শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলামী জীবন

সার্বজনীন শান্তি প্রতিষ্ঠায় মুহাম্মদ সা.

মিযানুর রহমান জামীল | প্রকাশের সময় : ৪ ডিসেম্বর, ২০২০, ১২:০৮ এএম

বিশ্ব নবী হযরত মুহাম্মদ সা.। তিনি ছিলেন জীবন ও বিপ্লবের শান্তির প্রতীক। ছিলেন ঐক্যের মশাল, নিরাপত্তা ও কল্যাণের বার্তাবাহক। মানবজাতিকে তিনি সত্য, সরল ও শান্তির পথে আহবান করেছেন। ডেকেছেন মিল্লাতে ইবরাহীমের দিকে। পরিচালিত করেছেন আদর্শের পথে, যেন তারা ইহকাল-পরকালে শান্তি লাভ করে সফল জীবন অর্জন করতে পারে। রাসূল সা.-কে শান্তি ও কল্যাণের জন্য বিশ্ববাসীর রহমত হিসেবে আখ্যায়িত করে আল্লাহ তাআলা বলেন- ‘আমি তোমাকে বিশ্বজগতের প্রতি রহমতরূপেই প্রেরণ করেছি।’ [সুরা : আম্বিয়া, আয়াত : ১০৭]
শান্তি প্রতিষ্ঠায় বিশ্বনবীর কর্মপদ্ধতি ও শান্তিভাবনা : ইসলামপূর্ব আরবে প্রচলিত ছিল গোত্রতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা। এই শাসনব্যবস্থার নানামুখী নেতিবাচক প্রভাবে তাদের মধ্যে যুদ্ধবিগ্রহ লেগে থাকত। জীবন ও সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা এবং মজলুম মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কিশোর মুহাম্মদ সা. ‘হিলফুল ফুজুল’ নামে একটি শান্তিসংঘ গঠনে যোগদান করেন। তিনিও দায়িত্ব পালনে চুক্তিবদ্ধ হন সবার সঙ্গে। নবুয়ত-পরবর্তী জীবনে এই চুক্তির কথা স্মরণ করে তিনি বলতেন- ‘এই চুক্তির বিনিময়ে কেউ যদি আমাকে লাল রঙের উট দিতে সম্মত হত, তবু আমি চুক্তি পরিহার করতাম না।’ [সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস : ৪৩৭৩; মুসনাদ আহমাদ, হাদীস : ১৬৫৫]
শান্তি প্রতিষ্ঠায় নৈতিকতা ও চারিত্রিক উন্নয়ন : শান্তির প্রতিষ্ঠার জন্য হযরত মুহাম্মদ সা. শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চার পাশাপাশি নৈতিকতা ও চারিত্রিক উন্নয়নের প্রতি গুরুত্ব প্রদান করেন। ইসলামের দৃষ্টিতে প্রত্যেক মানুষের নৈতিকতা ও চারিত্রিক উন্নয়নের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। সামাজিক জীবনে নৈতিকতা হচ্ছে একটি বড় শক্তি। নৈতিকতা ও চারিত্রিক উন্নয়নে ইসলাম বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করেছে। নৈতিকতা বিরোধী কোনো কাজ হলে কুরআন সুন্নার আইন অনুযায়ী বিশ্বনবীর খলীফাগণ রায় প্রদান করতেন। ফলে আল্লাহর ভয় এবং দুনিয়ায় শাস্তি ও অপমানের ভয়ে কেউ নৈতিকতা বিরোধী কাজ করার সাহস পেত না। এ কথা সার্বজনীন স্বীকৃত যে, মানুষের মধ্যে নৈতিকতা না থাকলে সমাজ ধ্বংস হয়ে যেত। [শান্তি প্রতিষ্ঠায় রাসূলুল্লাহ সা.-এর গৃহীত নীতিমালা, পৃষ্ঠা নং- ১৭১ ]
শান্তি প্রতিষ্ঠার সুকৌশল : কয়েকবার পুনর্নির্মাণ করা হয় বাইতুল্লাহ। রাসুলুল্লাহ সা.-এর নবুয়ত লাভের পাঁচ বছর আগে তৃতীয়বারের মতো কাবাগৃহ নির্মাণের প্রয়োজন দেখা দিলে কুরাইশ গোত্রের লোকজন তাদের হালাল সম্পদের মাধ্যমে নির্মাণকাজ সম্পন্ন করে।
নির্মাণ শেষে ‘হাজরে আসওয়াদ’ স্থাপন নিয়ে যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। সিদ্ধান্তহীন চার-পাঁচ দিন কেটে যায়। তখন কুরাইশ গোত্রের বয়োজ্যেষ্ঠ ও প্রবীণ নেতা আবু উমাইয়াহ ইবনে মুগিরা মাখজুমি প্রস্তাব দেন- আগামীকাল প্রভাতে যিনি সর্বপ্রথম মসজিদুল হারামের দরজা দিয়ে প্রবেশ করবেন, তিনিই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেবেন। সবাই এ প্রস্তাবে সম্মতি জ্ঞাপন করে। দীর্ঘ অপেক্ষার পালা শেষে দেখা যায়, মুহাম্মদ সা. কাবাগৃহে সবার আগে প্রবেশ করেছেন। সবাই সমস্বরে বলে ওঠে- মুহাম্মদ! আমাদের আল-আমিন, আমরা সবাই তাঁর সিদ্ধান্ত মানতে প্রস্তুত। রাসুলুল্লাহ সা. বুদ্ধিদীপ্ত সুকৌশলে একটি চাদর আনতে বলেন। নিজ হাতে তার ওপর ‘হাজরে আসওয়াদ’ রেখে চার গোত্রের চারজনকে দিয়ে সেটি বহন করে যথাস্থানে স্থাপন করেন। এভাবেই সঙ্কটময় যুদ্ধাবস্থার অবসান হয়ে শান্তি স্থাপিত হয়। [মুহাম্মদ ইদরিস কান্ধালভি, সিরাতুল মুসতাফা, ১ম খন্ড, দেওবন্দ : দারুল কিতাব, তা. বি.), পৃ. ১১৩-১১৬]
মদীনার সনদ : মদীনায় হিজরত করার পর সেখানে বসবাসকারী বিভিন্ন ধর্মের অনেকে স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করলেও অনেকে বিদ্বেষের পথ অবলম্বন করে। হিজরতের পাঁচ মাস পর মদীনা রাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা এবং পারস্পরিক সহাবস্থান নিশ্চিত করতে রাসুলুল্লাহ সা. মদীনায় বসবাসকারী অমুসলিমদের সঙ্গে লিখিত চুক্তি স্বাক্ষর করেন, যা ‘মদীনা সনদ’ নামে পরিচিত। এই চুক্তির মাধ্যমে সবাই নিজ নিজ ধর্ম পালনের স্বাধীনতা লাভ করে, পারস্পরিক শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান সুনিশ্চিত হয়, অন্যের প্রতি হিংসাত্মক মনোভাব, রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা ও সামাজিক অরাজকতা দূর হয় এবং পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধ ও সামাজিক বন্ধন সুদৃঢ় হয়। যত দিন তারা এই চুক্তি রক্ষা করেছে, তত দিন তাদের সঙ্গে মুসলমানদের ভ্রাতৃত্বসুলভ আচরণ বহাল থেকেছে।
আল্লাহ বলেন- ‘দীনের ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদের স্বদেশ থেকে বহিষ্কার করেনি, তাদের সঙ্গে মহানুভবতা প্রদর্শন ও ন্যায়বিচার করতে আল্লাহ তোমাদের নিষেধ করেন না। আল্লাহ ন্যায়পরায়ণদের ভালোবাসেন।’ [সুরা : মুমতাহিনাহ, আয়াত : ৮]
সন্ধির মাধ্যমে শান্তি প্রত্যাশা : শান্তি প্রতিষ্ঠায় বিশ্বনবী সা.-এর অনবদ্য ভূমিকার অনন্য স্মারক হুদাইবিয়ার সন্ধি। বাহ্যিকভাবে পরাজয়মূলক হওয়া সত্তে¡ও শান্তি প্রতিষ্ঠার স্বার্থে তিনি এই সন্ধিতে স্বাক্ষর করেন। হিজরতের ছয় বছরের মাথায় রাসুলুল্লাহ সা. স্বপ্নযোগে নিজেকে ওমরাহ পালন করতে দেখেন। প্রস্তুতির পর তিনি প্রায় চার হাজার সাহাবী নিয়ে ওমরাহ পালনে রওনা হন। মক্কার অদূরে হুদাইবিয়া নামক স্থানে পৌঁছলে কুরাইশরা তাঁদের আটকে দেয়। এদিকে সাহাবীরা কুরাইশদের অন্যায়ের জবাব দিতে রাসুল সা.-এর হাতে বায়আত গ্রহণ করেন। অবশেষে কুরাইশদের পক্ষ থেকে সন্ধি প্রস্তাব এলে রাসুলুল্লাহ সা. কুরাইশদের সঙ্গে এক অসম চুক্তিতে উপনীত হন। তিনি তা করেছিলেন শুধুই শান্তির প্রত্যাশায়, যা খুব অল্প সময়ের মধ্যে প্রমাণিত হয়েছিল। উল্লিখিত বিষয়ে কুরআনুল কারীমের সুরা ফাতহে বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে।
বিশ্বময় ইসলামের শান্তিবার্তা : রাসুলুল্লাহ সা. হুদাইবিয়ার সন্ধির পর ইসলামের দাওয়াত বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এ জন্য তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন রাজা-বাদশাহর কাছে ইসলামের দাওয়াত বিষয়ে চিঠি পাঠানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।
এসব চিঠি পাঠানোর মূল উদ্দেশ্য ছিল- বিশ্বব্যাপী এই বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া যে ইসলাম শুধু আরবদের ধর্ম নয়, বরং ইসলাম সমগ্র বিশ্বের মানুষের জন্য এবং বিশ্বমানবতার মুক্তি ও শান্তির জন্য। তাঁর চিঠির মূল কথা ছিল- ‘ইসলাম গ্রহণ করুন! শান্তিতে থাকুন!!’ [বুখারী, হাদীস : ২৭৮২] রাসুলুল্লাহ সা. শান্তিপূর্ণ পদ্ধতিতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, যা বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় ঐতিহাসিক মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত। ফাতেহ মক্কার পর শান্তি ঘোষণা : বিশ্বনবী সা.-এর শান্তিপূর্ণ ‘মক্কা বিজয়’ ইতিহাসের এক অমলীন অধ্যায়। তিনি বিনা যুদ্ধে ও বিনা রক্তপাতে মক্কা জয় করেন। যেসব জাতি অত্যাচার-নির্যাতন ও যুদ্ধ করে আজীবন রাসুলুল্লাহ সা.-কে সীমাহীন কষ্ট দিয়েছে, সেসব জাতি ও গোত্রকে মক্কা বিজয়ের দিন সাধারণ ক্ষমা করে এবং তাদের প্রতি উদার মনোভাব দেখিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন।
তিনি বলেন- ‘আমি তা-ই বলব, যা আমার ভাই ইউসুফ আ. বলেছেন, আজ তোমাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করুন এবং তিনিই শ্রেষ্ঠ দয়ালু।’ [নাসাঈ আল-কুবরা, হাদীস : ১১২৯৮]
বিদায় হজের ভাষণ : রাসুলুল্লাহ সা.-এর পুরো জীবনের সারকথা বিদায় হজের ভাষণ। সেখানে তিনি উপস্থিত সবাইকে শান্তির চূড়ান্ত বার্তা পৌঁছে দেওয়ার নির্দেশ দেন। তাঁর ভাষণের প্রতিটি শব্দই ছিল শান্তি প্রতিষ্ঠার হেকমত ও কৌশল। যেমন তিনি বলেছেন- ‘নিশ্চয়ই তোমাদের রক্ত, তোমাদের ধন-সম্পদ এবং তোমাদের সম্ভ্রম পরস্পরের জন্য আজকের এই দিন, এই মাস এবং এই শহরের মত পবিত্র ও মর্যাদাপূর্ণ।’ [বুখারী, হাদীস : ৬৭]
জীবনের বাঁকে বাঁকে জমে থাকা হতাশা, অর্থনৈতিক বৈষম্য, রাজনৈতিক সহিংসতা, মূল্যবোধের অবক্ষয়, ধর্মীয় বিদ্বেষ, উগ্র জাতীয়তাবাদ, সন্ত্রাস, অবিচার, জুলুম, হত্যা, দুঃশাসন, অনৈতিক প্রতিশোধ, আদর্শ নেতৃত্ব সঙ্কট ইত্যাদির কারণে মানবজীবনে অশান্তি সৃষ্টি হয়। রাসুলুল্লাহ সা. এ সবের মূলোৎপাটন করে ভারসাম্য, সহনশীল, সংযত এবং আখেরাতমুখী আলোকিত সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পৃথিবীকে শান্তির রাজ্যে পরিণত করেছেন। তাঁর আদর্শ মানার বাস্তবায়নেই রয়েছে পৃথিবীবাসীর সুখ-শান্তি। বিশ্বনবীর এ পথেই রয়েছে মানবজাতির নিরাপত্তা। তাঁর রাহে সুন্নাহর সোনালি ধাঁপেই রয়েছে কায়েনাতের সার্বিক সফলতা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (2)
Nazrul Islam ৭ ডিসেম্বর, ২০২০, ৪:৪৭ পিএম says : 0
GOOD
Total Reply(0)
ramzan ৩১ জানুয়ারি, ২০২২, ৮:৫১ এএম says : 0
শান্তির ধর্ম ইসলামে সন্ত্রাসের স্থান নেই [ (বলেছেন, নায়েবে মুজাদ্দেদ, আমির-উশ-শারিয়াত ও ত্বরিক্বত হযরত মাওলানা আবুল আনসার মুহাম্মাদ আবদুল কাহহার সিদ্দিকী আল কুরাইশী, ফুরফুরাভী রহিমাহুল্লাহ, ফুরফুরা দরবারের মাগফুর গদ্দিনসীন পীর সাহেব। সূত্রঃ নেদায়ে মদীনা(শরীফ), ফুরফুরার মুখপত্র, চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ]।
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন