বদলে গেছে দিন। করোনার নীল ছোবল থেকে নতুন খোলসে উচ্ছ্বাস-উল্লাসে মাতোয়ারা সিলেটের পর্যটন স্পটগুলো। সৃষ্টির মনমাতানো পরিবেশ উপভোগে সিলেটে লাখো পর্যটক। খালি নেই হোটেল-মোটেল। একাধারে ৩ দিনের ছুটির সুযোগে সিলেটমুখী স্রোত তাই পর্যটকদের। আবহাওয়াও বেশ মানিয়েছে সময়ের সাথে। পর্যটননির্ভর ব্যবসায়ীদের মুখে এখন হাসির ঝিলিক।
সিলেট হোটেল অ্যান্ড গেস্ট হাউস ওনারর্স অ্যাসোসিয়েশনের কোষাধ্যক্ষ গোলাম কিবরিয়া লিপন বলেন, যেন এক অভাববনীয় পরিবর্তন ঘটেছে। করোনাকালীন পরিস্থিতির ঝড়ে লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছিল আমাদের ব্যবসা। সংকট ছিল ব্যাপক। কিন্তু করোনার ভ্যাকসিনের সুখবর ও প্রয়োগ পর থেকে ইতিবাচক এক পরিবর্তনের মুখে পড়েছি। বলতে গেলে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছি। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি থেকে এ পরিবর্তনের সূচনা। হোটেলগুলোতে আগাম বুকিং শেষ। প্রতিনিয়ত যোগাযোগ করছেন রুম বুকিংয়ের জন্য কিন্তু আমরা রুম দিতে পারছি না। কঠিন দুঃখের পর সুখের আবহে আমরা বেশ তৃপ্ত।
সিলেট প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপারতা কেবল নয়, রয়েছে ধর্মীয় আধ্যাত্মিকতার উৎস। ৩৬০ আউলিয়ার স্মৃতি বিজড়িত সিলেটের মাটি-মানুষ ও প্রকৃতির অফুরন্ত প্রকাশে এ অঞ্চলের সমৃদ্ধি আলাদা। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ধর্মপ্রাণ মানুষ সিলেটে পা রাখলেই ছুটে যান হজরত শাহজালাল (রহ.), শাহপরান (রহ.) দরগাহ ও গাজী বুরহান উদ্দিনের দরগায়। ধ্যানমগ্ন সময় কাটান একান্ত নীরবতায়। একই সাথে ঘুরে দেখেন তাদের স্মৃতি বিজড়িত সিলেটের সৌন্দর্য ভান্ডার। বিছনাকান্দি, জাফলং, লালাখাল, ভোলাগঞ্জ সাদাপাথর, রাতারগুল ও পান্তুমাই ঝর্ণা, চা বাগানগুলোর মনোহর দৃশ্য, জৈন্তাপুরের ডিবির হাওরে শাপলার রক্তিম ভাসমান সৌন্দর্য। এছাড়া তাহিরপুরের শিমুল বাগান, যাদুকাটা নদীর বালু রাশির বিস্তীর্ণতা, এর পাশেই টেকেরঘাটে রয়েছে অনুপম সৌন্দর্যের শহীদ সিরাজ লেক (নিলাদ্রী লাইমস্টোন লেক)। শিমুল বাগান ঘুরে বেড়ানোর এখন একেবারের উপযুক্ত সময়। সেকারণে পর্যটক ও দর্শনার্থীদের ঢল নেমেছে শিমুল বাগানে। ফাগুনের অরুণ আলোয় ফোটে বাগানের শিমুল ফুলগুলো। চোখের তৃষ্ণা মেটাতে টাঙ্গুয়ার হাওর, মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে ও রূপের নদী যাদুকাটার মধ্যস্থলের বিশাল শিমুল বাগানে ফুটে ওঠা টুকটুকে লাল শিমুল ফুলগুলো দেখতে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসছেন শত শত পর্র্যটক।
অপরদিকে, পর্যটকরা সিলেট শুধু ঘুরছেন না, সিলেট হয়ে বেশিরভাগই ছুটে যাচ্ছেন প্রকৃতির আদুরেকন্যা, পাহাড়, অরণ্য, হাওর আর সবুজ চা বাগান ঘেরা নয়ানাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্য আর অপূর্ব সৌন্দর্যমন্ডিত নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভ‚মি শ্রীমঙ্গলে। শ্রীমঙ্গলে দেখার আছে চা বাগানের পর চা বাগান, চা প্রক্রিয়াজাত কেন্দ্র, লাউয়াছড়া রেইনফরেস্ট, মাগুরছড়া গ্যাসকূপ, চা গবেষণা কেন্দ্র, লাউয়াছড়া ইন্সপেকশন বাংলো, খাসিয়াপুঞ্জি, মণিপুরীপাড়া, ডিনস্টন সিমেট্রি, হিন্দুধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান নির্মাই শিববাড়ি, টি-রিসোর্ট, ভাড়াউড়া লেক, পাহাড়ি ঝর্ণা, চারদিকে প্রকৃতির নজরকাড়া সৌন্দর্য আর হাজারও প্রজাতির গাছগাছালি।
এদিকে, এ মুহূর্তে সিলেটে সৌন্দর্যের বিশালতা উপভোগে যেমন আশাতীতভাবে বেড়েছে পর্যটকদের ভিড়, অপরদিকে ৩০০ প্রবাসী প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে রয়েছেন নগরীর বিভিন্ন হোটেল-মোটেলে। এতে করে বেড়াতে আসা পর্যটকদের জায়গা দিতে কিছুটা হিমশিম খাচ্ছেন, সিলেটের হোটেল-মোটেল কর্তৃপক্ষ। তারপরও স্রোত বাড়ছে সিলেটমুখী পর্যটকদের। করোনার মন্দা পরিস্থিতি পাল্টে পর্যটননির্ভর সব ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙা হয়ে উঠেছে সিলেটে। সেকারণেই চির সৌন্দর্যের আদিস্থান সিলেটের জাফলং এ পর্যটকদের উপস্থিতি বেহিসাব। পিয়াইন নদীর তীরে পাথরের সারি সারি স্তূপ জাফলংকে করেছে আকর্ষণীয়। সীমান্তের ওপারে ভারত পাহাড়-টিলা আর ঝুলন্ত ডাউকি ব্রিজ। পিয়াইন নদীর স্বচ্ছ হিমেল জলের খেলা দেখতে পর্যটকরা ছুটে আসছেন এখানে। এছাড়াও আদিবাসী জনগোষ্ঠী খাসিয়া সম্প্রদায়ের বসতঘর, খাসিয়া জনগোষ্ঠীর পান চাষ, জাফলং চা বাগানসহ আশপাশে হাজার হাজার পর্যটকের সরব পদধ্বনী। মূলত বসন্তের শুরুতে জাফলং, বিছনাকান্দি, ভোলাগঞ্জের সাদাপাথর, রাতারগুল ও পান্তুমাই ঝর্ণাসহ বিভিন্ন পর্যটন এলাকায় লক্ষণীয় ভিড় পর্যটকদের। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত হতে শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের উদ্যোগে কয়েক সহস্রাধিক যানবাহন নিয়ে পর্যটকের উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে গোয়াইনঘাটের বিভিন্ন পর্যটন এলাকায়। পর্যটক আর পর্যটকবাহী যানবাহনের কারণে জাফলংয়ের বিজিবি ক্যাম্প, মামার দোকানসহ কোথাও ঠাঁই নেই তিলধারণের, একই অবস্থা সাদাপাথর ও বিছানাকান্দির। হোটেল রেস্তোরাঁয় চরম ব্যস্ততা। অনেকে সাত পাহাড়ের মোহনা অবলোকন করতে পর্যটকরা ছুটে যান বিছনাকান্দিতে। পর্যটকদের এ ঢল সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছেন রেস্তোরাঁর মালিকরা। সেই সাথে ভোলাগঞ্জের সাদাপাথরের স্বচ্ছ জলরাশিতে জলখেলীতে মেতে উঠছেন পর্যটকরা। ওপারের মেঘালয়ের অপারতা একই সাথে ধলাই নদীর বুকে পাথরের সম্পদের দৃশ্য।
এদিকে, বিশ্বের ‘দ্বিতীয় সুন্দরবন’ খ্যাত রাতারগুল ‘সোয়াম্প ফরেস্ট’ এলাকায়ও পর্যটকদের উপস্থিতি কোনো অংশে কম নয়। যদি রাতারগুলের মূল সৌন্দর্য ভোগের উপযুক্ত সময় বর্ষা মৌসুম। তারপরও শীত মৌসুমের পরিবেশ প্রতিও রয়েছে সৌন্দর্য পিপাসুদের টান। এছাড়া মায়াবতী ঝর্ণা আর পান্তুমাই ঝর্ণার আসল যৌবনের রূপ না থাকলেও পর্যটন পিপাসুদের বাঁধ ভাঙা জোয়ার কেউ থামাতে পারেনি।
সিলেট ট্যুরিজম ক্লাবের সভাপতি হুমায়ুন কবির লিটন, সিলেট বিভাগের বর্তমান হোটেল-মোটেলের রুম প্রায় লক্ষাধিক। সেই হিসেবে রুম খালি পাওয়া যাচ্ছে না কোথাও। করোনার কারণে গত দুই ঈদসহ প্রায় দেড় বছরে পর্যটকশূন্য ছিল সিলেট। কিন্তু এই মুহূর্তে বদলে গেছে গোট সিলেট। এফবিসিসিআই এর পরিচালক ও সিলেট চেম্বারের সাবেক সভাপতি খন্দকার সিপার আহমদ জানান, করোনা মহামারি পরিস্থিতির প্রথমদিকে সিলেটসহ সবখানেই হোটেল ব্যবসায়ীরা কিছুটা ক্ষতির সম্মুখীন ছিলেন। বর্তমানে এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে চলছে। ব্যাপক সংখ্যক পর্যটকদের উপস্থিতি সেই অবস্থাকে দ্রুত পাল্টে দিচ্ছে, এ এক নতুন সুখবর।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন