রাজধানী ঢাকার আশপাশ এবং সিলেটের বিভিন্ন এলাকায় অবাধে চলছে গ্যাস চুরি। দৈনিক প্রায় ২০ কোটি ঘনফুট গ্যাস চুরি হয়। তিতাসের কিছু অসাধু কর্মকর্তার সহায়তায় স্থানীয় প্রভাবশালীরা গ্যাসের অবৈধ সংযোগ দিয়েছে বস্তি ও বিভিন্ন আবাসিক এলাকায়। নেয়া হয়েছে এককালীন টাকা। এর পরিমাণ কোথাও কোথাও লাখ টাকারও ওপরে। গ্যাসে রূপান্তরিত করে পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্রাহকের কাছে পৌঁছাতে প্রতি ঘনমিটারে সরকারকে ৩০ টাকার ওপরে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। বছরে এ খাতে সরকার ছয় হাজার কোটি টাকার ওপর লোকসান গুনছে। ঢাকা, সিলেটসহ দেশের অন্য অঞ্চলে এই দামি গ্যাসের সরবরাহ বাড়লেও। কিন্তু গ্যাস চুরি এখনও বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। গত কয়েক মাসে বরং তা বেড়ে গেছে।
অন্যদিকে সিস্টেমলসের (অপচয়) নামে তা চুরি হচ্ছে গ্যাস। এভাবে অবৈধ সংযোগ দিয়ে প্রতিদিন গ্যাস চুরির পরও কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছেন না তিতাস কর্তৃপক্ষ। গত ৫ বছরে রাজধানী ও আশপাশের জেলাগুলোতে পাঁচ লাখ চুলায় অবৈধ সংযোগ নেয়ার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে তিতাস আড়াই লাখ অবৈধ চুলার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছে। সংশ্নিষ্ট থানায় এ-সংক্রান্ত দুই থেকে তিন শতাধিক সাধারণ ডায়েরি (জিডি) এবং শতাধিক মামলা করা হয়েছে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ ইনকিলাবকে বলেন, ঢাকার গ্যাস বিতরণ ব্যবস্থা ঝুঁকিপূর্ণ। এর মধ্যে গ্যাসের চাপ বাড়লে ঝুঁকি আরও বাড়বে। এ জন্য ঢাকার পুরোনো পাইপলাইন সব পরিবর্তনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অবৈধ সংযোগগুলো স্থায়ীভাবে বন্ধ করা হবে। তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌ. আলী ইকবাল মো. নূরুল্লাহ ইনকিলাবকে বলেন, আমি গতকাল যোগদান করেছি। এখন কিছু বলতে পারব না। অবৈধ সংযোগ বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হবে।
রাজধানীর মিরপুরের মুক্তিযোদ্ধা পল্লীর বাঁশপট্টি বস্তিতে গ্যাস লাইনের এমন অবৈধ সংযোগ থাকলেও এ ব্যাপারে নির্বিকার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এই সংযোগের উপরেই খেলছে শিশুরা। রয়েছে যে কোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা। আর এমন অনিয়ম নতুন কোনো ঘটনা নয়, চলছে বহু বছর ধরে। স্থানীয়রা জানান, প্রতি সংযোগে এককালীন ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা নিয়েছে স্থানীয় প্রভাবশালী একটি চক্র। তারাই আদায় করছে মাসিক বিল। রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বেড়িবাঁধ সংলগ্ন চাঁদ উদ্যান, নবীনগর হাউজিং, শাহজালাল হাউজিং, চন্দ্রিমা হাউজিং, ফিউচার হাউজিং ও মেট্রো হাউজিং এর পাশাপাশি বসিলা ব্রিজের আশপাশের এলাকাতেও রয়েছে গ্যাসের এমন অসংখ্য অবৈধ সংযোগ। এজন্য বাড়ি প্রতি ২০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত নেয়া হয়েছে। টাকা নেয়ার কথা প্রকারান্তরে স্বীকারও করলেন অবৈধ সংযোগ দানকারী চক্রের সদস্যরা। মাস দুয়েক আগে তিতাসের পক্ষ থেকে শুরু করা হয় গ্যাসের অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার কাজ। কিন্তু আবারও রাজধানীর নানা এলাকায় হাউজিংয়ের বাড়ি মালিক সমিতির ব্যানারে টাকা নিয়ে নুতন করে অবৈধ সংযোগ দেয়ার পাঁয়তারা চলছে। তবে এসব বিষয়ে প্রতিবেদকের কাছে মুখ খুলতে রাজি হননি তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ ও হাউজিং বাড়ি মালিক সমিতির সংশ্লিষ্টরা।
২০১৮ সালের ১৮ আগস্ট থেকে এলএনজি থেকে রূপান্তরিত গ্যাস জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ শুরু হয়। যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জি তাদের ভাসমান টার্মিনাল থেকে এ গ্যাস সরবরাহ শুরু করে। তাদের সরবরাহ সক্ষমতা দৈনিক ৫০ কোটি ঘনফুট। ২০১৯ সাল থেকে দেশি প্রতিষ্ঠান সামিট গ্রæপও এলএনজি সরবরাহ শুরু করে। দুই টার্মিনালের দৈনিক ১০০ কোটি ঘনফুট সরবরাহের সক্ষমতা থাকলেও পাইপলাইন জটিলতায় এতদিন এই গ্যাস ৬০ কোটি ঘনফুটের বেশি সরবরাহ করা সম্ভব হয়নি। সংশ্নিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দৈনিক প্রায় ২০ কোটি ঘনফুট গ্যাস চুরি হয়। রাজধানীর আশপাশের অবৈধ গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দৈনিক অন্তত ১৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস চুরি রোধ করা সম্ভব।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) দুই বছর আগে তিতাস গ্যাস বিতরণ কোম্পানি নিয়ে একটি প্রতিবেদন জ্বালানি বিভাগে জমা দিয়েছে। এতে গ্যাস চুরির বিষয়টি প্রতিবেদনে তুলে ধারা হয়েছে। দুদকের প্রতিবেদনে তিতাসের দুর্নীতির প্রধান খাত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে অবৈধ সংযোগকে। এতে বলা হয়েছে, সংস্থাটির ছয় শতাংশ সিস্টেমলস হয় অবৈধ সংযোগের কারণে। বিভিন্ন কারখানা ও বাসাবাড়িতে চোরাই সংযোগ প্রদান এবং লোড বাড়ানোর মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ করেন তিতাসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। আবাসিকের চেয়ে শিল্পে গ্যাস চুরির হার বেশি বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। সাভার, আশুলিয়া, গাজীপুর, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সংযোগের প্রমাণও পেয়েছে দুদক। শিল্প-কারখানায় অবৈধ সংযোগের মাধ্যমে গ্যাস দিয়ে তা বাসাবাড়িতে সিস্টেমলস হিসেবে দেখানো হয়।
পেট্রোবাংলার সূত্রে জানা গেছে, তিতাসের সিস্টেমলস কমছে না। যদিও ২০১৮ সালে এলএনজি আমদানির শুরুর আগেই গ্যাস চুরি বন্ধ করতে বিতরণ কোম্পানিগুলোকে চিঠি দিয়েছিল জ্বালানি বিভাগ। দুই বছর পেরিয়ে গেলেও এই নির্দেশনা বাস্তবায়ন হয়নি। তিতাস বলছে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১২ মাসের মধ্যে ১০ মাসই সিস্টেমলস করেছে কোম্পানিটি। গড় সিস্টেমলস ছিল পাঁচ দশমিক ৪৮ শতাংশ। এর মধ্যে গত বছরের জানুয়ারিতে সংস্থাটির সিস্টেমলস ছিল সর্বোচ্চ ১৪ দশমিক ৯৭ শতাংশ।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলমের মতে, শুধু অবৈধ সংযোগের কারণে বছরে ১২শ’ কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার। অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, চুরি বন্ধ না করে এলএনজি আমদানিকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। মূলত দুর্নীতিকে উৎসাহিত করতে এমনটি করা হচ্ছে।
তিতাসের কর্মকর্তারা জানান, অভিযান চালিয়েও অবৈধ গ্যাসের ব্যবহার থামাতে পারছেন না। ভিজিল্যান্স টিম অভিযান চালিয়ে অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করলেও কয়েকদিনের মধ্যে আবার সেসব চালু হওয়ার ঘটনা ঘটছে। অভিযোগ রয়েছে, সংশ্নিষ্ট এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তিদের তত্ত্বাবধানে বিতরণ কোম্পানির গ্যাসের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে বছরের পর বছর চলছে এই চুরি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন