দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদের দায়িত্ব ও কর্তব্যকর্ম ছিল এক কথায়- দুর্নীতি দমন, দুর্নীতি প্রতিরোধ। কিন্তু তিনি দেশ ও জাতির কাছে শপথবদ্ধ সেই ‘আসল কাজ’ বাদ দিয়ে নির্দোষ পাটকল শ্রমিক ‘জাহালম’র মতো অনেক কা--কারখানা ঘটিয়ে অসহায়-নিরীহ মানুষদের দমন-পীড়ন-নাজেহাল করেই ছেড়েছেন। শুধুই তাই নয়, পদের ঝাঁঝ দেখাতে গিয়ে নিছক ইগো আর দম্ভের বশবর্তী হয়ে দেশ ও সমাজের সর্বজন সম্মানীয় নাগরিকদের বিনাদোষে ‘এক হাত’ নেয়ার অপচেষ্টা করেছেন।
দেশের বিবেকবান সুশীল সমাজ, বুদ্ধিজীবী ও বিশিষ্ট নাগরকিমহলে অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত কারণেই এখন ঘুরপাক খাচ্ছে এসব নিয়ে অনেক জিজ্ঞাসা আর কৌতূহল। আজ মঙ্গলবার চট্টগ্রামের বিশিষ্ট নাগরিকবৃন্দের বক্তব্য-মন্তব্য ও অভিমত জানা গেছে উপরোক্ত প্রসঙ্গে।
তারা দৈনিক ইনকিলাবকে বলেছেন, ইকবাল মাহমুদ ছুটেছেন চুনোপুটিদের পেছনে। এরজন্য দুদক-এর জনবল, রাষ্ট্রীয় অর্থ এবং সময় অহেতুক অপচয় করেছেন। অথচ রাঘব-বোয়াল, রুই-কাতলারা কাড়ি কাড়ি অর্থ-সম্পদ লুটপাট, ব্যাংকের অর্থ-আমানত তছরুপ, বিদেশে পাচার, সেকেন্ড হোম, ‘বেগম পাড়া’ ইত্যাদি আইনত ধর্তব্য ও দ-নীয় অপরাধমূলক অপকর্ম করেও অনায়াসেই পার পেয়ে গেছে। গেল পাঁচ বছরে এটি ওপেন সিক্রেট। যার নেপথ্য রহস্য কী তাও সহজেই অনুমেয়।
অন্যদিকে নিজে রাঘব-বোয়ালদের ‘ছাড়বো না’, ‘পার পাবে না’, ‘জিরো টলারেন্স’ ইত্যাদি কানসুখ কথাবার্তায় হম্বিতম্বি আর আস্ফালন দেখিয়েছেন। যা অসার তর্জন-গর্জনেই শেষ। জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে না পারা এবং এক ধরনের অসন্তোষ নিয়ে বিদায় নিচ্ছেন বলে সোমবার সাংবাদিকদের সামনে স্বীকারও করেছেন ইকবাল মাহমুদ। তাবৎ ব্যর্থতার গ্লানি নিয়েই বিদায় হচ্ছেন। বিদায়বেলায় রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আদালতের মুখোমুখি হওয়ার জন্যও তিনি আদিষ্ট হন।
স্বাধীন সংস্থা দুদক-কে কেন দন্ত-নখরহীন একটি ঠুনকো, অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করলেন তিনি? কেন ইকবাল মাহমুদ রাঘব-বোয়ালদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছেন? দুদক-এর দক্ষ, নিষ্ঠাবান, সৎ ও সৃজনশীল শীর্ষ ও মাঝারি পর্যায়ের কোনো কোনো কর্মকর্তা তার ‘ইচ্ছে-পূরণের হাতিয়ার’ হিসেবে অপছন্দ হওয়ায় তার রোষানলে পড়েন। ‘জীবন ধ্বংস’ করার হুমকিও আসে কারও কারও কাছে। সুশীল সমাজ, বুদ্ধিজীবী, বিশিষ্ট নাগরকিমহল স্বভাবতই এসব প্রশ্নে জাতির কাছে সুস্পষ্ট জবাবদিহিতা চান। উঠেছে স্বচ্ছতার প্রশ্নও। যাতে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ এই প্রতিষ্ঠানে নতুন আর কোনো ইকবাল মাহমুদ এপিসোডের ভবিষ্যতে পুনরাবৃত্তি না ঘটে।
একুশে পদকপ্রাপ্ত বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি প্রফেসর ড. মইনুল ইসলাম গতকাল দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, বিদায়ী দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ কেন রাঘব-বোয়ালদের বিরুদ্ধে তার অঙ্গীকার সত্ত্বেও ব্যবস্থা নিতে পারেননি তা বোধগম্য নয়। অথচ তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন (গত সোমবার) এক্ষেত্রে তার করণীয় ও দায়িত্ব পালনে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো রকম চাপের সম্মুখীন হননি। দুদক একটি দন্ত-নখরহীন বাঘে পরিণত হয়েছে। প্রফেসর ড. মইনুল ইসলাম মনে করেন, ২০০৭-০৮ সালে সত্যিকার অর্থে শক্তিশালী ও স্বাধীন প্রতিষ্ঠানে উন্নীত করতে এবং দুর্দীতি দমনে কার্যকর ভূমিকা পালনে যে আইন-বিধির অধ্যাদেশ প্রণীত হয়েছিল, সেটি সংসদে আইন হিসেবে পাস করা প্রয়োজন। তাহলেই দুদক কার্যকর প্রতিষ্ঠানে উন্নীত হবে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন চট্টগ্রামের সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী বলেন, অনিয়ম, দুর্নীতি, লুটপাট, অর্থপাচার প্রতিরোধ করাই দুদকের কাজ। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় জনগণের প্রত্যাশা পূরণে এ প্রতিষ্ঠানটি ব্যর্থ। সাম্প্রতিক সময়ে তারা নিজেরাই অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ে। অনেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এমন সুস্পষ্ট অভিযোগ আছে। অনেক দুর্নীবাজকে তারা দায়মুুুুক্তি দিয়েছে।
দুর্নীতিবাজ রাঘব-বোয়ালদের পুর্নবাসন করেছে। বড় বড় দুর্নীতিবাজ বাদ দিয়ে চুনোপুটিদের পিছু ছুটেছে দুদক। দুর্নীতি দমন করে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় তাদের কঠোর হতে দেখা যায় না। নতুন কমিশন এসব বিষয় সামনে রেখেই নতুন উদ্যোমে তাদের পথচলা শুরু করবে-এমন প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন তিনি।
বিশিষ্ট ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ অ্যাডভোকেট আহসানুল হক হেনা বলেন, দুদকের তৎপরতায় দুর্নীতি কমেছে এটা মানুষ বিশ^াস করে না। বাস্তবতা হলো দেশে দুর্নীতি, লুটপাট আর অর্থপাচার বেড়েই চলেছে। কারণ দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে পারেনি দুদক। তাদের মধ্যে কোন ভয়ের পরিবেশও তৈরি করতে পারেনি। বড় কোন দুর্নীতিবাজের দৃষ্টান্তমূলক কোন সাজারও নজির নেই। আমলাতন্ত্রের কাছে তাদের অসহায় দেখা যাচ্ছে। অথচ তারা একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান।
মানবাধিকার সংগঠক ও চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট কফিল উদ্দিন চৌধুরী বলেন, দেশে অনিয়ম, দুর্নীতি বেড়েই চলেছে। জনগণ মনে করে দুদক তাদের যথাযথ ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হচ্ছে। দুদক বড় বড় দুর্নীতিবাজকে এড়িয়ে যাচ্ছে। দুর্নীতিবাজরা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছে। যা দেশে ন্যায়-নীতি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক। তিনি বলেন, দৃশ্যমান দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হলে দুর্নীতিবাজদের মধ্যে ভীতি তৈরি হতো। দুর্নীতিবাজদের সাজা হোক এটাই জনগণেরই প্রত্যাশা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন