ড. গুলশান আরা
নজরুল কাব্যে যৌবনের দুটো দিক- বিদ্রোহ ও প্রেম। দুটি স্ববিরোধী নয় একে অন্যের পরিপূরক। উদ্দীপনামূলক কবিতা নজরুলের নতুন সৃষ্টি। প্রেমের কবিতায় তিনি ধরাবাঁধা পথেই চলেছেন। তবুও অন্যান্য কবির কবিতা থেকে নজরুলের কবিতা একটি স্বতন্ত্র। দেহগত আবেগকে তিনি কবিতায় স্বীকৃতি দিয়েছেন। অমানবীর সঙ্গে নিরুদ্দেশ যাত্রা করেননি। রক্ত-মাংসে গড়া প্রেয়সীর সঙ্গেই তাঁর প্রেম।
কবির ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, প্রেমের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম হৃদয়ানুভূতির বিচিত্র প্রকাশ ঘটেছে পূজারিণী ‘চৈতি হাওয়া’ এই সব কবিতায়।
সুদীর্ঘ কবিতা ‘পূজারিণী’ এই কবিতায় প্রেম সম্পর্কিত সব ধারণাই ব্যক্ত হয়েছে। যেমন (১) পূর্ব স্মৃতি। পূর্ব রাগ-সেই পুণ্য গোমতীর কূলে-
প্রথম উঠিল কাঁদি- অপরূপ ব্যথা- গন্ধ- নাভি পদ্মমূলে।
(২) জ্বালাময় স্মৃতি। সুখ স্মৃতি। অনুরাগ-
মনে পড়ে বসন্তের শেষে আসা
ম্লান মৌন সেই নিশি
যে দিন আমার আঁখি ধন্য হলো তব
আঁখি চাওয়া সনে মিশি।
(৩) সাধনা/ নিবেদন
ইস্ট মম জপমালা ঐতব সবচেয়ে
মিষ্টি নাম ধরে।
(৪) অতৃপ্তি-
কাঁদে বুকে উগ্রমুখে যৌবন জ্বালায় জাগা অতৃপ্ত বিধাতা।
(৫) অশান্তি-
চিৎকারিয়া ফেরেতাই- কোথা যাই
কোথা গেলে ভালবাসাবাসি পাই।
(৬) যন্ত্রণা-জ্বালা-
চোখ পুরে লাল নীল কত রাঙা অবছায়া ভাসে
কোথা হতে কেন এই মৃগ-মদ-গন্ধ ব্যথা আসে?
(৭) উপলব্ধি-
কুস্তরী হরিণ সম
আমারি নাভির গন্ধ খুঁজে ফেরে
গন্ধ-অন্ধ-মন-মৃগসম!
(৮) অপূর্ণ তৃষ্ণা-
অনন্ত, অগস্ত্য তৃষাকুল বিশ্বমাগা যৌবন আমার
একসিন্ধু শুষি বিন্দুসম মাগে সিন্ধু আর।
(৯) আকাক্সক্ষা-
মোর চেয়ে স্বেচ্ছাচারী দুরন্ত দুর্বার
কোথা গেলে তারে পাই-
যার লাগি এত বড় বিশ্বে মোর নাই শান্তি নাই।
(১০) প্রতি নায়িকার মর্মভেদী কান্না/অবহেলায় গুমড়ে মরা/
অবহেলা বেঁধা বুকে নিয়ে এ যেন রে-
অতি অন্তরালে ললিতার কাঁদা।
(১১) সর্বত্র প্রেমময় বোধ
খুঁজে ফিরি কোথা হতে এই ব্যথাতুর
মদ-গন্ধ আসে-
আকাশ-বাতাস-ধরা কেঁপে কেঁপে
ওঠে শুধু মোর তপ্ত ঘন দীর্ঘ শ্বাসে।
(১২) উপেক্ষা/আক্ষেপ-
বিশ্বযারে করে ভয় ঘৃণা অবহেলা
ভিখারিণী! তারে নিয়ে এ কি তব অকরুণ খেলা?
(১৩) অনুসূচনা
যে পূজা পূজিনি আমি ¯্রষ্টা ভগবানে
যারে দিনু সেই পূজা-সে-ই আজ প্রতারণা হানে!
(১৪) প্রতিহিংসা/প্রত্যাখ্যান-
এরা দেবী, এরা লোভী যত পূজা পায়
এরা চায় তত আরো
ইহাদের অতিলোভী মন-
একজনে তৃপ্ত নয় এক পেয়ে সুখী নয়
যাচে বহুজন।
(১৫) সান্ত¡না-
অশান্ত অতৃপ্ত চির স্বার্থপর লোভী,
অমর হইয়া আছে রবে চিরদিন
তব প্রেমে মৃত্যুঞ্জয়ী
ব্যথা বিষে নীলকণ্ঠ কবি!
এখানে পূজারিণী স্বয়ং নজরুল, প্রেমিকা দেবতা। পূজারিণীর পবিত্র মূর্তি এঁকেছেন কবি। সুফি সাধকরা যেমন ঈশ্বরের নাম জপ করে সরাসরি তার কাছে যেতে বা পেতে চান, নজরুলও সেভাবে প্রিয়াকে ইষ্ট নাম করে জপ করেছেন। ইষ্ট মম জপমালা ঐ তব সবচেয়ে মিষ্টি নাম ধরে। স্মৃতির ভারে নুয়ে পড়া কবি তাঁর চেতনায় তখনো সরল সুখী আমি-ফোটেনি যৌবন মম...’
আধ-ঘুমে আধ-জেগে তখনো কৈশোর/ জীবনের ফোটা ফোটা রাঙা নিশিভোর। কৈশোর যৌবনের মাঝামাঝি সময়ের প্রেমের সরল সুখ এখানে লক্ষ্যণীয়। এ যেন কবির প্রথম প্রেমের আনন্দ বেদনার স্মৃতি।
নজরুলের প্রেমর কবিতা আগাগোড়া অশ্রুসজল আগাগোড়াই কান্না। অভিমানী প্রেমিকের গাঢ় ঘন বেদনার জৈবিক প্রকাশ কবিতাটির বিভিন্ন ছত্রে ঝরে ঝরে পড়েছে। তিনি তাঁর প্রেমিকার সম্ব^ন্ধে যেসব বিশেষণ ব্যবহার করেছেন বিজয়িনী, পূজারিনী, অভিমানী আবেগের আতিশয্যে তা ভিখারিণী হয়েছে। কোন বিশেষ নামে ডেকেও তিনি তৃপ্তি পাচ্ছেন না। পুরাণ থেকে পদাবলী থেকে নাম বেছে নিয়েছেন রাধা সীতা উমা তাপস বালিকা। শুধু নায়িকারাই নয়, প্রতি নায়িকারাও এসেছেন অশ্রুসিক্ত চোখে। ললিতার নিভৃতে অতি অন্তরালে কাঁদা, উমার কান্না, তাপস বালিকা শকুন্তলার হৃদয় ভেজা কান্না সব মিলে এক বিষাদ, বিষণœ হৃদয় হাহাকার করা অবস্থা।
সেই পুণ্য গোমতীর কূলে
প্রথম উঠিল কাঁদি অপরূপ ব্যথা-গন্ধ-নাভি পদ্মমূলে।
গোমতীকূলের ছোট্ট কুটিরে প্রেমের প্রথম অনুভবকে তিনি পুরাণের কিংবদন্তীর প্রেমের সঙ্গে মিশিয়ে একাকার করে দিয়েছেন। বর্তমান বিরহের সঙ্গে অতীত বিরহের সামঞ্জস্য এনেছেন।
ব্যক্তিগত আবেগ-প্রকৃতির আবেশের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। তাই যৌবনের ক্রন্দন আকাশে বাতাসে নিসর্গের সবখানে শুনতে পাচ্ছেন-
‘খুঁজে ফিরি, কোথা হতে এই ব্যথা ভরাতুর মদ-গন্ধ আসে আকাশ বাতাস ধরা কেঁপে কেঁপে ওঠে শুধু মোর তপ্ত-ঘন-দীর্ঘশ্বাসে।’
তপ্ত-ঘন-দীর্ঘশ্বাসের দ্বারা পুরো ব্যাপারটা ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য করা হয়েছে। আবেগক্রমশ: আরো ঘন আরো রক্তিম হয়ে এসেছে। লাল, নীল রং দিয়ে চেতনাকে রঙিন করেছেন কবি। ‘চোখ পুরে লাল, নীল কত রাঙা আবছায়া ভাসে।’
অতৃপ্তি, অশান্তি, অপূর্ণতা নজরুলের প্রেমের কবিতার এক বিশেষ দিক। নজরুল এই যন্ত্রণাকে লালন করেন। এটা রোমান্টিক বিলাস হলেও এর থেকে বিচ্ছিন্ন হবার ইচ্ছা তাঁর নেই। কারণ যৌবনের বিধাতাও অতৃপ্ত নজরুলও অতৃপ্ত! ‘কাঁদে বুকে উগ্রসুখে যৌবন জ্বালায় জাগা অতৃপ্ত বিধাতা।’
না পাওয়া প্রিয়ার জন্য যে নিদারুণ অশান্তি তা ‘পূজারিণী’ কবিতায় সর্বত্র। না পাওয়ার বেদনা এখানে বিমূর্ত বেদনায় রূপ নিয়েছে- প্রেমের জ্বালাময় অনুভূতি চিৎকারে রূপান্তরিত হয়েছে-
‘চিৎকারিয়া ফিরি তাই “কোথা যাই,
কোথা গেলে ভালবাসাবাসি পাই।”
ভালবাসা পেলেও কি তিনি তৃপ্ত? না-নিজেই স্বীকার করেছেন-
“অনন্ত অগস্ত্য তৃষ্ণাকুল বিশ্বমাগা যৌবন আমার
এক সিন্ধু শুষি বিন্দু সম মাগে সিন্ধু আর।”
যে কথাটি বারবার এই কবিতায় ব্যবহৃত হয়েছে তা হচ্ছে বেদনার গন্ধ। গোমতীকূলের স্মৃতিবিজড়িত বেদনার গন্ধ কবিকে বিচলিত করেছে। প্রেমের অপূর্ণ বেদনাকে বুকে নিয়ে তিনি ছুটে ফিরছেন সেই প্রিয়ার খোঁজে যেজন তাঁর চেয়েও দুরন্ত। যাকে না পেয়ে কবি অশান্তিতে ভুগছেন-
‘মোর চেয়ে স্বেচ্ছাচারী দুরন্ত দুর্বার!
কোথা গেলে তারে পাই-
যার লাগি এতবড় বিশ্বে মোর নাই, শান্তি নাই।’
এই আফসোস- এই আক্ষেপ ব্যর্থ প্রেমিকের জন্য পাঠকের মনে বেদনার অনুরণন জাগায়। সত্যিই তো ‘বিশ্ব যারে করে ভয় ঘৃণা অবহেলা,
ভিখারিণী! তারে নিয়ে একি তব অকরুণ খেলা!’
বৌদ্ধ ভিক্ষু যেভাবে প্রেমের জন্য বের হন কবিও তেমনি উপবাসীর মত দ্বার হতে দ্বারে প্রিয়াকে খুঁজছেন। এমন এক প্রিয়াকে তিনি চান যে তাঁকে প্রত্যাখ্যান করবে না। তাঁর সঙ্গে প্রতারণা করবে না। কিন্তু তিনি যাদের দেখেন তাদের চিনতে বা বুঝতে পারেন না। সন্ধান পেলেও পরিপূর্ণভাবে পান না।
‘যে পূজা পূজিনি আমি ¯্রষ্টা ভগবানে
যারে দিনু সেই পূজা সে-ই আজি প্রতারণা হানে!’
এখানেই নজরুলের প্রেমের কবিতার ট্র্যাজেডি। অতৃপ্ত যাযাবর প্রেমিক নিত্যযাত্রী-গৃহসুখ তার অসহ্য। তাই প্রেমিকার শত উপেক্ষা সত্ত্বেও তিনি পাষাণ প্রিয়ার প্রেমের রাজ্যে বিরাজ করতে আগ্রহী।
‘পূজারিণী’ কবিতায় নারী চরিত্রের আরেকটি দিক তুলে ধরেছেন-
“এরা দেবী, এরা লোভী, যত পূজা পায়
এরা চায় তত আরো-
ইহাদের অতিলোভী মন একজনে তৃপ্ত নয়
এক পেয়ে সুখী নয় যাচে বহুজন।”
নারীসম্পর্কিত নজরুলের এ উক্তিতে আমরা বিচলিত না হয়ে পারি না। হয়তো এটি ব্যর্থ প্রেমিক নজরুলের উক্তি। কারণ কবি নজরুল নারীকে পূজা করেছেন-নারী সঙ্গ কামনা করেছেন। এ জন্যই দেখি প্রাণের শেষ চাওয়া দিয়ে বিশ্ব বিদ্রোহীর নৈবেদ্য দিয়ে এক নারীর প্রেমই তাঁর কাম্য যার প্রেমে তিনি হবেন মৃত্যুঞ্জয়ী কবি।
‘অশান্ত অতৃপ্ত চির স্বার্থপর লোভী-
অমর হইয়া আছে-রবে চিরদিন
তব প্রেমে মৃত্যুঞ্জয়ী
ব্যথা বিষে নীল কণ্ঠ কবি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন