ওয়েস্ট ইন্ডিজ মানেই ক্রিকেট, আর ক্রিকেট মানেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ। সমগ্র ক্রিকেটবিশ্ব ওয়েস্ট ইন্ডিজকে চেনে শুধুই ক্রিকেটের দেশ হিসেবেই। ক্রিকেটে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সুখ্যাতি বিশ্বজোড়া। একসময় ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিশ্বসেরা তারকারা একচ্ছ্বত্র দাপট দেখিয়ে গোটা ক্রিকেটবিশ্বকে যেভাবে শাসন করেছে তা এখনও ইতিহাসে নজিরবিহীন। তাইতো ইতিহাসের খাতায় এখনও রেকর্ডে অম্লান শুধু ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিজয়গাঁথাতেই।
দেশটির কিংবদন্তি স্যার গ্যারফিল্ড সোবার্স, ল্যান্স গিবস, জর্জ হেডলি, স্যার ক্লাইভ লয়েড, ম্যালকম মার্শাল, স্যার কার্টলি অ্যামব্রোস, কোর্টনি ওয়ালশদের হাত ধরে আসা সেসব সাফল্য আজও ইতিহাসে জ্বলজ্বলে। শুধু তাই নয়, ক্রিস গেইল, ড্যারেন স্যামি কিংবা হালের জেসন হোল্ডার, শাই হোপদের নিয়ে গড়া বর্তমান জাতীয় দলটিও বিশ্বের যে কোনো টেস্ট খেলুড়ে দলের বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিতে পারে যে কোনো মুহূর্তে।
লক্ষ্য ছিলও তাই- একটি প্রতিযোগীতামূলক সিরিজ দিয়েই দেশের ক্রিকেট ফের মাঠে গড়ানোর। উপলক্ষের মঞ্চও ছিল প্রস্তুত। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী আর মুজিববর্ষের আনন্দ তো ছিলোই, তার সঙ্গে বাড়তি পাওনা মহামারীকাল পেরিয়ে এই সিরিজ দিয়েই দীর্ঘ ১০ মাস পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফিরছে বাংলাদেশ। সেই উপলক্ষ্য আরো মহিমান্বিত হয় নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে এদিনই যে প্রত্যাবর্তন হচ্ছে দেশের ক্রিকেটের সবচাইতে বড় বিজ্ঞাপন সাকিব আল হাসানের। সকল উপলক্ষ বিশ্বের সবাচাইতে মারকাটারি ক্যারিবিয়ানদের দিয়েই রাঙানোর প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড। তবে সেটি আর হয়ে ওঠেনি বিসিবির অপরপিক্ক কিছু সিদ্ধান্ত আর নিজেদের খামখেয়ালিপনায়।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের এই সফরটি আক্ষরিক অর্থেই হতে পারতো দেশের ক্রিকেটে অনেক প্রাপ্তির এক উপলক্ষ। আইসিসির ফিউচার ট্যুর প্রোগ্রাম (এফটিপি) হিসেবে সফরে দুটি টি-টোয়েন্টি আর তিনটি করে ওয়ানডে ও টেস্ট খেলবার কথা ছিল উইন্ডিজ দলের। ভারতের মাটিতে এবছরই বসতে যাচ্ছে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পরবর্তি আসর। সেটি মাথায় রেখে সফরে টি-টোয়েন্টি সিরিজটির গুরুত্বই ছিল বেশি। তবে শুরুর আগেই টানা ক্রিকেটের দোহাই দিয়ে ছোট্ট ফরম্যাটের সিরিজটি বাতিল করেছে উইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ড। সেই শর্ত বিসিবিও মেনে নিয়েছে অন্তত ‘ক্রিকেট ফিরুক’ এই মনোভাব থেকেই। তবে এরপর যা হয়েছে সেটি দেশের ক্রিকেটের অভিভাবক সংস্থাটির অপরিপক্কতাই সে জন্য অনেকাংশে দায়ী।
কোভিডকাল পেরিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের ইংল্যান্ড সফর দিয়েই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ফিরেছে মাঠে। সেখান থেকেই তারা সফর করেছে নিউজিল্যান্ডে। সেখানেও তারা দুটি টেস্টের আগে খেলেছে তিন টি-টোয়েন্টি ম্যাচের সিরিজও। তবে বাংলাদেশ সফরের সময় যখন ঘনিয়ে এসেছে ঠিক তখনই বেঁকে বসেছেন দলটির শীর্ষ ১০ ক্রিকেটার। টানা ম্যাচ খেলার ক্লান্তি আর কোভিড পরিস্থিতর দোহাই তুলে বাংরাদেশে আসতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন হোল্ডার, হোপসহ আরো শীর্ষ ৮ ক্রিকেটার। চেষ্টা সত্বেও এদেশে আসতে তাদের রাজি করাতে পারেনি উইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ড, ডবিøউআইসিবির সঙ্গে এ নিয়ে দেনদরবার করেও কোনো সুরাহা করতে ব্যর্থ বিসিবিও। পরিশেষে তাদের তৃতীয় সারির দলকেই স্বাগত জানায় বিসিবি।
যে দলটিতে নিয়মিত খেলোয়াড়দের প্রায় কেউই নেই। ওয়ানডে অধিনায়ক কাইরন পোলার্ড, টেস্ট অধিনায়ক জেসন হোল্ডারসহ শীর্ষ ১২ জন ক্রিকেটার বাংলাদেশে আসেননি। যারা আছে তাদেও কেউ এসেছেন লম্বা বিরতির পর, আর বাকি ৬ জনের অভিষেকই হয়েছে এই সফরে। বাকি যে পাঁচ জনের আছে ওয়ানডে খেলার অভিজ্ঞতা, তারাও খুব বেশি ম্যাচ খেলেননি, সব মিলিয়ে কেবল ১০৫টি। সাকিব একাই খেলেছেন তাদের প্রায় দ্বিগুণ ম্যাচ (২০৭টি)। বাংলাদেশ দলের সবাই মিলে খেলেছে ক্যারিবিয়ানদের ১০ গুণের বেশি ম্যাচ, সব মিলিয়ে ১১১৫টি! তারচাইতেও বড় কথা, আইসিসি ওয়ানডে র্যাঙ্কিংয়ের একশ’ জনের মাঝে ক্যারিবিয়ান এই দলটির একমাত্র সদস্য আলঝারি জোসেফ। তাও আবার বোলিংয়ে তার অবস্থান ৪৫তম! খোঁজ নিলে বিশ্ব ক্রিকেটতো অনেক পরের কথা, তাদের দেশ উইন্ডিজেও এই ক্রিকেটারদের নামই হয়তো শোনেননি অনেকেই।
বিশ্ব ক্রিকেটে বাংলাদেশ যখন এক নতুন পরাশক্তির নাম, টেস্ট খেলুড়ে সবক’টি দেশের সঙ্গেই যাদের রয়েছে জয়ের সুখস্মৃতি, ঠিক তখন এমন একটি দলের বিপক্ষে শীর্ষ ক্রিকেটারদের নিয়ে গড়া বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটীয় লড়াই থেকে কি প্রাপ্তিযোগ হতে পারে? ওয়েস্ট ইন্ডিজের সেরা দলকেই বাংলাদেশ ঘরের মাঠে, ওদের মাঠে এবং বিশ্বকাপে হারিয়েছে। এই ম্যাচের আগে সর্বশেষ পাঁচ দেখায় সবকটিতেই বাংলাদেশের জয়। দেশের এই ক্রান্তিকালে, কোভিডের সঙ্গে লড়াইয়ে যখন গোটাদেশ পর্যুদস্ত, ঠিক তখন একগাদা টাকা খরচ করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নামে ক্রিকেট সিরিজের নামে এমন একটি তামাশার মানে কি?
দেশের ক্রিকেটের শীর্ষ সংস্থা বিসিবির পক্ষ থেকে দেয়া যুক্তির সারমর্ম করলে দাঁড়াচ্ছে, মহামারীকাল পেরিয়ে ক্রিকেট ফেরানোর আত্মতুষ্টিই অনেক! সেই সঙ্গে তারা জানিয়েছে, সিরিজে দুটি টেস্ট আবার আইসিসি চ্যাম্পিয়নশিপের অন্তর্ভুক্ত। সিরিজ জিতে বাংলাদেশের নামের পাশে বেশকিছু পয়েন্ট যোগ করার সম্ভাবনাও উজ্জ্বল। তার পাশাপাশি ওয়ানডে সিরিজ জিতে আইসিসি সুপার লিগেও পয়েন্ট বাড়ানোর সুযোগ আছে বাংলাদেশের, তাতে করে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বও এড়ানোর লক্ষ্য আছে টাইগারদের। এসব মিলিয়েই সফরটির ব্যপারে ‘হ্যাঁ’ বলেছে বিসিবি।
এই কোভিড পরিস্থিতিতে এমন একটি আনকোড়া দলকে এনে সিরিজ খেলানোর যৌক্তিকতা নিয়ে যখন উঠছে প্রশ্ন, ঠিক তখন অভিজ্ঞতা সম্পন্ন বাংলাদেশ দলের এমন হতশ্রী পার্ফরম্যান্সও চোখে পড়েছে মোটা দাগে। অভিজ্ঞতার পার্থক্যের প্রতিফলন মাঠের ক্রিকেটে পড়া অস্বাভাবিক ছিল না ক্যারিবিয়ানদের। ক্রিকেটীয় বিচারে সিরিজের প্রথম ম্যাচটিও জুগিয়েছে ভাবনার খোরাক।
বাংলাদেশের বিপক্ষে সফরকারীদের দ্বিতীয় সর্বনিম্ন ১২২ রানে থামিয়ে দিয়ের জয় এলো না সহজে। হারাতে হলো অভিজ্ঞ প্রথম চার ব্যাটসম্যানকে, খেলতে হলো ৩৩.৫ ওভার। স্বাগতিকদের বোলিং যতটা ভালো হয়েছে, ব্যাটিং ততটাই বিবর্ণ। নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে এতদিন পর ফিরেও সাকিব ছাড়া আর কেউই রাখতে পারেনি সাফল্যের সাক্ষর। ছোট লক্ষ্য ছিল, তাই সমস্যা হয়নি। কিন্তু খর্ব শক্তির ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে তাদের এমন ব্যাটিংয়ে ভাবনার যথেষ্ট খোরাক আছে। ক্রিকেটের নামে দেশের লাখো-কোটি ক্রীড়ানুরাগীদের সঙ্গে এই তামাশার কি খুব দরকার ছিল?
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন