বায়ু দূষণ, রাজধানীসহ পুরো দেশের মানুষের কাছে অতি পরিচিত একটি দূষণের নাম। বর্ষা মৌসুম শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অস্বাস্থ্যকর হয়ে উঠে পরিবেশ। ফলে বাতাসে ভাসমান বস্তুকণার উপস্থিতি সহনীয় মাত্রার চেয়ে কয়েকগুণ বেড়ে যায়, যা স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। সাধারণত বাতাসে মিশে থাকে বিভিন্ন ধরনের বস্তুকণা। এই বস্তুকণার (পার্টিকুলেট ম্যাটার বা পিএম) পরিমাপ করা হয় প্রতি ঘনমিটারে মাইক্রোগ্রাম (পিপিএম-পার্টস পার মিলিয়ন) এককে। এসব বস্তুকণাকে ১০ ও ২.৫ মাইক্রোমিটার ব্যাস শ্রেণিতে ভাগ করে তার পরিমাণের ভিত্তিতে ঝুঁকি নিরূপণ করেন গবেষকরা। তারা বলেন, বাতাসে প্রতি ঘনমিটারে ২.৫ মাইক্রোমিটার ব্যাসের বস্তুকণার পরিমাণ (পিপিএম) যদি শূন্য থেকে ৫০ এর মধ্যে থাকে, তাহলে ওই বাতাসকে বায়ু মানের সূচকে (একিউআই) ভালো বলা যায়। এই মাত্রা ৫১-১০০ হলে বাতাসকে মধ্যম মানের এবং ১০১-১৫০ হলে বিপদসীমায় আছে বলে ধরে নেওয়া হয়। আর পিপিএম ১৫১-২০০ হলে বাতাসকে অস্বাস্থ্যকর, ২০১-৩০০ হলে খুব অস্বাস্থ্যকর এবং ৩০১-৫০০ হলে অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর বলা হয়।
বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রকার শিল্প কারখানার অবস্থান রয়েছে ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায়। এসব বস্ত্র ও ট্যানারি কারখানাগুলো প্রতিনিয়ত হাইড্রোজেন সালফাইড, অ্যামোনিয়া, ক্লোরিন, কার্বন ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনো-অক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড সহ আরও কয়েক প্রকার গন্ধহীন রাসায়নিক পদার্থ নির্গত করছে যা বায়ু দূষণের অন্যতম কারণ। বিশেষ করে শীত মৌসুমে ইটভাটা সহ কারখানাগুলো বেশি সময় ধরে চালু থাকে যার ফলে বায়ু দূষণের প্রবণতা বেড়ে যায়। এ মুহূর্তে বায়দূষণের দিক দিয়ে বাংলাদেশ বিশেষত ঢাকা শহর বিশ্বের মধ্যে শীর্ষে অবস্থান করছে।
বিশ্বজুড়ে প্রতিবছর প্রায় ৩৩ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর কারণ হলো বায়ুদূষণ, এসবের মাঝে ৭৫ শতাংশ মৃত্যুই ঘটে হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক থেকে, বাকি ২৫ শতাংশ হয় ফুসফুসের রোগে। শুধু তাই নয়, এই মৃত্যুর ৭৫ শতাংশ ঘটে এশিয়া মহাদেশে, যেখানে বায়ুদূষণের মাত্রা ভয়াবহ। সাম্প্রতিক কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, দূষিত বায়ু বেশ কিছু দিক দিয়ে আমাদের ক্ষতি করতে সক্ষম। যেমন, জন্মগত ত্রুটি, স্ট্রোকের ঝুঁকি, কিডনির রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব, হার্ট অ্যাটাক ইত্যাদি। যেহেতু শীতল আবহাওয়ার সময় আর্দ্রতা প্রচন্ড হ্রাস পায় এবং ধুলার দূষণ মারাত্মক মোড় নেয়, তাই এ সময় কিছু ভাইরাল ফ্লু’র উত্থান এবং শ্বাস প্রশ্বাসের সংক্রমণ বেড়ে যায়। শীতের সময় ক্রমবর্ধমান ধুলার দূষণের কারণে ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে হাঁপানি, নিউমোনিয়া, ফুসফুসের ব্যাঘাত রোগ, ব্রঙ্কাইটিস, ফুসফুসের ক্যান্সার ও শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা সাধারণত বৃদ্ধি পায়। আশঙ্কা করা হচ্ছে, শুষ্ক মৌসুমে করোনা পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। শীতজনিত রোগে আক্রান্ত রোগীরা কোভিড-১৯ এ সংক্রমিত হলে করোনায় মৃত্যুর হার আরও বাড়তে পারে।
শীতকালে বায়ু দূষণের পাশাপাশি ভাইরাস সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকারকে অবিলম্বে কার্যকর প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিৎ। আইন প্রয়োগ এবং জনগণকে অনুপ্রাণিত করে সবার মাস্ক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। কেননা এটিই মানুষকে দূষণ এবং কোভিড-১৯ থেকে রক্ষা করার সবচেয়ে কার্যকর উপায়। বায়ুদূষণ থেকে রেহাই পেতে আমাদেরকে পরিবেশ বান্ধব ইটভাটা, যানবাহন ও শিল্পকারখানা গড়তে হবে। বাতাসে ক্ষতিকারক উপাদান ছড়াতে পারে এমন জ্বালানি ব্যবহার বন্ধ ও নিষিদ্ধ করতে হবে, ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহার কমানোর ব্যবস্থা করতে হবে, বায়ুতে রাস্তার ধুলাবালি উড়া বন্ধ করতে বা কমাতে নিয়মিত পানি ছিটানোর ব্যবস্থা করতে হবে, পশুপাখির মৃত দেহ, ময়লা আবর্জনা ও বর্জ্য মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে, বাহিরে চলাফেরার সময় মাস্ক ব্যবহার করতে হবে, রাস্তা নির্মাণ বা মেরামতের কাজ দ্রুততম সময়ে সম্পন্ন করতে হবে, মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ি চালানো বন্ধ করতে হবে, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নত করতে হবে- যাতে করে যেখানে সেখানে নগর বর্জ্য বা কৃষি বর্জ্য উন্মুক্তভাবে পোড়ানো না হয় সেদিকে নজর রাখতে হবে, প্রচলিত আইনকে যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে হবে ইত্যাদি। এসব সমস্যা একেবারে নির্মূল করা সম্ভব না হলেও ধাপে ধাপে কমিয়ে আনার মতো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। সকলের ভেতর পরিবেশ বান্ধব মনোভাব তৈরি করতে হবে। বায়ুদূষণ প্রতিরোধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, অন্যান্য সংস্থা ও জনগণ সমন্বিত উদ্যোগ নিলে সুফল বয়ে আনা সম্ভব। তাই জাতীয়ভাবে পরিবেশ রক্ষার জন্য আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসা উচিত, সচেতন হওয়া উচিত।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন