২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। আমাদের প্রিয় মাতৃভ‚মি বাংলাদেশের জনগণের কাছে এই দিনটি অত্যন্ত গৌরবের এবং বাঙালি জাতির জন্য প্রভ‚ত গুরুত্ব বহন করে এ দিনটি। ১৯৪৭ এ ভারত ভাগের পর থেকেই ভাষা আন্দোলন, স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকার আন্দোলনের পথ ধরে ১৯৭১ সালে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হয় আমাদের। অবশেষে দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ও অনেক ত্যাগ-তিতীক্ষার বিনিময়ে বিজয় অর্জিত হয় এবং বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।
পাকিস্তানি ঘাতক সেনাবাহিনী ২৫ মার্চ রাতে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পিলখানা, রাজারবাগসহ ঢাকার বিভিন্ন স্থানে এক মর্মান্তিক হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে, তখন ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে নিজ বাসায় গ্রেফতার হওয়ার পূর্বমুহূর্তে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে একটি বার্তা পাঠান। বার্তায় তিনি বলেছিলেন, ‘আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম একটি রাষ্ট্র। একে যে রকম করেই হোক শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করতে হবে।’ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হামলা শুরুর পরপরই দেশের বীর সন্তানেরা বিভিন্ন স্থানে প্রতিরোধযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশমতো যার যা আছে তা-ই নিয়ে মুক্তিসংগ্রামে অংশ নেয় বাঙালি। নয় মাস মরণপণ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় চিরকাক্সিক্ষত স্বাধীনতা।
আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের লড়াই-সংগ্রাম বহুদিনের। বহুদিন ধরে ধীরে ধীরে এ সংগ্রাম এক সময় মহিরুহ রূপ পরিগ্রহ করেছে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম সোপান। ইতিহাসবিদদের মতে, ভাষা আন্দোলনেই আমাদের স্বাধীনতার বীজ নিহিত ছিল। এরপর ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা প্রণয়ন ও তৎপরবর্তী আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান প্রভৃতি প্রতিটি ঘটনার মধ্যেই স্বাধীনতার স্বপ্ন নিহিত ছিল। সবশেষে ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে জয়লাভ করে। দফায় দফায় বৈঠক করার পরও ক্ষমতালিপ্সু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তরে কালক্ষেপণ করতে থাকে। এমতাবস্থায় ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দেন। সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে এই ডাক। দেশের সর্বত্র শুরু হয় তুমুল প্রতিরোধ-আন্দোলন। এরই প্রেক্ষিতে ২৫ মার্চ গভীর রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে ঘুমন্ত বাঙালিদের ওপর।
স্বাধীনতা শব্দটির তাৎপর্য অত্যন্ত গভীর ও ব্যাপক। স্বাধীনতা মানে শুধু নতুন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আয়োজন নয়; স্বাধীনতা হলো স্বাধীন রাষ্ট্রে সার্বভৌম জাতি হিসেবে টিকে থাকার আয়োজন। স্বাধীনতা মানে ইচ্ছে প্রকাশের স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, রাজনীতির স্বাধীনতা, বাক স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক মুক্তি তথা শৃঙ্খলমুক্ত জীবনাচারকে বুঝায়। একটি দেশের স্বাধীনতা সেদিনই সার্থক হয়, যেদিন সে দেশের জনগণ প্রকৃত অর্থে গণতান্ত্রিক পরিবেশে নিজেদের নাগরিক অধিকার নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার ক্ষমতা অর্জন করে। স্বাধীনতা যে কোনো জাতির পরম আকাক্সিক্ষত বিষয়, আরাধ্য ধন। আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার লাভ, গণতান্ত্রিক সুশাসন প্রতিষ্ঠা, ন্যায়নীতিভিত্তিক সমাজ গঠন, অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন, জানমালের নিরাপত্তা বিধান, ধর্ম পালন, নিজস্ব সংস্কৃতি-মূল্যবোধ-বিশ্বাসের অবারিত চর্চা নিশ্চিত করা ইত্যাদি সাধারণ জাতীয় আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নের জন্য স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব প্রতিটা জাতির জন্য অপরিহার্য।
স্বাধীনতা যুদ্ধের মূল উদ্দেশ্য ছিল অসাম্প্রদায়িক, উদার, কল্যাণমুখী, মানবিক, প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। মানুষের মৌলিক ও মানবিক অধিকার এবং ন্যায়সংগত অধিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমে জাতীয় পরিচয় প্রতিষ্ঠা, শোষণ, বৈষম্য, অন্যায়ের অবসান ঘটিয়ে ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত একটি সুখী-সমৃদ্ধ সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ছিল স্বাধীনতার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য।
ইসলামসহ প্রধান প্রধান প্রত্যেকটি ধর্মই মানুষকে স্বাধীনভাবে জীবন পরিচালনা করার অনুপ্রেরণা দেয়ার পাশাপাশি স্বাধীনতার মর্যাদা রক্ষারও তাগিদ প্রদান করে। নবী করীম (স.) ইরশাদ করেন, একদিন নিজ মাতৃভ‚মির সীমান্ত পাহারা দেওয়া পৃথিবী ও তার অন্তর্গত সবকিছুর চেয়ে উত্তম। অন্য এক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, মৃত ব্যক্তির সব আমল বন্ধ হয়ে যায়। ফলে তার আমল আর বৃদ্ধি পেতে পারে না। তবে ওই ব্যক্তির কথা ভিন্ন, যে ব্যক্তি কোনো ইসলামী রাষ্ট্রের সীমান্ত পাহারায় নিয়োজিত থাকা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে। তার আমল কিয়ামত পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে থাকবে এবং কবরের প্রশ্নোত্তর থেকেও সে মুক্ত থাকবে। (তিরমিযি ও আবু দাউদ)
নাগরিক জীবনে স্বাধীনতার মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে সর্বোচ্চ মর্যাদাদান করা উচিত সকলের। স্বাধীনতার অর্জন যাতে কোনোভাবেই ম্লান না হয়, সেদিকে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখা উচিত প্রতিটি নাগরিকের। স্বাধীনতা দিবস শুধু স্মৃতিচারণ নয়, জাতীয় জীবনে স্বাধীনতা অর্থবহ, তাৎপর্যময় করে তোলার পাশাপাশি স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব সংরক্ষণে অঙ্গীকার করার দিনও। স্বাধীনতা অর্জন যত কঠিন, স্বাধীনতা রক্ষা করা তার চেয়ে আরো বেশি কঠিন। চলমান বিশ্ব প্রেক্ষাপট এবং আমাদের বাস্তবতায় এই বিষয়টি নানাভাবে বিবেচিত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। জাতির স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নের মাধ্যমে জাতীয় নিরাপত্তা ও জাতীয় সমৃদ্ধি নিশ্চিত করা সম্ভব।
স্বাধীনতা লাভের অর্ধ-শতাব্দী পার করলেও আজও দারিদ্র্য ও ক্ষুধামুক্ত সুখী-সমৃদ্ধ শান্তিপূর্ণ ও মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে আমরা পারিনি। নির্লজ্জ দলীয়করণ ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের লুণ্ঠন অব্যাহত আছে। নৈতিকতার অবক্ষয়, অসৎসঙ্গ, মোবাইল ও ইন্টারনেট আসক্তি, বেকারত্বের দুর্বিপাকে দিশেহারা হয়ে আজকের যুব সমাজ লিপ্ত হচ্ছে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে অথবা আসক্ত হচ্ছে মরণ নেশা মাদকের দিকে। দারিদ্র্য, মূল্যবোধের অবক্ষয়, স্বজনপ্রীতি, হিংসাত্মক অপরাজনীতি, লেজুড়ভিত্তিক ছাত্র রাজনীতি, ঘুষ, সীমাহীন দুর্নীতি প্রভৃতি স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়নের লাগাম টেনে ধরে আছে। বর্তমান সংকট উত্তরণের জন্য যে কাজটি সর্বাগ্রে করা উচিত তাহলো, শিক্ষাব্যবস্থার সকল স্তরে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা গ্রহণকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। আমাদের তরুণ প্রজন্মকে নৈতিক স্খলন থেকে বাঁচানোর এর থেকে ভালো কোনো পথ আছে বলে আমার জানা নেই। যেহেতু বিশ্বের সকল ধর্মের মূলমন্ত্র হলো মানব জাতিকে খারাপ-অশ্লীল-অন্যায় কাজ থেকে বিরত রেখে ন্যায় ও মানবিক পথে পরিচালিত করা, সেজন্য যার যার ধর্মীয় রীতি-নীতি শিক্ষা গ্রহণ ও প্রত্যেকের নিজ জীবনে তা বাস্তবায়ন ছাড়া সমাজে শান্তি ফিরিয়ে আনা অসম্ভব।
লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক ও সহ. অধ্যাপক, শেরপুর সরকারি মহিলা কলেজ, শেরপুর
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন