মীরসরাই উপজেলা সংবাদদাতা : চট্টগ্রামের মীরসরাই ও ফেনী জেলার সোনাগাজী উপজেলা মধ্যবর্তী মুহুরী সেচ প্রকল্পের রেগুলেটর থেকে মাত্র দেড়শ’ গজের মধ্যেই গড়ে উঠেছে অবৈধ বালু মহাল। এর ফলে হুমকির মুখে পড়েছে মুহুরী সেচ প্রকল্পের রেগুলেটর ও সোনাগাজী মুহুরী সেচ প্রকল্প যাতায়াতের প্রধান সড়কসহ ৮নং আমিরাবাদ ইউনিয়নের পূর্ব অঞ্চল। আইডিএ, সিডা এবং ইইসি সাহায্য পুষ্ট মুহুরী সেচ প্রকল্পটি ১৯৭৭ সাল থেকে কাজ শুরু করে দীর্ঘদিন কাজ করে প্রকল্পের কাজটি শেষ করে। এ প্রকল্পটি নির্মাণ করতে ১৫,৬৮৬.২৪ লক্ষ টাকা ব্যয় হয়। কিন্তু এই প্রকল্প এলাকায় এই অবৈধ বালু উত্তোলনের জন্য বর্তমানে হুমকির মুখে দুই জেলার জন্য গুরুত্বপূর্ণ মুহুরী সেচ প্রকল্পটি। এছাড়া এই বালু উত্তোলনের জন্যই বিলীন হয়ে যাচ্ছে মীরসরাই ও সোনাগাজী অঞ্চলের ঘরবাড়ি ও জনপদ।
সরেজমিনে জানা যায়, চলতি ২০১৬ সালের গত এপ্রিল থেকে এই বালু উত্তোলনের কাজ শুরু হয়। নদীতে ড্রেজিং মেশিন বসিয়ে প্রতিদিন ৫০ হাজার ঘনফুট বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। কোটি কোটি টাকা মূল্যের বালু ও মজুদ আছে নদীর পাড়ে। প্রতিদিন গড়ে ৬০-৭০ ট্রাক বালু বিক্রি করা হচ্ছে। স্থানীয়ভাবে জানা যায়, সোনাগাজীর এমপি হাজী রহিম উল্যাহ-এর ছত্রছায়ার কিছু দুষ্কৃতকারীর তত্ত¡াবধানে এই বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। সরেজমিনের গিয়ে দেখাযায়, মুহুরী প্রকল্পের সন্নিকটে পাহাড়সম বালুর স্তূপ। সোনাগাজী-মীরসরাই মুহুরী প্রজেক্ট প্রকল্পের নাভিঘেঁষা গুরুত্বপূর্ণ সড়কটি ব্যাপকহারে ভাঙ্গন ধরেছে এবং হুমকীর মুখে পড়েছে মুহুরী প্রজেক্ট রেগুলেটরটি। এভাবে একজন এমপি-এর নাম বিক্রি করে সরকারের কোটি কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করে পানি উন্নয়ন বোর্ড বাধা দেওয়া সত্তে¡ও এই বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। এই বালু মহলের টেন্ডার না থাকলেও এমপি হাজী রহিম উল্যার দোসর বেলালের নামে ছাপা আছে বালু বিক্রির রসিদ বই। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের আওতাধীন নিরাপত্তা কর্মকর্তা কমান্ডার আক্কাস বলেন, বালু উত্তোলনের কারণে রেগুলেটরের আশেপাশে একমাত্র যান চলাচলের সড়কটি ব্যাপকহারে ভাঙ্গন ধরেছে। স্থানীয় চেয়ারম্যান ও সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামীলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জহিরুল আলম জহির বলেন, মুহুরী সেচ প্রকল্প সংলগ্ন স্থান থেকে বালু উত্তোলন বন্ধ না হলে এই এলাকার পরিস্থিতি হবে ভয়াবহ। আমি এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করি।
সোনাগাজী উপজেলা যুবলীগের সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান আজিজুল হক হিরণ বলেন, এমপি হাজী রহিম উল্যাহ প্রভাব খাটিয়েই এই অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের ফলে হুমকীর মুখে সোনাগাজীবাসী। স্থানীয়দের আরো অভিযোগ এই এমপি রহিম এলাকায় থাকেন না। এলাকার মানুষের সুখ-দুঃখ সম্পর্কে তিনি কি বুঝবেন। তিনি ঢাকায় থাকেন কিন্তু এলাকায় তার। এবিষয়ে জানতে চাইলে সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামীলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রুহুল আমিন জানান, হাজী রহিম উল্যাহ নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার করে এই বালু উত্তোলন করেন। জনগণের ক্ষতি করে বালু উত্তোলনের জন্য আমরা সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামীলীগের পক্ষ থেকে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। তিনি আরো জানান, ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ফেনী-২ আসনের এমপি নিজাম উদ্দিন হাজারী একান্ত প্রচেষ্টায় সোনাগাজীতে বাঁকা নদী সোজা করা হয়েছিল। কিন্তু স্থানীয় এমপি এলাকার উন্নয়নের কথা, এলাকাবাসীর সুখ-দুঃখের কথা কখনো চিন্তা করেন না। বালু উত্তোলন বন্ধ না করলে সোনাগাজী-মীরসরাই সড়ক নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে অতিশীঘ্রই। পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী নুরুল আফচার বলেন, বালু উত্তোলনের ফলে ক্ষতি হচ্ছে বটে। তবে নদীর মালিক ফেনী জেলা প্রশাসক। জেলা প্রশাসকই এই বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের এখতিয়ার রাখেন বলে জানান তিনি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফেনী জেলা প্রশাসক আমিন-উল আহসান এ প্রতিবেদককে জানান, সোনাগাজীতে একটি মাত্র বালু মহাল আছে। তবে এ বালু মহালটি মুহুরী সেচ প্রকল্পের আশেপাশে নয়। যদি মুহুরী সেচ প্রকল্পের আশেপাশে বালু উত্তোলন করা হয়, তাহলে তার বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ বিষয়ে স্থানীয় স্বতন্ত্র এমপি হাজী রহিম উল্যার কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, আমি অবৈধ ভাবে বালু উত্তোলন করছিনা, আমার কথা সত্য না হলে জেলা প্রশাসকের সাথে যোগাযোগ করতে বলেন, এ বলে ফোনটি কেটে দেন।
এদিকে গত কয়েক বছরের ফেনী নদীর ভাঙ্গন বেড়েই চলছে। অব্যাহত ভাঙ্গনে সোনাগাজী অংশের বিভিন্ন জনপদ, ছাগলনাইয়া উপজেলার জয়পুর, জগন্নাথ সোনাপুর, উত্তর লাঙ্গলমোডা, দক্ষিণ লাঙ্গলমোড়া ও মুহুরীগঞ্জ এলাকার শত শত পরিবার হারিয়েছে তাদের স্থায়ী আশ্রয়স্থল। তাদের ঘরবাড়ী, ফসলী জমি, টিউবওয়ের, পুকুর, নদী রক্ষা বাঁধ কোন কিছুই এই ভয়াবহ এই ভাঙ্গনের কবল থেকে রেহাই পায়নি। যে কারণে ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে নদীর পাড়ের জনবসতির মানচিত্র।
দ্রæত ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলো সংস্কার না করলে যে কোন সময়ে বেড়িবাঁধ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে এলাকা প্লাবিত হলে ব্যাপক ক্ষতি হতে পারে বলে এলাকাবাসীর অভিমত। স্থানীয়দের অভিযোগ, নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের কারণেই এই ভাঙ্গন সৃষ্টি হয়েছে। ফেনী নদীর সোনাগাজী ও ছাগলনাইয়া অংশে বিশাল এলাকা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
গত ৫ বছরে শত শত পরিবার তাদের ভিটেমাটি, সহায়-সম্বল হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছেন। অনেক কৃষক হারিয়েছেন তাদের ফসলী জমি। ২০০৪ সালে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) এলাকাবাসীকে নদী ভাঙ্গন থেকে রক্ষা করতে সাড়ে ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ মিজান বাঁধ নামে একটি বেড়িবাধ নির্মাণ করে, কিন্তু নদীর ক্রমাগত ভাঙ্গনের ফলে ওই বাঁধেরই প্রায় ১ কিঃমিঃ বিলীন হয়ে গেছে। বর্তমানে এলাকার প্রায় অর্ধশত পরিবার মিজান বাঁধের উপরে বসতি স্থাপন করে মানবেতর দিন কাটাচ্ছে। আবার অনেকে অন্যত্র চলে গেছেন।
মুহুরী এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা মোঃ মোকছেদ আলম জানান, ৫ বছর আগেও নদীটি অবস্থান প্রায় অর্ধ কিঃমিঃ পূর্বদিকে ছিল এখন ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে পশ্চিম দিকে চলে এসেছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন