অভাবের আগুন জ¦লছে সিলেটের পাথর সম্পদ ঘিরে। পাথর সংশ্লিষ্টদের জীবন এখন দুর্বিষহ। দীর্ঘ এক বছর ধরে বিরাজ করছে হাহাকার। শ্রমের হাত এখন স্তব্ধ। ক্ষুধার জ্বালায় পেটে পাথর বাঁধার উপক্রম কোয়ারী সংশ্লিষ্ট ১০ লক্ষাধিক মানুষের। পাথর সম্পদই স্থানীয় মানুষের উন্নয়ন অগ্রগতি ও বেঁচে থাকার সম্বল। সেভাবে চলছিল স্থানীয় মানুষের ভাগ্য। কিন্তু সমৃদ্ধ অতীত এখন অনিশ্চয়তার আঁধারে। গত ১ বছর ধরে পাথর উত্তোলন বন্ধ রয়েছে সিলেটের ভোলাগঞ্জ, জাফলং, লোভাছড়া ও বিছনাকান্দিসহ বিভাগের অন্যান্য কোয়ারীগুলোতে।
কোম্পানীগঞ্জ ভোলাগঞ্জ পূর্ব ইসলামপুরের বাসিন্দা পাথর শ্রমিক মো. ফয়জুল ইসলাম বলেন, হাইকোর্টে আদেশ ছিল সনাতন পদ্ধতি শ্রমিকের হাতে পাথর উত্তোলনের। কিন্তু জেলা প্রশাসক আদেশ থাকার পরও পাথর উত্তোলন করতে দেন না। তিনি পরিবেশের কথা বলেন। মানুষ যদি না খাইয়া মরে এটা কি পরিবেশ? ফয়জুল ইসলাম বলেন, তিনি ৪০ বছর থেকে পাথর উঠাচ্ছেন। এর আগে বাবা-দাদা এই কাজ করেছেন। এখন পাথর তুলতে না দিলে সবাইকে ভাত দিতে হবে।
পাথর শ্রমিকদের কথা, মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের বাড়ি ঘর দেয়া হচ্ছে। কিন্তু শ্রমিকরা তো বাড়ি ঘর নয়, কাজ করে সংসার চালাতে চাইছে। পাথর উত্তোলন করে বেচা-কেনা করাই শ্রমিকেদর মূল কাজ। বিকল্প কোনো কর্মসংস্থান নেই, পাথরই ছিল উপার্জনের একমাত্র পথ। সেই পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সবাই অনিশ্চিয়তার মধ্যে রয়েছে।
ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারীর একাধিক সূত্র জানায়, ৭০০ থেকে ৮০০ লোকের পরিবার পাথর কেন্দ্রীক উপার্জন নির্ভর। একই সাথে সুনামগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার লোকজন পাথর শ্রমিক হিসেবে ভোলাগঞ্জে জীবন জীবিকা নির্বাহ করতেন। কিন্তু পূর্ব নোটিশ ছাড়াই কর্তৃপক্ষ অভিযান চালিয়ে পাথর উত্তোলনের সব রাস্তা তারা বন্ধ করে দেয়। এরপর থেকে অভাব হয়েছে প্রতিটি শ্রমিকের সঙ্গী। চিকিৎসা খরচ নেই, ঘরে বাজার নেই, পঞ্চায়েত মসজিদে চাঁদা দিতে পারেন না। সন্তানের স্কুলের খরচ দিতে পারেন না। অবর্ণনীয় দুর্ভোগ এখন এ অঞ্চলে। কেবল ভোলাগঞ্জে নয়, অভাবের আগুন ছড়িয়ে পড়েছে অন্যান্য কোয়ারী কেন্দ্রীক শ্রমিকদের মধ্যেও।
সরেজমিন দেখা গেছে, চারদিকে কয়েক হাজার কোটি টাকার পাথরের বিপুল সমারোহ। অথচ তা এখন ধরা ছোঁয়ার বাইরে। অভাবের জ্বালা মেটাতে নারীরা ঘর থেকে বের হয়ে বালু খুঁড়ে পাথর খুঁজতে ব্যস্ত। কারণ এই পাথরই তাদের অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যত।
স্থানীয় উত্তর রনিখাই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ফরিদ আহমদ বলেন, বোমা মেশিনের ব্যবহার করেছিল একটি শক্তিশালী পাথর খেকো চক্র। সাধারণ শ্রমিকের কোন ভূমিকা নেই এতে। কিন্তু পরিবেশ বিপর্যয়ের কথা বলে বন্ধ করে দেয়া হলো পাথর উত্তোলন। স্থানীয় পাথর শ্রমিকরা উচ্চ আদালত থেকে সনাতনী পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলনের নির্দেশনা পেল।
কিন্তু তা কার্যকর বা সঠিকভাবে বাস্তবায়নে প্রশাসনের উদ্যোগ নেই। যে নির্দেশনায় পাথর কোয়ারী সার্বিকভাবে বন্ধ করে দেয়া হলো, একইভাবে পাথর উত্তোলনের নির্দেশনা কেন কার্যকর করা হয় না তা রহস্যজনক। তিনি বলেন, পরিবেশে বিপর্যয়ের কথা বলে চরম মানবিক বিপর্যয় এ অঞ্চলের মানুষকে গ্রাস করছে। নেই বিকল্প কোন কর্মসংস্থান। পাথর সম্পদের সুষ্ঠ ব্যবহারে নেই কোন উদ্যোগ।
সিলেট চেম্বার অব কমার্স সভাপতি আবু তাহের মো. শোয়েব বলেন, পরিবেশ সুরক্ষা নিশ্চিত করেই পাথর উত্তোলনের ব্যবস্থা করা জরুরি। স্থানীয় জনগোষ্ঠির মধ্যে ক্ষোভ লক্ষণীয়। তাদের বাস্তবিক সমস্যা মাথায় রেখেই সমাধান করতে হবে।
আদালতের নির্দেশে পাথর উত্তোলনের সুযোগ : অবশেষে পাথর উত্তোলনের সুযোগ মিলছে সিলেটে। সেই পাথর উত্তোলনের জন্য দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রাম এমনকি পরিবহন ধর্মঘটে নেমেছিল ‘বৃহত্তর সিলেট পাথর সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী-শ্রমিক ঐক্য পরিষদ’। গত ১৮ জানুয়ারি উচ্চ আদালতের এক নির্দেশনায় বিছনাকাান্দি, জাফলং কোয়ারী থেকে পাথর উত্তোলনের অনুমতি পেয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। পাথর কোয়ারী খোলার আদেশের খবরে মিষ্টি বিতরণসহ উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে পড়ে জাফলংসহ কোয়ারীভ‚ক্ত এলাকায়। এছাড়া নির্দেশনায় স্বস্তি ফিরেছে পাথর সংশ্লিষ্টসহ সেই এলাকার মানুষের জনজীবনে।
এর আগে গত ১৭ জানুয়ারি দেশের বৃহৎ পাথর কোয়ারী ভোলাগঞ্জ কোয়ারী থেকে পাথর উত্তোলনের আদেশ পেয়েছিল তারা। তবে জাফলং ইসিএ ঘোষণাভূক্ত জায়গার বাইরে পিয়াইন নদী থেকে করতে হবে পাথর উত্তোলন। সেই পাথর উত্তোলন কেবলমাত্র সনাতনী পদ্ধতিতে করতে পারবেন। এছাড়া পাথর উত্তোলনের স্থগিতাদেশের কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে ৬ মাসের জন্য।
পাথর উত্তোলন সংক্রান্ত এক রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি শেষে হাইকোর্টের বিচারপতি জেবিএম হাসান ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ আদেশ দেন। আদালতে রিটকারীদের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী হাবিব-উন-নবী। অপরদিকে, গত ১৭ জানুয়ারি ভোলাগঞ্জ কোয়ারীর পাথর উত্তোলনের পথে বাঁধা সরিয়ে দেন হাইকোর্ট। এর ফলে ওই অঞ্চলের পাথর উত্তোলনে আর কোনো বাঁধা নেই বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা।
হাইকোর্টের নির্দেশনায় ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারী থেকে খাস কালেকশন করতে আইনানুগ পদক্ষেপ নেয়ার জন্য সিলেট জেলা প্রশাসক বরবারে এক আবেদন করেছেন ‘বৃহত্তর সিলেট পাথর সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী-শ্রমিক ঐক্য পরিষদ’। গত সপ্তাহে সংগঠনের পক্ষে এ আবেদন করেন সদস্য সচিব নুরুল আমিন। আবেদনে উল্লেখ করা হয়, গত ১৭ জানুয়ারি হাইকোর্টের এক আদেশে কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারী থেকে সনাতন পদ্ধতিতে পাথর উত্তোলনের ব্যবস্থা গ্রহণের জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্ট ৪ জনকে নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। রিট আবেদনের ৪ নং দায়িত্বশীল ব্যক্তি হলেন সিলেট জেলা প্রশাসক। সেই প্রেক্ষিতে সিলেট জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেয়া হয়েছে পাথর উত্তোলনে খাস কালেকশনের মাধ্যমে যথাযথ প্রক্রিয়া গ্রহণের।
তারা আরো উল্লেখ করেন, জরুরি ভিত্তিতে খাস কালেকশনের ব্যবস্থা না করলে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাবে। তবে, বৃহত্তর সিলেট পাথর সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী-শ্রমিক ঐক্য পরিষদের সদস্য সচিব নুরুল আমিন বলেন, সিলেট জেলা প্রশাসকের সাথে তারা সাক্ষাতসহ আবেদন জমা দিয়েছেন। কিন্তু আদালতের নির্দেশনা থাকার পরও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অনুমতির কথা বলছেন জেলা প্রশাসক এম কাজী এমদাদুল ইসলাম।
তিনি আরো বলেন, রহস্যজনক কারণে পাথর কোয়ারী নিয়ে নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করছেন সংশ্লিষ্টরা। পাথর কোয়ারী বন্ধে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্টদের জোর পদক্ষেপ প্রতীয়মান হলেও একইভাবে আদালতের নির্দেশনায় পাথর কোয়ারী খুলে দেয়ার আদেশ পালনে অসহযোগিতা প্রশ্নবিদ্ধ।
উল্লেখ্য, পরিবেশের বিপর্যয় ঠেকাতে ২০১৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর সিলেটের জাফলং, ভোলাগঞ্জ, শাহ আরেফিন টিলা, বিছানাকান্দি ও লোভাছড়ার পাথর কোয়ারি থেকে পাথর উত্তোলন নিষিদ্ধ করে খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। এর আগে ২০১৪ সালে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)’র দায়ের করা একটি রিটের পরিপ্রেক্ষিতে সিলেটের পাথর কোয়ারিগুলোতে সব ধরনের যন্ত্রের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেন উচ্চ আদালত।
সরকারের নিষেধাজ্ঞার পর কোয়ারি থেকে পাথর উত্তোলনের অনুমতি চেয়ে আন্দোলন করে আসছেন পাথর ব্যবসায়ীরা। সিলেটের কোয়ারিগুলো থেকে সনাতন পদ্ধতিতে পাথর আহরণের অনুমতি প্রদানের দাবিতে প্রায় ৪ মাস ধরে আন্দোলন করেন তারা।
ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী, খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী, মন্ত্রীপরিষদ সচিব ও সিলেটের জেলা প্রশাসকসহ সব পর্যায়ের নীতিনির্ধারকদের কাছে একাধিকবার স্মারকলিপি দেয়া হয়েছে। যদিও পরিবেশের বিপর্যয় ঠেকাতে পরিবেশকর্মীরা পাথর উত্তোলন বন্ধ রাখার দাবি জানিয়ে আসছেন।
তবে পরিবেশ আন্দোলন সংশ্লিষ্টদের অভিমত, পাথর উত্তোলনের কারনে পরিবেশ বিপর্যয়ের যে কথা বলা হচ্ছে তার চেয়ে বড় ধরনের পরিবেশ হুমকির মুখে পড়ছে পাথর উত্তোলন বন্ধ রাখায়। কারণ প্রতিবছর অব্যাহত পাথর ঢলে ভরে গেছে নদীর তলদেশেসহ উপরিভাগ। নৌ চলাচল বন্ধ কেবল নয়, নদীর উৎসপথ এখন স্থবির।
স্থানীয় ধলাই নদী গতিপথ পাল্টে ফেলেছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে নদীর এমন অবস্থা রহস্যজনকভাবে দেখছেনা না কথিত পরিবেশ আন্দোলনকারীরা। শ্রমিকদের অভিযোগ, পরিবেশবান্ধব পরিস্থিতি সৃষ্টি করে পাথর উত্তোলনের পদক্ষেপ না নিয়ে পরিবেশ বিপর্যয়ের ধোঁয়া তুলে সিলেটের পাথর কোয়ারী বন্ধ রাখতে ব্যক্তি বা গোষ্ঠির হীন স্বার্থ রয়েছে।
আগামীকাল পড়–ন : কোয়ারী বন্ধ, স্টোন ক্রাশার শিল্পে সর্বনাশ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন