সেই নেইমারেই ব্রাজিলের স্বপ্নপূরণ
স্পোর্টস ডেস্ক : টাইব্রেকারের প্রথম চারটি করে শটই জালে পাঠালো দু’দল। জার্মানির নিল পিটারসেনের নেওয়া পঞ্চম শট ঠেকিয়ে দিলেন গোলরক্ষক ওয়েভারটন। ব্রাজিলের সামনে হিসাবটা তখন সহজÑ গোল কর, আর জিতে নাও অলিম্পিকের সেই অধরা স্বর্ণ পদক। এমতাবস্থায় কোনই ভুল করলেন না নেইমার। বল জালে পাঠিয়ে মারাকানার ৭৮ হাজার ব্রাজিল সমর্থকদের মাতালেন ৫-৪ গোলের বিজয়োল্লাসে।
গোল করেই মাঠে শুয়ে পড়ে কেঁদেছেন নেইমার। ঠিক যেমনটা করেছিলেন লন্ডন অলিম্পিকের ফাইনালের পর। কিন্তু সেই আর এই কাঁদায় কত ফারাক। সেদিন তিনি ছিলেন পরাজিত দলে। এবার তিনি বিজয়ী দলের প্রধান সেনাপতি। এবার তিনি কেঁদেছেন ফুটবলে ব্রাজিলিয়ানদের অলিম্পিক দুঃখকে মুছে দেওয়ার মত গর্বের বেদনায়।
একে তো অলিম্পিকের প্রথম স্বর্ণ, এরপর প্রতিপক্ষ জার্মানি। উদযাপনটাও তাই পেল বাঁধনহারা মাত্রা। এই জার্মানির কাছেই যে গেল বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ঘরের মাঠে ৭-১ গোলের লজ্জা পেয়েছিল ব্রাজিল। রিও’র ফাইনাল ম্যাচকে ঘিরে তাই ব্রাজিল জুড়ে অধরা অলিম্পিক স্বর্ণের চেয়ে একটা শব্দই উচ্চারিত হয়েছে বেশিÑ ‘প্রতিশোধ’। ১২০ মিনিট নাটকের পর তাই মুহুর্মুহু গর্জনে কেঁপে ওঠে মারাকানা স্টেডিয়াম।
১৯৮৪, ১৯৮৮ সালের পর গত লন্ডন অলিম্পিকেও ফাইনালে খেলেছিল ব্রাজিল। কিন্তু ৫ বারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের প্রতিবারই ফিরতে হয়েছে রুপালী পদক নিয়ে। এবার সেলেসাওদের স্বপ্নটা সোনালী রঙে রাঙিয়ে দিলেন একজন নেইমার। অথচ কত গঞ্জনাই না তাকে সইতে হয়েছিল আসরে নড়বড়ে শুরু করার পর। প্রথম দুই ম্যাচে দুর্বল প্রতিপক্ষের সাথে গোলশূণ্য ড্র। পরের ম্যাচে নেইমারের সাথে স্বরুপে ফেরে তার দলও। এরপর নেইমারের তালেই নেচেছে ব্রাজিল দলও। মারাকানায় পরশু রাতে তার নেওয়া ফ্রি-কিকেই এগিয়ে যায় ব্রাজিল। ব্রাজিল অধিনায়কের এটি টুর্নামেন্টের চতুর্থ গোল। দুই দলের গোল মিসের মহড়ার ম্যাচে বিরতির পর পরই অধিনায়ক ম্যাক্সিমিলান মেয়ার্সের গোলে সমতায় ফেরে জার্মানরা। এরপরও ততোধিক গোলের সুযোগ পেয়েছিল দুই দল। কিন্তু ফরোয়ার্ডদের ব্যর্থতায় দেখা মেলেনি গোলের। প্রথমার্ধেই জার্মানদের নেওয়া তিন তিনটি শট ফিরে আসে পোস্টে লেগে। নির্ধারীত সময় ১-১ সমতায় শেষ হলে ম্যাচ গড়াই অতিরিক্ত সময়ে। এই পর্বও শেষ হয় গোল মিসের মহড়ায়। ফলে ম্যাচ গড়াই টাইব্রেকারে। সেখানেও নায়ক হয়ে থাকলেন নেইমার। টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ের পাহাড়সম চাপের তকমা নিয়ে নড়বড়ে যাত্রা শুরু করে শেষটা করলেন স্বপ্নের মত। তার গোলেই জয় নিশ্চিত হয় ব্রাজিলেন।
আসরের শুরুতে সমালোচনাও শুনতে হয় নেইমারকে। জয়ের রাগে আরে ক্ষোভে পর সেই সব সমালোচকদের উদ্দেশ্যে নেইমার বলেন, ‘এবার নিজেদের থুথু নিজেরাই গেল! ব্রাজিল অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন।’ জীবনের শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত হিসেবে এই মারাকানাকেই বেছে নিলেন নেইমার, ‘এটি আমার জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত।’
সংবাদ সম্মেলণে আরো একটি অপ্রত্যাশিত ঘোষনা দিয়েছেন ব্রাজিল অধিনায়ক। জাতীয় দলের নেতৃত্ব ছেড়ে দিতে চান তিনি। ২৪ বছর বয়সী বার্সেলোনা তারকা বলেন, ‘অধিনায়ক হওয়াটা সম্মানের, কিন্তু আজ থেকে আমি নেতৃত্ব ছাড়ছি। আমি (জাতীয় দলের কোচ) তিতেকে একটা বার্তা দেব যে, এখন থেকে তিনি আরেকজন অধিনায়ক খুঁজতে পারেন।’ ২০১৪ সালে ঘরের মাঠে বিশ্বকাপ ব্যর্থতার পর দ্বিতীয় মেয়াদে ব্রাজিল দলের দায়ীত্ব নিয়ে নেইমারকে অধিনায়কত্ব দেন কোচ দুঙ্গা।
ব্রাজিলের এই অর্জনের সাথে অতপ্রতভাবে জড়িয়ে গেল আরো একটি নামÑ ওয়েভারটন। অলিম্পিকের আগে ক’জনই বা চিনত এই গোলরক্ষককে। ব্রাজিল দলে তার জায়গা পাওয়াটাও ছিল নাটকীয়। নিয়মিত গোলরক্ষক ফার্নান্ডো গ্রাস চোটে পড়ালে বদলি হিসেবে দলে ডাক পান ওয়েভারটন। তিনি নিজেও অলিম্পিক দলে ডাক পাওয়ায় বিষ্মিত হয়েছিলেন। সেই তিনিই হয়ে থাকলেন ব্রাজিলের জয়ের অন্যতম নায়ক। পুরো টুর্নামেন্টে মাত্র একবার তাকে ফাঁকি দিয়ে বল জড়ায় জালে। আর ফাইনাল ম্যাচে তো তিনি ছিলেন ‘চীনের প্রাচীর’। এ কারণে অনেকের মতে রিও’র এই অলিম্পিক ব্রাজিলিয়ানরা মনে রাখবে উসাইন বোল্ট বা মাইকেল ফেল্পসের কারণে নয়। এমনকি পোল ভল্টে ব্রাজিলকে অনাকাঙ্খিত স্বর্ণ এনে দেওয়া ব্রাজ ডি সিলভা বা জুডোর নায়ক রাফায়ালাও নয়, মনে রাখবে প্রায় অচেনা ওয়েভারটনের কারণে।
ওদিকে তৃতীয় স্থান নীর্ধারনী ম্যাচে হন্ডুরাসকে ৩-২ গোল হারিয়ে ব্রোঞ্জ জিতেছে নাইজেরিয়া। রিও অলিম্পিকে এটি নাইজেরিয়ার একমাত্র পদক।
এদিকে, জঙ্গি হামলার ভয়, জিকা ভাইরাস, নিরাপত্তা শঙ্কা, প্রস্তুতির ঘাটতি, অপ্রতুল ব্যবস্থাপনাসহ নানা প্রতিবন্ধকতাকে সঙ্গী করে শুরু হয়েছিল রিও অলিম্পিক। সবকিছু ফেলে ‘সফলভাবে’ শেষ হয়েছে ব্রাজিলে প্রথমবার আয়োজিত অলিম্পিক গেমস। বিখ্যাত মারাকানা স্টেডিয়ামের সমাপনী অনুষ্ঠানে রিও ডি জেনিরিও মেয়র এডওয়ার্ডো পায়েস ২০২০ সালে পরবর্তী আসরের আয়োজক টোকিওর গর্ভনর ইউরিকো কোইকির কাছে অলিম্পিকের মশাল হস্তান্তর করেন। প্রথা মেনে অলিম্পিকের শেষ ইভেন্ট ম্যারাথন দৌড়বিদদের স্টেডিয়ামে প্রবেশের সাথে সাথেই নিভে যায় প্রথম দিন প্রজ্জ্বলিত অলিম্পিক মশাল। যার সাথে সাথে বিদায়ের করুণ সুরে বাজে বিউগল, সাঙ্গ হয় ক্রীড়াবিদদের মিলনমেলা। শুরু হবে অপেক্ষা চারটি বছরের, টোকিও অলিম্পিকের।
এবারের একত্রিশতম আসরে ২০৭টি দেশের প্রায় ১১ হাজারেরও বেশি ক্রিড়াবিদ অংশ নিয়েছিলেন ৩০৬টি স্বর্ণের জন্য। গতকাল পর্যন্ত ৩৮টি স্বর্ণ পেয়ে সবার উপরে আছে যুক্তরাষ্ট্র। বলা যায় তারাই শীর্ষে থাকবে। কারণ শেষ দিন ১২টি স্বর্ণের নিষ্পত্তি হলেও যুক্তরাষ্ট্রকে টলানো যাবে না। দ্বিতীয় স্থানে থাকা জামার্নির স্বর্ণ সংখ্য ২৪টি। এবার নিয়ে ১৬বার অলিম্পিকে সেরা হলো যুক্তরাষ্ট্র। আর আক্ষেপে থাকা ফুটবলের স্বর্ণটিও স্বচেয়ে বড় প্রাপ্তি হিসেবে ধরা দিলো রিওর অলিম্পিকে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন