অর্থপাচারের সাথে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা এবং অর্থপাচার নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না এর সাথে জড়িত সংস্থাগুলো। মামলা হওয়ার আগেই অর্থপাচারের সাথে জড়িতদের কাছে তথ্য চলে যাওয়ায় দ্রুত দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে পাচারকারীরা। পাচার চক্রের মূলহোতারা পালিয়ে যাওয়ায় সহযোগীদের গ্রেফতারের মাধ্যমে সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে তদন্তের সাথে জড়িত বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তাদের।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অর্থপাচারকারীরা দেশের শত্রু। তাদের প্রতিরোধ না করা গেলে অর্থনৈতিক অবকাঠামো ভেঙে পড়বে। আর তাই এ অপরাধ মোকাবেলায় আইনের কঠোর প্রয়োগের বিকল্প নেই। এছাড়া অভিযুক্ত অর্থপাচারকারীর বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার আগেই খবর পেয়ে যাচ্ছেন। ফলে দ্রুত অভিযুক্তরা দেশের বাইরে চলে যাওয়ায় গ্রেফতার হচ্ছেন তাদের সহযোগীরা। তদন্তকারী সংস্থার দুর্নীতিবাজ কতিপয় কর্মকর্তারা আগেই তথ্য ফাঁস করে দিচ্ছেন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এখন অর্থপাচার মামলা পরিচালনা ও তদন্তে কাজ করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরসহ (ডিএনসি) একাধিক সংস্থা। এককভাবে কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান মানিলন্ডারিং মামলা পরিচালনা করছে না। অবশ্য দুদক ও সিআইডি ছাড়া অন্য সংস্থাগুলোর কাছে মানিলন্ডারিং মামলার তথ্য পাওয়া যায়নি।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মোহাম্মদ নুরুল হুদা গতকাল দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, বিদেশে অর্থপাচারকারীদের আইনের আওতায় আনা খুবই জরুরি। অর্থপাচারকারীরা যাতে দেশের বাইরে পালিয়ে যেতে না পারে সে জন্য গোপনীয়তা রক্ষা করে প্রাথমিক তদন্ত কাজ শেষ করতে হবে। মামলা হওয়ার আগ পর্যন্ত জড়িতদের কাছে যেন তথ্য না যায়।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ বিভাগ নামে একটি শাখা রয়েছে। প্রাথমিক তদন্ত সেখানেই হয়। এরপর সিআইডিসহ অন্যান্য সংস্থা বিষয়গুলো তদন্ত করে এবং জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
সম্প্রতি সরকারের উচ্চ পর্যায়ে পাঠানো একটি সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিটের তথ্য অনুযায়ী-২০০৯ থেকে ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪১২টি মামলা এবং এক হাজার ৪৫৫টি ঘটনার অনুসন্ধান নিষ্পত্তি করে। একই সময়ে এই ইউনিট ২৮২টি মানিলন্ডারিং মামলার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে এবং ১৪৬টি মামলার নিষ্পত্তি করে। এতে বিপুল পরিমাণ নগদ অর্থ, জমি, ফ্ল্যাট, বাড়ি ও গাড়ি জব্দ করা হয়। তবে মামলা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বিদেশে অর্থপাচারের সাথে জড়িত মূলহোতারা মামলা হওয়ার আগেই আত্মগোপনে চলে যান। অনেকেই দেশের বাইরে চলে যেতে সক্ষম হন।
প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, সিআইডির তদন্তাধীন মানিলন্ডারিং মামলার মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির মামলা অন্যতম। এই মামলায় বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে চুরি করা ১০১ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের মধ্যে ফিলিপাইন ও শ্রীলঙ্কা থেকে ৩৪ মিলিয়ন ডলার উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৪ ধারা, মানিলন্ডারিং আইনের ৪(৪) এবং পেনাল কোডের ৩৭৯ ধারায় ২০১৬ সালের ১৫ মার্চ মতিঝিল থানায় মামলাটি দায়ের করা হয়। ফারইস্ট ইসলামিক মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ লিমিটেডের কর্মকর্তারা প্রতারণার মাধ্যমে আমানতকারীদের প্রায় ১০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ সংক্রান্ত মানিলন্ডারিং আইনের ১৩টি মামলার তদন্ত করে সিআইডি। তদন্তে আত্মসাতের বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয়া হয়। এসব মামলার মূল আসামি শামীম কবিরের একটি মাইক্রোবাস ও ব্যাংক হিসাবগুলো জব্দ করা হয়। আত্মসাত করা অর্থে কেনা ২৩ দশমিক ৪৬ একর আদালতের আদেশে ক্রোক করা হয়েছে।
অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার মো. মোস্তফা কামাল বলেন, মানিলন্ডারিং আইনে করা মামলা যেগুলো আমাদের কাছে এসেছে সেগুলোর তদন্ত দ্রুত শেষ করে অভিযোগপত্র দেয়ার চেষ্টা করছি। ইতোমধ্যে বেশ ক’টি চাঞ্চল্যকর মামলার তদন্ত শেষ করেছি। নতুন আরো কয়েকটির কাজ শুরু করেছি। তবে অনেক মামলার ক্ষেত্রে মূল জড়িতদের গ্রেফতার করতে সময় লেগে যায়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিআইডির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, অর্থপাচার সংক্রান্ত মামলা তদন্তের ক্ষেত্রে প্রকৃত জড়িতদের গ্রেফতার করা বেশ কঠিন। মামলা হওয়ার আগে বা অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করার পর অভিযুক্তকে পাওয়া বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় জড়িতরা দেশের বাইরে রয়েছেন। তথ্য আগেই প্রকাশিত হওয়ায় অভিযুক্তরা এ ধরনের সুবিধা পায় বলে তিনি মন্তব্য করেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন