‘ফান্দে পড়িয়া...বগা কান্দেরে... ফান্দ বসাইছে ফান্দীরে ভাঁই, পুঁটি মাছো দিয়া....ওরে, তোমার বগা বন্দী হইছে...ধরলা নদীর পাড়ে’ কালজয়ী কণ্ঠশিল্পী আব্বাস উদ্দিনের গানের ‘বগার’ মতোই ধরলা নদীর পাড়ের মানুষ যেন ফাঁদে পড়ে গেছে। গানের বগা পুঁটি মাছের লোভে ফান্দে আটকা পড়লেও কুড়িগ্রাম জেলার ধরলা পাড়ের মানুষ ভারতের গজলডোবার বাঁধের ফান্দে আটকে পড়েছেন।
ভারত গজল ডোবা বাঁধ দিয়ে তিস্তার পানি অন্যত্র সরিয়ে নেয়ায় তিস্তায় পানি প্রবাহ কমে যায়; আর তিস্তায় পানি না থাকায় ধরলায় পানি থাকে না। নদীতে পানি না থাকায় নিদারুণ পানির কষ্টে পড়ে গেছে ধরলা পাড়ের মানুষ। অনেকে বাপ-দাদার মাছ ধরার পেশা ছেড়ে শহরে গেছেন রিকশা চালাতে। কেউ কেউ নির্মাণ শ্রমিক, চা-বাদাম বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন।
১৪ মার্চ দিনটা শুরু হয়েছিল ধরলা ব্রিজ ভ্রমণ (এক নম্বর ধরলা সেতু) দিয়ে। দিন শেষ হয়েছে দ্বিতীয় ধরলা ব্রিজ দিয়ে। দিনভর ধরলা নদীর দুই পাড়ে গ্রামের পর গ্রাম হেঁটে মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের সবার অভিযোগ নদীতে পানি না থাকায় চাষাবাদের ক্ষতি হচ্ছে। নদী পাড়ের জেলেরা পেশা বদল করে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে। পানি না থাকায় মাছসহ জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে। ফুলবাড়িয়ার শেখ হাসিনা ধরলা সেতুর (ধরলা দ্বিতীয় সেতু) দক্ষিণ পয়েন্টে দাঁড়িয়ে শ্রী অসিম সাহা নামের একজন কৃষক বললেন, ‘শেখ হাসিনার কাছে হামাদের (আমাদের) অনেক ঋণ। ১৯৯৮ সালে আওয়ামী লীগ ধরলা নদীর ওপর প্রথম সেতু করিলো। ২০ বছর পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৮ সালের ৪ জুন কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলায় ‘শেখ হাসিনা ধরলা সেতু’ উদ্বোধন করে। কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে দুটি সেতু হওয়ায় হামারগুলার যোগাযোগে উন্নতি হয়েছে। যখন তখন এখানে যেখানে যাওয়া যায়। কিন্তু ভারতের কাছে নতজানু থাকায় তিনি তিস্তার চুক্তি করতে পারছেন না। তিস্তায় পানি থাকলে ধরলায় পানি থাকপেই’।
জহিরুল ইসলাম নামের এক চা দোকানদার দূরে তিনজন নারীকে নদীতে হেঁটে যাওয়া দেখিলে বললেন, ‘এরা যাচ্ছেন নদীতে; পায়ে হেঁটেই পার হবেন। ধরলা এখন আর নদী নেই। খালে পরিণত হয়েছে। মাঝে মাঝে নালা, কোথাও গলা পানি, কোথাও কোমর পানি। নৌকা চললেও পায়ে হেঁটেই পার হওয়া যায়’।
নদীর চরে যখন নামি তখন বেশ কয়েকজনকে দেখা গেল ধান গাছের পরিচর্যা করছেন। এদের একজন ক্ষেতমজুর নোয়াব আলী দূরে বালুতে ফেলে রাখা কয়েকটি ডিঙ্গি নৌকা দেখিয়ে বললেন, ‘পানি থাকলে ওই নৌকাগুলো চলতো। নৌকা দিয়ে পারাপার, মাছ ধরা হয়, পণ্য আনানেয়া করা হয়। নদী শুকিয়ে যাওয়ায় নৌকাগুলো এভাবে শুকনায় ফেলে রাখা হয়েছে। পানি এলে আবার নদীতে নামানো হবে’। তবে শুনছি চীনের টাকায় তিস্তায় মহাপ্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। ওই মহাপ্রকল্পে কিন্তু ধরলাকে যুক্ত করা যেতে পারে।
ধরলা নদীর প্রথম সেতু কুড়িগ্রাম জেলা শহর থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে। সেতুর উত্তরপার্শ্বে বিড়াট মাঠ। মাঠে দু’দিন আগে ইশতেমা শেষ হয়েছে। ওই মাঠে ‘শেখ রাশেল পার্ক’ করার লক্ষ্যে বিশাল সাইনবোর্ড টানিয়ে দেয়া হয়েছে। প্রতিদিন শত শত দর্শনার্থী সেতুর দুই ধারে বেড়াতে আসেন। দর্শনার্থীদের বসার জন্য অনেকগুলো বেঞ্চ স্থায়ীভাবে করে দেয়া হয়েছে।
একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিন ধরলা নদী সম্পর্কে বললেন, ধরলা নদী একটি আন্তঃসীমান্ত নদী। লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রামের চ্যাংগ্রাবান্ধা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। উজানে ভারতের প্রবাহে শিংগিমারি নামে পরিচিত। পাটগ্রাম পুলিশ স্টেশনের কাছে নদীটি পুনরায় ভারতে প্রবেশ করে পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়েছে। সর্পিল গতির ধরলা অকস্মাৎ দক্ষিণে বাঁক নিয়ে কুড়িগ্রাম জেলা দিয়ে দ্বিতীয়বার বাংলাদেশ ভূখন্ডে প্রবেশ করেছে। বাংলাদেশ ধরলার মোট দৈর্ঘ্য ৭৫ কিমি। ধরলার ডান তীরে কুড়িগ্রাম শহর। কুড়িগ্রাম শহরের কয়েক কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে নদীটি ব্রহ্মপুত্র নদের সঙ্গে মিশে গেছে। রংপুরে নীলকুমার নামে ধরলার একটি ছোট উপনদী আছে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেল, ধরলা প্রথম সেতুর দুই ধারে নানান ধরনের দোকান বসেছে। দু’ধারে কার্যত বিকেলে বাজার বসে। এই ক্ষুদ্র দোকানীদের বেশির ভাগই নদী পাড়ের জেলে পরিবারের সদস্য। শুকিয়ে যাওয়া নদীতে মাছ না থাকায় তারা পেশা বদল করে দোকান দিয়েছেন। শ্রী সুন্দর কুমার নামের এক চটপটি বিক্রেতা বললেন, ‘স্যার আমার নাম সুন্দর কুমার। নামেই সুন্দর; ধরলায় পানি না থাকায় জীবনটা অসুন্দর হয়ে গেছে। প্রতি বছর চৈত্র মাস এলেই ধরলা শুকিয়ে যায়। অথচ বর্ষায় নদীতে পানির স্রোত খুব বেড়ে যায় এবং ব্যাপক ভাঙনের কবলে পড়ে। শুষ্ক মৌসুমে নদীর প্রবাহ খুব হ্রাস পায়; বিশেষত জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত নদী খাত প্রায় শুষ্ক থাকে। কখনো পাহাড়ী ঢলে আকস্মিক বন্যা কবলিত হয়; কখনো পায়ে হেঁটেই পার হওয়া যায়।
বিকেলে সূর্যাস্তের সময় যখন ধরলা ব্রীজের অনতিদুরে নদীর কিনার দিয়ে হাঁটছি, তখন দেখা হয় যাত্রাপুর কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার যাত্রাপুর গ্রামের তোষারোজ আলীর সঙ্গে। তোষারোপ শশুর বাড়িতে বেড়াতে এসে স্ত্রী-শ্যালিকাদের নিয়ে নদী তীরে বেড়াতে এসেছেন। বললেন, ‘ধরলা পাড়ের মানুষে ভালো থাকা মন্দ থাকা নদীর পানির ওপর নির্ভরশীল। নদীতে পানি থাকলে মানুষ ভালো থাকেন। এখানকার মানুষ মাছ ধরা, চাষাবাদ সবকিছু ধরলার পানির ওপর নির্ভরশীল। পানি না থাকলে গোটা এলাকা মরুভুমির মতো হয়ে যায়। আমার জানা মতে নদীতে পানি না থাকায় অনেক জেলে ঢাকায় গিয়ে রিকশা চালাচ্ছে’।
ধরলা দ্বিতীয় সেতুর যাওয়ার পথে সঙ্গী প্রস্তাব দিলেন কাঁঠালবাড়ীতে চা নাস্তা করার। ভরদুপুরে প্রচন্ড রোদে শরীরের বেহাল দশা। চা খেতে হোটেলে বসতেই সঙ্গী স্থানীয় সাংবাদিককে চিনে ফেললেন দোকানী। মহব্বত আলী নামের ওই দোকানী বললেন, ‘স্যার নদী দেখতে যান। ধরলায় এখন কিছ্ইু পাবেন না। এক সময় রুই-কাতলা বোয়াল ছাড়াও পুঁটি, ট্যাংরা, খলসা, পাবদা, বাতাসি, শিং, মাগুরসহ সব ধরনের দেশি মাছ পাওয়া যেত। পানি শুকিয়ে যাওয়ায় এখন কিছুই পাওয়া যায় না’। চা খেতে পাশের টেবিলে বসেছিলেন জোব্বার আলী নামের এক স্কুল টিচার। বড়ভিটা গ্রামের জোব্বার আলী বললেন, খবর পড়েছি চীন তিস্তা নদী খোড়া শুরু করবে। তিস্তার ওই প্রকল্পে ধরলাকে ফেলা হলে নদীর গভীরতা বাড়বে পানি থাকবে ধরলা পাড়ের মানুষ খেয়ে পরে থাকার অবলম্বন পাবে। ফুলবাড়ি উপজেলার কাশীপুর ইউনিয়নের বেদার উদ্দিন এতক্ষণ পাশের টেবিলে বসে আমাদের কথা শুনছিলেন। তিনি এগিয়ে এসে বললেন, ‘স্যার আপনারা সাংবাদিক। আপনারা যদি ভালোভাবে লেখালেখি করেন তাহলে তিস্তা মহাপ্রকল্পের সঙ্গে ধরলা নদীকেও যুক্ত করা যেতে পারে। চীনের টাকার অভাব নেই। ভারত গজরডোবায় বাঁধ দিয়ে আমাদের পানিতে মারছে; চীনের টাকায় তিস্তা-ধরলা ড্রেজিং করে ভারতকে উচিত জবাব দেব’।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন