‘আমার বাপ-দাদার চৌদ্দগোষ্ঠী মহানন্দা নদীতে মাছ ধরেছে। আমি ২৫ বছর ধরে মাছ ধরে সংসার চালাই। পানি শুকিয়ে যাওয়ায় আগের মতো মাছ পাওয়া যায় না। আগে ৪ জনে সারাদিন মাছ ধরে ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার টাকা বিক্রি করতাম। এখন ৮শ’ থেকে ১ হাজার টাকা বিক্রি করতে পারি। মাছ ধরা ছাড়া অন্য কাজ শিখিনি; তাই কষ্টে জীবন চালাচ্ছি’। প্রায় এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বললেনÑ নূরুদ্দিন শেখের ছেলে নাসিরউদ্দিন শেখ। তার বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার ভুতপুকুরের আলী নগর গ্রামে। বললেন, ‘মাছ ধরে এখন চাল কেনার টাকা হয় না। নদীর অনেক এলাকায় হাঁটু পানি। হাঁটু পানিতে কি মাছ পাওয়া যায়?’
রাজশাহী থেকে গেইটলক বাসে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরে পৌঁছেই সোজা চলে গেলাম মহানন্দা নদীর খালঘাট পয়েন্টে। স্থানীয় সাংবাদিককে সঙ্গে নিয়ে সেখান থেকে সেরামপুর ও মালশা স্পটে। নদী শুকিয়ে গেছে। খেয়া পাড় হয়ে সিরামপুরের রহিম সেক্রেটারি জানালেন, মহানন্দা নদীর গতি-প্রকৃতি সর্পিলাকার। সাপের মতোই একেবেঁকে চলেছে নদী। এক সময় নদীতে প্রচুর পানি ছিল। তখন ইলিশ মাছ পাওয়া যেত। এখন পানি নেই। কোথাও কোথাও বালু উত্তোলন করে ফেরি চলাচল করছে। অনেকেই নদীর দুইপাড় দখল করে ধান-গম-মসুর চাষাবাদ করছেন। গত ১৩ মার্চ চাঁপাইনবাবগঞ্জের মহানন্দা নদীর এক প্রান্তের বৈহিল বাড়ি, দুর্গাপুর, পেয়ারাপুর, যাদবপুর, খামার গ্রাম এবং অন্য প্রান্তের হুজরাপুর, রসুলপুর, বিডিআর ক্যাম্পসহ ২০ থেকে ২৫টি পয়েন্ট সরেজমিন ঘুরেছি। সঙ্গী ছিলেন স্থানীয় সাংবাদিক মো. আসাদুল্লাহ। যেখানেই গিয়েছি নদী পাড়ের প্রতিটি মানুষ মহানন্দার পানি পেতে ভারতের উপর চাপ সৃষ্টির দাবি জানিয়েছে। তাদের বক্তব্য হলোÑ মহানন্দা বাংলাদেশ ও ভারতের আন্তঃসীমা নদী। আন্তঃসীমান্ত মহানন্দা গঙ্গা নদীর একমাত্র উপনদী। এক সময় এ নদীতে ৪০ থেকে ৫০ ফিট পানি ছিল। ইলিশসহ নানা জাতের মাছ পাওয়া যেত। এখন কোথাও হাঁটু কোথাও গলা পানি হওয়ায় মহানন্দা মরা নদীতে পরিণত হয়েছে। জহির শেখ নামের এক জেলে ভোট থেকে দুপুর পর্যন্ত মাছ ধরে নদীর ধারেই দুইশ’ টাকা বিক্রি করলেন। জানালেন, আগে নদীর পানি দিয়ে ছাতু, ভাত-তরকারি রান্না, হাড়ি-পাতির ধোঁয়াসহ গৃহস্থলির সব কাজ করা যেত। পানির অভাবে নদী এখন খাঁ খাঁ করছে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের গঙ্গা চুক্তি হয়েছে, তিস্তা চুক্তির আলোচনা চলছে; এখন মহানন্দার পানির ন্যায্য হিস্যার জন্য বাংলাদেশ সরকারের উচিত ভারতের উপর চাপ সৃষ্টি করা।
দিনভর মহানন্দা নদীতে ঘুরে, নৌকায় চড়ে বিভিন্নজনের মতামত নেয়া হয়। তারা জানান, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসেবে মহানন্দা নদীর পরিচিত নাম্বার হল উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের নদী নং ৯৫। উৎপত্তি ভারতের দার্জিলিং জেলায়। নেপালের দক্ষিণ-পশ্চিমস্থ হিমালয় থেকে উৎপত্তি হয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমে প্রবাহিত হয়ে কাসিয়াং এবং শিলিগুড়ি অতিক্রম করে বাংলাদেশের তেঁতুলিয়ায় প্রবেশ করেছে। সেখান থেকে আবার ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পূর্ণিয়া ও মালদহ জেলায় চলে গেছে। অতপর দক্ষিণপূর্ব দিকে ভোলাহাটের পাশ দিয়ে পুনরায় বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জে প্রবেশ করেছে। মহানন্দা নদী বাংলাদেশ সীমান্তে প্রবেশ করে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শহরকে বাম তীরে রেখে গোদাগাড়িতে পদ্মা নদীর সঙ্গে মিশে গেছে। এক সময় ভারতের উত্তর প্রদেশ থেকে মহানন্দায় পানি আসত, এখন আসে না।
মহানন্দা নদীর দুইধারে সবুজের সমারোহ। সবুজ ধানের লকলকে গাছ বাতাসে দুলছে। চাপাই সদরের দুখুমারি এলাকায় নদীর ভেসে ওঠা জমিতে ধান লাগিয়েছেন সোহরাব আলী। নদীর জমিতে ধান চাষ করায় সংবাদকর্মীর সঙ্গে কথা বলতে রাজি হলেন না। তবে অনতি দূরে জমিতে নিড়ানি দিচ্ছিল হারেজ উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘চরে পলিমাটি পড়ায় চাষাবাদ করছি। আমরা পানি চাই। নদীতে মাছ ধরতে চাই। পানি না থাকায় নদীর আশপাশের পরিবেশ নস্ট হয়ে যাচ্ছে’। এর আগে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় চায়ের দোকানে হুরমুজ খাঁ বলেছেন, ‘নদীতে পানি থাকলে কেউ এটা করতেন না। আসলে মহানন্দার দেশের গুরুত্বপূর্ণ নদী হলেও আমাদের কর্তৃপক্ষ বুঝছেন না। তাই শুধু তিস্তা নিয়ে ভারতের সঙ্গে দরকষাকষি করছেন। ভারত কিন্তু মহানন্দা খনন করে মা ইলিশ পশ্চিমবঙ্গের গঙ্গায় নেয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। বর্তমানে নদীতে ইলিশ নেই; অথচ মাঝেমধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালত জেলেদের জরিমানা করে। সুস্বাধু পানির মহানন্দাকে বাঁচাতে পানির ন্যায্য হিস্যার জন্য এখনই ভারতের সঙ্গে দরকষাকষি করা উচিত। ক‚টনৈতিক পর্যায়ে এটা সম্ভব।
মহানন্দার ভোলাহাট পয়েন্টের আবদুস সুলতান হোসেন জানান, এক সময় উজান দিয়ে পানি আসত। এখনও বন্যার সময় পানিতে দু’ক‚ল ছাপিয়ে আশপাশের বাসাবাড়িতে পানি ওঠে। কিন্তু উজানের পানিপ্রবাহ না থাকায় বর্তমানে বৃষ্টির পানি মহানন্দা নদীর প্রধান উৎস। এজন্য শুকনো মৌসুমে তথা চৈত্র মাসে নদীর পানি তলানিতে চলে যায়। মহানন্দা নদীর মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ৩৬০ কিমি. (২২৪ মাইল) এবং গড় প্রশস্থ ৪৬০ মিটার। এর মধ্যে বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জে পড়েছে ৩৬ কিমি.। ভোলাহাটের নদীপাড়ে নূর তাজ, আনিছুল হক, হেদা, জহিরের সঙ্গে কথা হয়। তারা জানান, প্রশিকা, শান্তিসহ কয়েকটি এনজিও’র কাছে ঋণ নিয়ে জাল ও নৌকা তৈরি করে মাছ ধরেন এলাকার জেলেরা। কিন্তু পানি না থাকায় পর্যাপ্ত মাছ না পাওয়ায় ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে জেলেদের ভোগান্তিতে পড়তে হয়। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার ঘুকুটি, দুখুমারি, চেনারা, গরিযাতলা, মরিচা ডগায় ঘুরে সরেজমিন দেখা গেল অনেক স্পটে বালু উত্তোলনের জন্য নদী খনন করা হচ্ছে। বালু ব্যবসায়ীদের অপরিকল্পিতভাবে খননের কারণে নদীর গতিপথ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। নদীর ১০ কিলোমিটারের মধ্যে কমপক্ষে ১০ থেকে ১৫টি স্পটে বালু উত্তোলন করতে দেখা গেছে।
স্থানীয় সাংবাদিক ও পরিবেশবিদরা জানান, উপনিবেশিক শাসনামলে ১৮৭৬ সালে উইলিয়াম উইলসন হান্টারের করা জরিপে বলা হয়, মহানন্দা প্রশস্ত এবং গভীর নদী। ওই সময় নদীর উপর দিয়ে বড় বড় ৫০০ মণ মালবাহী নৌকা চলাচল করত। মহানন্দা নদী থেকে কোনো শাখাও বের হয়নি। কৌশিকী নদী বিহার দিয়ে প্রবাহিত হয়ে গঙ্গার সাথে মিলিত হয়ে রাজমহলের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এখন ভারত সরকার মহানন্দা নদীর বাংলাদেশ-ভারত আন্তর্জাতিক সীমানার মাত্র ৩ কিমি. উত্তরে শিলিগুড়ির বেরেজ তৈরি করেছে। এটি কিন্তু আন্তর্জাতিক নদী আইনের লংঘন। এতে মহানন্দা নদীর স্বাভাবিক যে গতি প্রবাহ ব্যাহত হচ্ছে।
ফেরার সময় আবার চাপাই জেলা শহরের পাশের খালঘাট দিয়ে পার হই। এ সময় পরিচয় জানতে ছুটে এলেন এক জেলে। মিডিয়ার লোক পরিচয় দেয়ায় রহিমুল্লাহ মাঝি নামেই ওই ব্যাক্তি বিক্ষুব্ধ সুরে বললেন, ‘কত শালা এলো মহানন্দার পানি নিয়ে লিখল; মহানন্দায় পানি আসেনি। মহানন্দায় পানি এলো তো পাল্টে যাবে জীববৈচিত্র। আমরা নদীর তীরে ধান চাষ করতে চাই না; মাছ ধরতে চাই। কিন্তু ভারতকে তোষামোদ করলে মহানন্দায় ওরা কখনো পানি দেবে না। আন্তর্জাতিক নদী হিসেবে মহানন্দার পানি আদায় করতে হবে। আপনারা মিডিয়া তো সেটা করতে ভয় পান।’
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন