দেশের প্রায় প্রতিটি সেক্টরে দক্ষ জনশক্তির অভাব প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। বিশেষত দেশের প্রধান রফতানিমুখী তৈরী পোশাক সেক্টরে হাজার হাজার বিদেশি শ্রমিক উচ্চ বেতনে কাজ করছে। এভাবে দেশ থেকে প্রতি বছর শত শত কোটি ডলার বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। মূলত তৈরী পোশাক খাত এবং বৈদেশিক কর্মসংস্থানের উপর দাঁড়িয়ে আছে আমাদের জাতীয় অর্থনীতি। এই দুই খাতে দক্ষ জনশক্তির অভাবে দেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা চরমভাবে মার খাচ্ছে। শিল্পকারখানার পাশাপাশি গৃহস্থালি কাজেও যান্ত্রিক বা রোবোটেক টেকনোলজির ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় উন্নত বিশ্বে অদক্ষ শ্রমিকের চাহিদা কমে যাচ্ছে। অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো আভ্যন্তরীণ কর্মসংস্থানের প্রতি অধিক গুরুত্ব দেয়ায় বৈদেশিক কর্মী নিয়োগের প্রবণতা এমনিতেই কমে যাচ্ছে। আবার দক্ষ জনশক্তির চাহিদা বাড়লেও বাংলাদেশ সে সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে ব্যর্থ হচ্ছে। এতদিন যে সব সেক্টরে অদক্ষ ও অর্ধদক্ষ শ্রমিক দিয়ে চাহিদা পুরণ করা হত এখন সে সব ক্ষেত্রেও বিভিন্ন দেশের দক্ষ শ্রমিকরা ভীড় করায় বাংলাদেশী অদক্ষ শ্রমিকদের চাহিদা ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। এহেন বাস্তবতা দেশের বৈদেশিক কর্মসংস্থান খাতের জন্য একটি অশনিসংকেত হিসেবে দেখা হচ্ছে।
দেশের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় উচ্চ ডিগ্রীধারি ব্যক্তিরা প্রথাগত উৎপাদন ব্যবস্থা ও কর্মসংস্থানে তেমন কোনো ভ’মিকা রাখতে পারছে না। তা নাহলে দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রীধারী লাখ লাখ যুবক কর্মহীন থাকার পরও গার্মেন্ট সেক্টরে প্রতিবেশি দেশ থেকে হাজার হাজার শ্রমিক এনে চাহিদা পুরণ করতে হত না। অবশ্য এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের খামখেয়ালি এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের নজরদারি ও প্রয়োজনীয় নির্দেশনার অভাবও অনেকাংশে দায়ী। একজন অদক্ষ শ্রমিকের চেয়ে দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা ও বেতন-ভাতা অনেক বেশি। দেশের লাখ লাখ অদক্ষ শ্রমিক বিদেশে গিয়ে যে পরিমান রেমিটেন্স আয় করছে, দেশের গার্মেন্টস সেক্টরে তার চেয়ে অনেক কম সংখ্যক বিদেশি শ্রমিক কাজ করে অনেক বেশি রেমিটেন্স নিয়ে যাচ্ছে। দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আমাদের ব্যর্থতার কারণে একদিকে যেমন বৈদেশিক কর্মসংস্থান থেকে প্রাপ্য রেমিটেন্স থেকে আমরা বঞ্চিত হচ্ছি, অন্যদিকে দেশের তৈরী পোশাক খাত থেকে অর্জিত রেমিটেন্সও দেশে রাখতে পারছি না। দক্ষ জনশক্তির অভাব আমাদের অর্থনৈতিক শক্তিকে ভেতর থেকে দুর্বল ও ফোঁকলা করে দিচ্ছে। পরিবর্তিত বিশ্ববাস্তবতায় দেশের সম্পদ দেশে রাখতে এবং বৈদেশিক কর্মসংস্থান খাতে ক্রমবর্ধমান দক্ষ জনশক্তির চাহিদা পূরণে কার্যকর উদ্য্গো নিতে পারলেই কেবল দেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা টিকিয়ে রাখা সম্ভব হতে পারে।
করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে দেশের সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থার পাশাপাশি কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও বন্ধ হয়ে পড়েছে। বলা হচ্ছে, এ কারণে দক্ষ জনশক্তি তৈরী করে বিদেশে পাঠানোর কর্মপরিকল্পনা স্থবির হয়ে গেছে। তবে শুরু থেকেই বাংলাদেশের বৈদেশিক কর্মসংস্থানে শতকরা ৯০ভাগই অদক্ষ শ্রমিক। এদের শ্রমের মজুরি অন্যান্য দেশের দক্ষ জনশক্তির চেয়ে অনেক কম। দেশের প্রায় প্রতিটি জেলা সদর ও উপজেলায় সরকারি-বেসরকারি শত শত কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এসব টেকনিকেল ট্রেনিং সেন্টার(টিটিসি) থেকে বছরে গড়ে ৫ লক্ষাধিক শ্রমিক প্রশিক্ষণ নিয়ে বের হয়ে আসলেও এদের জন্য দেশে-বিদেশে যথাযথ কর্ম সংস্থান নিশ্চিত করার কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেই। জনশক্তি প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থান ব্যুরোর(বিএমইটি) তথ্য অনুসারে দেশের বৈদেশিক কর্মসংস্থানের শতকরা ৯০ভাগই মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজারের উপর নির্ভরশীল। এর বাইরে মালয়েশিয়া অন্যতম প্রধান শ্রমবাজার। গত দুই বছর ধরে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বন্ধ রয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের বাজারও বছরের পর বছর ধরে এক প্রকার অচলাবস্থা বিরাজ করছে। এহেন বাস্তবতায় বিকল্প শ্রমবাজার অনুসন্ধান ও ক‚টনৈতিক উদ্যোগ নিতে হবে। করোনাকালীন বাস্তবতায় অদক্ষ শ্রমিকের চাহিদা কমলেও ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারসহ বিভিন্ন সেক্টরের দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা রয়েছে। সম্ভাব্য দেশগুলোতে প্রয়োজনীয় জনশক্তির চাহিদার প্রতি লক্ষ্য রেখে উপযুক্ত কর্মী প্রশিক্ষণ ও জনবল গড়ে তোলার সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ নিতে হবে। সময়ের চাহিদা অনুসারে শ্রমিকের আধুনিক প্রযুক্তিগত ও কারিগরি দক্ষতার পাশাপাশি নির্দিষ্ট দেশের ভাষা, সংস্কৃতি ও সিভিক নিয়ম কানুনও প্রশিক্ষণের অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। শুধু কারিগরি শিক্ষাই নয়, দেশের সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থাকেও সময়ের চাহিদার সাথে সঙ্গতি রেখে সংস্কার বা ঢেলে সাজানোর সুচিন্তিত উদ্যোগ নিতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন