বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সাহিত্য

করুণ রসে নজরুলের কবিতা ও গান

প্রকাশের সময় : ২৬ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মুস্তাক মুহাম্মদ
সত্য যে কঠিন কঠিন, কঠিনেরে ভালবাসিলাম সে কখনো করে না বঞ্চনা” মৃত্যু সম্পর্কে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উক্তি। সত্য মানে মৃত্যু সবচেয়ে কঠিন আর কঠিনকে ভালোবাসতেই হবে ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক।  পৃথিবীতে এমন কোনো প্রাণী নেই এই সত্যকে এড়িয়ে যেতে পারে। প্রাণী মাত্রই মৃত্যু বরণ করবে; এই অমোঘ সত্যকে আমাদের মেনে নিতেই হবে। পরপারের চিন্তা মানুষ মাত্রই আসে। মানুষ যখন দুর্বল হয়ে যায় তখন সে চিন্তা আরও প্রখর হয়। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯Ñ১৯৭৬) সব কিছুর মধ্যে নব প্রাণের উপস্থিতি দেখেছেন। কিন্তু তিনিও মৃত্যু ভাবনায় ডুব দিয়ে ছিলেন। তার গানে ও কবিতায় সে চেতনা দেখা যায়। মরমী চেতনা ঈশ্বরÑমৃত্যুÑপরকাল নিয়ে ভাবনা অমূলক নয়। বরং তা কল্যাণকর বটেই। কাজীদার কবিতাÑ গানে মৃত্যু বাঁশির সুর আমাদের আবেগ আপ্লুত করে দেয়। মৃত্যুর মাধ্যমে স্থায়ী বিদায় কঠিন তবে তা মানতে আমরা বাধ্য। প্রিয়ার কাছ থেকে সাময়িক বিদায় অথবা চিরকালের বিদায়ের মধ্যে গভীর করুণ রসের উদ্রেগ হয়। বিদায় সাময়িক বা স্থায়ী যেটায় হোক তা বিচ্ছেদ বেদনায় কষ্টের নীল পাথরের মতো। চিরতরের বিদায় তো ভাষাতীত ব্যাপার। বিদায়ের করুণ সুরের টানগুলো আমাদের অশ্রু সাগরে ভাসায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতাÑগানে বিদায়ের সুর যেমন প্রজ্বল তেমনি নজরুলেও। তবে প্রিয়তমা বিদায়ের করুণ তান যেনো নজরুলেই বেশি। কারণ তিনি যথার্থ ভুক্তভোগী। এক্ষেত্রে ইংরেজ রোমান্টিক কবি জন কীটস (১৭৯৫Ñ১৮২) ও নজরুল সমবেদনায় জর্জরিত। দু’জনই অসংখ্য আপনজনের বিদায় দেখেছেন কাছ থেকে। উভয়ই জীবনে অনেক ভুগেছেন। উভয়ের প্রথম ভালোবেসে ঘর বাঁধার আগেই বিচ্ছেদ ঘটেছে। প্রিয়জনদের চিরতরে বিদায়, প্রিয়তমার বিদায়, বিরহ-বেদনায় মধ্যে থেকেও এই দুই মহারথি শব্দের নৈপুণ্যে তা হৃদয়গ্রাহী করে তুলেছেন। এ রকম অসাধারণ মনো দৈহিক বিরূপতার মধ্যে তাদের সৃজনশীল ক্ষমতা, শব্দের অসাধারণ মেলবন্ধনের দক্ষতায় আমরা বিষ্ময়াভূত না হয়ে পারি না। ফ্যানি (কীটসের প্রেমিকা) কীটসকে ছেড়ে যে কষ্ট দিয়েছেন, নার্গিসও নজরুলকে অনুরূপ কষ্ট দিয়েছেন। জনশ্রুতি আছে, অল্প বয়েসে কীটস মারা যাওয়ার আগে বলেছিলেন, ফ্যানির কাছ থেকে যে কষ্ট পেয়েছি তা যদি না পেতাম তাহলে আরও কিছু দিন বেঁচে থাকতে পারতাম। নজরুল সম্পর্কে বলব সেই একই কথা, নার্গিসের কাছ থেকে নজরুল যে কষ্ট পেয়েছেন তা যদি না পেতেন নজরুল ১৯৪৩ সালের পর থেকে বাকপ্রতিবন্ধী (সৃজনশীল কর্ম ব্যতীত এটা মৃত্যুরই সমতুল্য) হয়ে থাকতেন না। কাজীকবি নার্গিসকে হারিয়ে যে বিরহ বেদনায় জ্বলেছেন তা তার গান ও কবিতায় প্রজ্বল। বিরহ বেদনাÑবিদায়ের করুণ আর্তি ধুমকেতু সম্পাদকের প্রকাশিত হৃদকথন। কীটস যেমন ফ্যানিকে আক্ষেপ করেছিলেন, নজরুলও কী নার্গিসকে লক্ষ্য করে এই আক্ষেপ করেছিলেন! “যেদিন আমি হারিয়ে যাব, বুঝবে সেদিন বুঝবে/অস্তপারের সন্ধ্যাতারায় আমার খবর পুঁছবে/বুঝবে সেদিন বুঝবে।” (অভিশাপ)
“রবীন্দ্রনাথের পরে বাংলা ভাষার প্রথম মৌলিক কবি কাজী নজরুল ইসলাম। মৌলিক কাব্য-প্রতিভার ছাপ রেখে গেছেন বলেই মধুসূদন ও রবীন্দ্রনাথের মতোই তিনি যুগ প্রবর্তক কবি হিসেবে স্বীকৃত। ‘বিদ্রোহী কবি’ বলে সমধিক খ্যাত নজরুলের মরমি কবিতা অসংখ্য গজল ও গান আজো পাঠক-শ্রোতাকে সমভাবে আপ্লুত করে রাখে। ধর্মীয় বা শাস্ত্রীয় নির্দেশ ও ব্যাখ্যার বাইরে যে আত্মনিমগ্ন উপলব্ধিÑ যাকে আধ্যাত্মিকতা বলা যেতে পারে, বারে বারে তা প্রকাশ ঘটেছে নজরুল সাহিত্যে এবং তা বাংলা সাহিত্যের এক অপূর্ব সম্পদ। শেষের দিকে তার জীবন ও ভাবধারা যেভাবে অধিকতর আধ্যাত্মিক সাধনা ও গভীরতার দিকে ঝুঁকে পড়েছিল, সুস্থ থাকলে তা যে বাংলা বাংলা সাহিত্যের গুংঃরপরংস-কে আরো সমৃদ্ধ করে তুলতে পারতো, তাতে সন্দেহ নেই।” (দৈনিক নয়া দিগন্ত, শুক্রবার ২০ ডিসেম্বর ২০১৩, মরমী চেতনা : বাংলা কবিতা ও গানে কে জি মোস্তফা)। তার কবিতায় বিদায়ের করুণ সুর বার বার সাইরেনের মত বেজেছে। আর তা আমাদের আপ্লুত করে। বিদায় শব্দটি আমাদের মনকে কেমন জানি নরম করে দেয়। পার্থিব-অপার্থিব প্রয়োজনে সাময়িক বা স্থায়ী বিদায় মানুষকে নিতে হয়। বিদায়ের সময় আমাদের চোখ অশ্রুতে ছল ছল করে। কণ্ঠ নরম হয়ে আসে। বিদায়ের কথা শুনলে আপনা আপনি কাঁন্না চলে আসে। মানুষ পৃথিবীতে দুদিনের মুসাফির। এখানে এসে বিভিন্ন জনের সাথে মায়া নামক এক অদৃশ্য বাঁধনে আমরা বাঁধা পড়ি। বিদায়ের সময় সে অদৃশ্য বাঁধন ছিড়ে যায় বলে মানুষ কাঁদতে থাকে; আহজারি করে। পৃথিবী যদি জন্মের পর আমাদের স্নেহ ভালোবাসায় না জড়াতো তাহলে আমরা বেঁচে থাকতে পারতাম না। তাই বিদায়ের সময় কাঁন্না আসে। কিন্তু বিদায়ের সময় পথিক তুমি কেঁদো না। তুমি হাসি মুখে বিদায় নাও। এমন সব কথার ফুলকলি দেখি বিদ্রোহী কবির “বিদায় বেলা” শিরোনামের কবিতায়। তিনি বিদায়ের গান গেয়েছেন এভাবেÑ “তুমি অমন ক’রে গো বারে বারে জলÑছলÑছল চোখে চেয়ো না,/জলÑছলÑ ছল চোখে চেয়ো না।/ঐ কাতর কণ্ঠে থেকে থেকে শুধু বিদায়ের গান গেয়ো না,/শুধু বিদায়ের গান গেয়ো না॥/ হাসি দিয়ে যদি লুকালে তোমার সারা জীবনের বেদনা,/ আজো তবে শুধু হেসে যাও, আজ বিদায়ের দিনে কেঁদো না।”
বিদায় নেওয়ার সময় হলে আমাদের আর কেউ আটকে রাখতে পারবে না। যদিও বিদায় জানাতে কেউ চায় না। তবু বিদায় জানাতে হয়। চোখের জল মুছে বিদায় দিতে পারে ক’জন? মানুষের জীবনে যৌবন হচ্ছে শ্রেষ্ঠ সময়। এই সময় ফুলের মত বিকাশিত হয়ে সুবাস বিলায় মানুষ। সে সুবাসে সুবাসিত হয় পৃথিবী। বেলা বাড়ার সাথে সাথে ফুল ঝরে যায়। বসন্তকালে ফুল ফোটে। সৌরভ বিলায়ে ঝরে যায়। বর্ষার আনাগোন শুরু হলে ময়ূর পেখম মেলে নাচে। সব কিছু, সব ভালোবাসা ছেড়ে আমাদের তবু বিদায় নিতে হয়। ক্ষণিক ভালোবেসে শুধু স্মৃতি রেখে মানুষ বিদায় গ্রহণ করে। ‘আমার যাবার সময় হল দাও বিদায়’ গীতি কবিতাটি এক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য। কবি করুণ সুরে গেয়েছেনÑ “আমার যাওয়ার সময় হল দাও বিদায়/মোছ আঁখি দুয়ার খোল দাও বিদায়॥/ফোটে যে ফুল আঁধার রাতে/ঝরে ধুলায় ভোর বেলাতে॥/আমায় তারা ডাকে সাথী/ আয়রে আয়/সজল করুণ আঁখি তোলো দাও বিদায়/ অন্ধকারে এসেছিলাম/থাকতে আঁধার যাই চলে/ক্ষণেক ভালোবেসেছিলে চিরকালের নাই হলে/হল চেনা হল দেখা/ নয়ন জলে রইল লেখা/দর বিরহী ডাকে কেকা বরষায়/ ফাল্গুন স্বপন ভোলো ভোলো দাও বিদায়॥”
হ্যাঁ, ভালোবেসে বিরহে নজরুল কেঁদেছেন। তিনি যেনো বিরহের প্রতীক। যদিও তার বিদ্রোহী স্বভাব এত বেশি প্রবল যে তার আড়ালে বিরহী সত্ত্বার অস্তিত্বকে আমরা আমলে নিয় না। কিন্তু তার বিরহী সত্তা আরো বেশি প্রবল। কর্ম মানুষকে বাঁচায়ে রাখে। সৃজনশীল কর্ম আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে। কর্ম ভালো হলে নশ্বর দেহের বিনাশ হলেও মানুষ বেঁচে থাকে। এমন কথার প্রতিধ্বনি শুনি নজরুলের ‘ শিশু যাদুকর’ কবিতায়। তিনি লিখেছেনÑ “তোর নামে রহিলরে মোর স্মৃতিটুক,/তোর নামে রহিলাম আমি জাগরুক।” কত স্পষ্ট ধারণা না ছিল কবির! তিনি জানতেন দেহ পচে যায় যায় কিন্তু সৃজনশীল কর্ম কখনো মরে না। তাই তিনি নতুনের মধ্যে প্রাণ বীজ দিয়ে যেতে চেয়েছেন। জনকল্যাণে জীবনকে উৎসর্গ করে তিনি আমর হয়েছেন। আমাদের ভবিষ্যত আগামী প্রজন্মর জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে এই কর্মী তার (প্রজন্ম) মাঝে নিজের অস্তিত্ব রেখে যেতে চেয়েছেন। শারীরিক বিদায় তিনি নেবেন কিন্তু তিনি আমাদের মধ্যে থাকবেন সৃজনশীল কর্মের মাধ্যমে।
আমরা এই পৃথিবীতে মুসাফির ছাড়া আর কিছুই না। দু’দিনের জন্য পথ চলতে আমরা এসেছি। পথ চলতে চলতে আমরা কতই না মায়ার বাঁধনে জড়িয়ে পড়ছি। মৃত্যু হল পথের শেষ ঠিকানা। মৃত্যু হলে আমরা আর ফিরে আসতে পারব না। পথিক যে পথ তৈরি করে গেল তাই নিয়ে আগামী প্রজন্ম এগিয়ে যাবে। কিন্তু পথিক আর ফিরে আসবে না। ‘পথহারা’ কবিতায় উদাসীন পথিকের মাধ্যমে আমরা এই কথার শাব্দিকরূপ দেখতে পাই। তিনি লিখেছেনÑ “হঠাৎ তাহার পথের রেখা হারায় / গহন বাঁধায় আঁধারÑবাঁধা কারায়,/পথÑচাওয়া তার কাঁদে তারায় তারায়/ আর কি পথের দেখা পাবে / উদাস পথিক ভাবে।”
না, একবার চলে গেলে আর কেউ ফিরে আসে না। পথ পথের জায়গায় থাকে। কিন্তু পথিক আর ফেরে না। পৃথিবীতে আমরা আপন পরিজন নিয়ে বসবাস করি। কিন্তু আমাদের পরকাল আছে। আমরা যেমন পৃথিবীতে আসার সময় একা ছিলাম তেমনি যাওয়ার সময়ও একা যেতে হবে। পরকালে বিশ্বাসীদের জন্য দুনিয়া ফসলের মাঠ। এই মাঠে যে যেমন ফসল ফলাতে পারবে পরকালে সে তেমন ভোগ করবে। সুতরাং নগদ কাজটা আমাদের করতে হবে। সেটা এই দুনিয়াতেই। পৃথিবীকে সুন্দর করাই হচ্ছে সে কাজ। তেমন কথা বলেছেন বিরহ বেদনার কবি নজরুল তার ‘ভৈঁরোÑকাওয়ালী” তে । কয়েকটি পঙিÍ উল্লেখ করছিÑ “পিও শারাব পিও! / তোরে দীর্ঘ সে কাল গোরে হবে ঘুমাতে। / সে তিমিরÑপুরে / তোর বন্ধু স্বজন প্রিয়া রবেনা সাথে।। ” ( নজরুল গীতিকা Ñ ০২ / ১২৮ )
সুন্দরের কবি নজরুল, প্রিয়জন হারানোর বেদনায় কাতর হয়েছেন। প্রিয়জন ছেড়ে চলে গেছে। প্রিয়তমার কাছ থেকে পেয়েছেন বিরহ বেদনা। সব কিছু থেকে বঞ্চিত হয়ে তিনি শোককে শক্তিতে পরিণত করে হয়েছেন বিদ্রোহী। তবে তার বিদ্রোহী সত্ত্বার মধ্যে বিরহী সত্ত্বার অস্তিত্ব ছিল আজীবন। এবং তা প্রবল ভাবেই ছিল। এই জন্য তিনি সহজে ভেঙে পড়তেন না। আটটি বই বাজেয়াপ্ত হলেও তিনি সোজা ছিলেন। কারণ শোক তাপ বেদনায় পুড়ে নজরুল হয়েছিলেন খাঁটি সোনা। নজরুল শব্দকে বশে আনতে পেরেছিলেন। দক্ষ কারিগরের মত তিনি শব্দ নিয়ে কথার মালা সাজিয়েছেন। নজরুলের বিরহ কবিতা-গান আমাদেরকে অন্য ভাবের জগতে নিয়ে যায়। নজরুলের কবিতা ও গানে বারবার করুণ রসের অনুররণ ঘটেছে। এই শক্তির জন্য নজরুল চিরকাল প্রাসঙ্গিক হবেন এ কথা সন্দাতীত বলা যেতে পারে। বুদ্ধদেব বসু যেমন বলেছিলেনÑ “সেÑ কবি শুধুই বীররসের নন, আদিরসের পথে তার স্বচ্ছন্দ আনাগোনা, এমনকি হাস্যরসের ক্ষেত্রেও প্রবেশ নিষিদ্ধ নয় তাঁর। ‘বিদ্রোহী’ কবি, ‘সাম্যবাদী’ কবি কিংবা ‘সর্বহারা’র কবি হিশেবে মহাকাল তাঁকে মনে রাখবে কিনা জানি না, কিন্তু কালের কণ্ঠে গানের মালা তিনি পরিয়েছেন, সেÑ মালা ছোটো কিন্তু অক্ষয়।” (শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ বুদ্ধদেব বসু, সম্পাদনা-বিশ্বজিৎ ঘোষ, ফেব্রুয়ারি ২০০৯, বর্ণায়ন প্রকাশনী)।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন