কম-বেশি অপরাধ আছে। উন্নয়নশীল, স্বল্পোন্নত কিংবা উন্নত দেশে তা প্রতিরোধে রাষ্ট্রকেই কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হয়। সমাজ ও রাষ্ট্রে যদি আইনের শাসন তথা সুশাসন বিরাজ করে তাহলেই কেবল মানুষ মিথ্যা মামলা কিংবা ভুয়া মামলার হয়রানি থেকে মুক্তি পেতে পারে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন