ড. আশরাফ পিন্টু
কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা ও গান যতটা পঠিত, আলোচিত ও প্রচারিত নাটক ততটা আলোচিত ও প্রচারিত নয়। তার নাটক অনেকটা উপেক্ষিতও বটে। নজরুলের নাটক/নাটিকার তেমন পরিচয় সাধারণ পাঠকের জানা নেই। তার মোট ১১টি নাটক/নাটিকার মধ্যে ৪টি প্রতীকধর্মী (ঝিলিমিলি, সেতুবন্ধ, শিল্পী ও ভুতের ভয়), ২টি গীতিনাট্য ধর্মী (আলেয়া ও মধুমালা), ২টি চরিতমূূলক (বিদ্যাপতি ও বিষ্ণু প্রিয়), ২টি বেতার নাটক (ঈদ ও বিজয়া) এবং একটি শিশুতোষ নাটিকা (পুতুলের বিয়ে)। “পুতুলের বিয়ে” প্রকৃতপক্ষে নাটিকা নয় একাঙ্কিকা। নাটিকা যেমন নাটক থেকে ছোট পরিসরের; তেমনি একাক্সিককা নাটিকা থেকে আরো ছোট পরিসরের। নাটক বা নাটিকায় একাধিক অঙ্ক ও দৃশ্যে ভাগ থাকে কিন্তু একাঙ্কিকায় দৃশ্য একাধিক থাকলেও অঙ্ক থাকবে একটি। এই দৃষ্টিকোণ থেকে নজরুল ইসলামের “পুতুলের বিয়ে ”- নাটিকা বলা চলে না। সে যাই হোক, নাটক, নাটিকা, একাঙ্কিকা একই পরিবারের সদস্যÑ অনেকটা দাদা, বাবা, ছেলের মতো। নজরুলের “পুতুলের বিয়ে” নাটিকা না একাঙ্কিকা তা আমার বিচার্য বা আলোচ্য বিষয় নয়। আমার আলোচ্য বিষয় হল নজরুলের “পুতুলের বিয়ে”-এর স্বরূপ উন্মোচন করা।
গ্রামীণ সমাজের ছেলেমেয়েরা যে চিন্তা চেতনায় আবদ্ধ “পুতুলের বিয়ে ”-এর শুরুটা ঠিক তেমনটি ভাবেই হয়েছে। লৌকিক জীবনযাত্রায় স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই বিভিন্ন লৌকিক উপাদান উপকরণ ব্যবহৃত হয়ে থাকে। পোশাক আশাক, চলাফেরা, কথাবার্তা এসব উপকরণ ওতপ্রোতভাবে সম্পর্ক যুক্ত গ্রামীণ সমাজের ছেলেমেয়েরা অকৃত্রিম ভাবেই এই লৌকিক পরিবেশে বেড়ে ওঠে। নজরুল ইসলামের “পুতুলের বিয়ে” -তে তেমনি অকৃত্রিম লৌকিক জীবনের পরিচয় পাওয়া যায় লোকছড়া ব্যবহারের মধ্যে দিয়েÑ
কমলি : পুটু নাচে কোন খানে
শতদলের মাঝখানে।
সেথায় পুটু কি করে?
ডুব গালিগালি মাছ ধরে।
কিংবা-
আয়না আয়না আয়না
সতীন যেন হয় না
উদবেড়ালি ক্ষুদ খায়
স্বামী রেখে সতীন খায়।
শিশুতোষ এই লোকছড়াটির মধ্যে কবির বহুবিবাহ বিরোধী চেতনা স্পষ্ট। শিশুদের মানস গঠনে কবি সচেতন ভাবেই “পুতুলের বিয়ে” -তে ছড়াগুলো সংযোজন করেছেন। এমন আরেকটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যায় বেগমের সংলাপের মধ্যদিয়ে। মুসলিম সমাজে অতীতে যে বাল্য বিবাহ প্রচলিত ছিল তাও স্পষ্ট হয়েছে বেগমের কথায়। কবি এখানেও সচেতন ভাবে বাল্যবিবাহ বিরোধী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছেন বেগমকে। কমলি যখন বলেÑ আট বছরের মেয়ে আবার বিবি হবে তখন বেগম ছড়া কেটে প্রতি উত্তর দেয়Ñ
মা গো মা
আমি বিবি হব না
আম কুড়াবো, জাম কুড়াব
কুড়াবো শুকনো পাতা...
এই নাটিকায় গীতিধমির্তা প্রাধান্য পেয়েছে। এর প্রায় অর্ধাংশ জুড়ে আছে লৌকিক ছড়া ও গান। অন্যান্য নাটিকাগুলোতেও এই গীতিধর্মিতা লক্ষ্যণীয় নজরুলের কবিত্ববোধ যেন অনিবার্য ভাবেই যুক্ত হয়েছে তার নাটক-নাটিকাগুলোতে। তবে নাটক গুলো এতে রসোত্তীর্ণ হয়েছে। “পুতুলের বিয়ে”-তে রসোত্তীর্ণতার পাশাপাশি এর চরিত্রগুলোকে কিছুটা উদ্দেশ্যমূলক ভাবে সচেতন করে নির্মাণ করেছেন কবি। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও সমালোচনা আব্দুল হকের মন্তব্যটি প্রণিধানযোগ্য-“এই নাটিকার সংলাপ রচনায় এবং চরিত্র ও পরিস্থিতি নির্মাণে অনেকটা শিল্পকর্মের পরিচয় পাওয়া যায়। এটি গীতিপ্রধান ও কিঞ্চিত উদ্দেশ্যমূলক নাটিকা হলেও এর চরিত্রদের আচারণে ও সংলাপে ব্যত্তিÑস্বাতন্ত্র্যের পরিচয় সুস্পষ্ট এবং এর রূপকর্ম অনায়াস সাধিত।”
পুতুলের বিয়েতে লোকছড়ার সঙ্গে লৌকিক জীবনের অন্যান্য অনুষঙ্গ রূপকথা ও প্রবাদের ব্যবহারও লক্ষ্য করা যায়। রূপকথার ব্যবহার দেখা যায় বেগমের সংলাপেÑ
সেকি ভাই! কমলির ডালিম কুমার যে আমার জামাই হবে বলে কথা দিয়েছিল।
অন্যত্র প্রবাদের ব্যবহারÑ
খেঁদি : মাগো, বুড়ার ভীমরতি হয়েছে খ, কুঁজার আবার সাধ যায় চিত হয়ে শুতে খ।
হাস্যচ্ছলে পুরুতের কুসংস্কার আর কূপ-ুকতাকেও কটাক্ষ করা হয়েছে পুতুলের বিয়েতে। টুলি যখন বলে-
হ্যাঁ ঠাকুর মশাই বর হচ্ছে চীনে আর কনে হচ্ছে জাপানী।
তখন পুরুত বলে-
তাহলে ঐ কমলির দাদাই ওদের পুরুত হোক ওসব যাববিক অনুষ্ঠান আমার জানা নেই। এরপর মণি আরসোলা, টিকটিকি, সোনাব্যাঙ, কেঁচো ইত্যাদি প্রাণীর ভোজের কথা বললে পুরুত তো ‘হরে কৃষ্ণ’ বলে গঙ্গাস্নানের জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
তখন মণি বলেÑ
তা তো হবে, কিন্তু ঠাকুর মশাই, এখানে গো-বর তো পাওয়া যায় না, খানিকটা নর-বর এনে দেবো?
পুরুতকে কটাক্ষ করে সচেতন ভাবে যেমন হাস্যরসের সৃষ্টি করা হয়েছে তেমনি অনাবিল নির্দোষ হাসি-আনন্দও আছে পুুতুলে বিয়েতে। যেমন মণি মন্ত্র পড়ছেÑ
ওয়ানং মর্নং আই মেটং এলেমং ম্যানং
ক্লোজং টু মাই ফার্মং।
কাজী নজরুল ইসলাম পরিপূর্ণভাবে একজন সাম্যবাদী চেতনার মানুষ ছিলেন। হিন্দুÑমুসলমান সংস্কৃতিকে তিনি একসূত্রে গ্রোথিত করেছেন তার বিভিন্ন কবিতা ও গানে। এই অসম্প্রদায়িক সাম্যবাদী চেতনা আমরা শিশুতোষ নাটিকা পুতুলের বিয়েতেও দেখতে পাই।
খেঁদি ও কমলির কথোপকথনের মধ্যাদিয়ে এই সাম্যবাদী অসম্প্রদায়িক চেতনা পরিস্ফুটিত হয়েছেÑ
খেঁদি : আচ্ছা ভাই, মুসলমানের পুতুলের সাথে তোর পুতুলের বিয়ে হবে কি করে?
কমলি : না ভাই, ও কথা বলিস নে। বাবা বলেছেন হিন্দু মুসলমান সব সমান। অন্যধর্মের কাউকে ঘৃণা করলে ভগবান অসন্তুষ্ট হন। ওদের আল্লাহও যা, আমাদের ভগবানও তা।
নাটকের পরিসমাপ্তিতে দেখা যায় বিয়ের দুটি গান গাওয়া হয়েছে মুসলমান ও হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় সঙ্গীত দিয়েÑ
শাদী মোবারক শাদী মোবারক
দেয় মোবারকবাদ আলম রসুলে
পাক আলাহ হক।
(বেগমের গান)
আর টুলি গেয়েছেÑ
সাবিত্রী সমান হও, লহ লহ এই আশিস
শ্বশুর-শাশুড়ির মা-বাপের কুলের তারা হয়ে হাসিস
লও লও এই আশিস।
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে হিন্দু মুসলমানকে একসূত্রে গ্রোথিত করার জন্যে কবির সেই বিখ্যাত কবিতাÑ
মোরা একবৃন্তে দুটি ফুল হিন্দু-মুসলমান
মুসলিম তার নয়ন মণি হিন্দু তার প্রাণ।
শিশুদের জন্যে অভিনয় উপযোগী এমন নাটিকা বাংলা সাহিত্যে বিরল। শিশুদের পুভুল খেলাচ্ছলে অনাবিল হাস্যরসের মধ্যদিয়ে ধর্মীয় গোঁড়ামি, কূপম-ুুকতা ইত্যাদি পরিহার পূর্বক অসাম্প্রদায়িক সমাজ গঠনের যে চেতনা “পুতুলের বিয়ে”Ñতে লক্ষ্য করা যায় তা নজরুলের সাম্যবাদী চেতনারই প্রভাবজাত। একই সাথে লোকসংস্কৃতি পরিবেষ্টিত। যে গ্রামীণ সমাজ তারও নিটোল চিত্র পাওয়া যায় এখানে। পরিশেষে বিশিষ্ট নজরুল গবেষক ও সমালোচক মোবাশ্বের আলীর সঙ্গে একমত হয়ে বলা যায়-“ বর্ষীয়নী সুলভ আচরণ, খেঁদির সাঁওতাল ও পঞ্চির ঢাকাই সংলাপ, বিবাহের কৌতককর ছড়া ও গীত সংযোজন ইত্যাদির ফলে নাটিকাটিতে স্নিগ্ধ অনাবিল হাস্যরস সঞ্চারিত হয়েছে। ফলে নাটিকাটি শিশুদের জন্যে অত্যন্ত উপভোগ্য হয়ে উঠেছে।”
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন