রাজশাহী অঞ্চলের আম বাগানগুলোয় এবার আবহওয়া অনুক‚ল থাকায় মুকুলে মুকুলে ছেয়ে গিয়েছিল গাছগুলো। গাছ ভরা দৃষ্টিনন্দন মুকুল জানান দিচ্ছিল ভাল ফলনের। শুধু আমের রাজধানী রাজশাহী অঞ্চল নয় সারাদেশে এবার গাছে গাছে মুকুল এসেছে। ডগায় ডগায় ঠাস বুনন গুটি। যে সব মুকুলে গুটি আসেনি তা এখন ঝুরঝুর করে ঝরে পড়ছে। এসব গুটি এখন ধীরে ধীরে বাড়ছে। প্রবাদ আছে আমের আনা মাছের পাই। তা থাকলে কে কত খায়। অর্থাৎ গাছে গাছে যত যত মুকুল আসে তার যদি ষোল আনার মধ্যে এক আনাও থাকে আর মাছ যে ডিম পাড়ে তার যদি পাই পয়সার সমান উৎপাদন হয় তাইই অনেক।
গাছে গাছে মুকুলের পর এমন ঠাস বুনন গুটি দেখে বাম্পার ফলনের আশা করছেন চাষিরা। চৈত্র এসে আবহাওয়া একটু একটু করে তেঁতে উঠছে। তাপমাত্রা উঠেছে আটত্রিশ ডিগ্রী সেলসিয়াসে। কড়া তাপ আর বৃষ্টি হীনতা চোখ রাঙ্গাচ্ছে। চলছে আম বাগানে সেচ। আবার গুটিতে হপার পোকা নামক এক ধরনের পোকা বাগানে বাগানে হানা দিচ্ছে। আম চাষিরা তা দমনে কীটনাশক স্প্রে করছেন। নেমে পড়েছেন বাগানের যতেœ। কৃষি বিভাগ আর আম চাষীদের বাম্পার প্রলনের প্রত্যাশা নির্ভর করছে আবহাওয়ার মতি গতির উপর। এখন খরা আর ঝড় ঝাপটার দিকে নজর। ঝড় ঝাপটা আর শিলা বৃষ্টির উপর কারো হাত নেই। ভাল ফলনের লক্ষ্য নিয়ে সারাদেশে বাগানে বাগানে পরিচর্যায় ব্যাস্ত সময় পার করছেন চাষিরা। এবার আমের রাজধানী রাজশাহী অঞ্চলে আমের আবাদ হচ্ছে ৮১ হাজার হেক্টরেরও বেশী জমিতে। গত বছরের চেয়ে এবার ৮ হাজার হেক্টর বেশী জমিতে আমের আবাদ হচ্ছে। এরমধ্যে রাজশাহীতে ১৭ হাজার ৬৮৬ হেক্টরে। গত বছরের চেয়ে এবার আম বাগানের সংখ্যা বেড়েছে ১ হাজার হেক্টর জমি। সবচেয়ে বেশী বাগানের বিস্তৃতি ঘটেছে নওগাঁ জেলায়। গতবার সাড়ে ১৮ হাজার হেক্টর জমিতে আম বাগান থাকলেও এবার তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে পঁচিশ হাজার হেক্টর জমিতে। আমের রাজধানী চাঁপাইনবাবগঞ্জে এবার তেত্রিশ হাজার হেক্টর জমিতে আমের আবাদ হচ্ছে। যা গত বছরের চেয়ে ১ হাজার হেক্টর বেশী জমিতে। আর নাটোরে সাড়ে পাঁচ হাজার হেক্টর জমিতে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ধান উৎপাদনকারী এলাকা হিসাবে খ্যাত নওগার সাপাহার, পোরসা, বদলগাছি উপজেলায় জোতদাররা ধানের চেয়ে আমে লাভ বেশী বলে ধানের জমিকে বাগানে রুপান্তর করেছেন। একেকটি বাগান হচ্ছে আড়াইশো তিনশো বিঘার। এমনিভাবে রংপুর, দিনাজপুর, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, সাতক্ষীরাতে আম বাগান বাড়ছে। রংপুরের মিঠা পুকুরও বদরনগর এলাকায় বেড়েছে হাড়িভাঙ্গা আমের বাগান। রংপুরের প্রায় তিন হাজার হেক্টর আমের বাগানের মধ্যে এখন সিংহভাগ বাজার দখল করেছে হাড়িভাঙ্গা। এ আম স্বপ্ন দেখাচ্ছে। দিনাজপুরের চার হাজার হেক্টর জমিতে আবাদ হচ্ছে আমের।
রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আব্দুল আলিমের অভিমত এবার আবহাওয়া ভাল থাকায় আমের গুটি ভাল হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে ফলন ভালই হবে। আম গাছগুলোতে যত গুটি এসেছে তার সামান্য থাকলেও বাম্পার ফলনের প্রত্যাশা করাই যায়।
বিশিষ্ট আম বিজ্ঞানী ড. মো. শরফ উদ্দিন বলেন, দেশে আম উৎপাদনে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। প্রতিবছর বাড়ছে আমের বাগান, বাড়ছে ফলন। প্রতিবছরই আমের উৎপাদন ভাল হচ্ছে। যদিও গতবার মহামারি করোনার বিরুপ প্রভাব আমের উপর পড়েছে। এবারও ঠিক আম মৌসুমেই আবার করোনার বিস্তার দেখা যাচ্ছে। তবে আশা করা যায় গতবারের অভিজ্ঞতা থেকে পদক্ষেপ নেয়া যাবে। সরকারীভাবে আম পরিবহনের জন্য ম্যাঙ্গো স্পেশাল ট্রেন এটি ভাল পদক্ষেপ। তিনি বলেন, আমের বাজার ব্যবস্থাপনা নিয়ে এখনই পরিকল্পিতভাবে এগোতে হবে। দেশে আমের বাজার দশ হাজার কোটি টাকারও বেশী। তাছাড়াও এর সাথে শ্রমিকের মজুরী, প্যাকিং পরিবহন বিদেশে আম, জুস আবার রফতানি সব মিলিয়ে আরো দেড় হাজার কোটি টাকা যোগ হয় আম অর্থনীতিতে।
আম বাগান ঘিরে পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়েছে স্থানীয়রা। বিশেষ করে বড় বড় আম বাগানের মালিকদের উৎসাহিত করা হচ্ছে যাতে বাগানের মধ্যে বাইরে থেকে মানুষ এসে কিছুক্ষণ বসতে পারে। লাখ লাখ গাছের কোটি কোটি আমের দুলনী তাদের স্বাগত জানাতে পারে। বাগানে বসে টাটকা কাচা পাকা আমের স্বাদ নেবার ব্যবস্থা করা যায়। অনেক নতুন বাগান মালিক এমন পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছেন বলে জানান। ইতোমধ্যে তেমন দু’একটা প্রচেষ্টা নজর এড়ায়না। সব মিলিয়ে আম নিয়ে চলছে হাজার হাজার কোটি টাকার নানা রকম ব্যাপার স্যাপার। এখন শুধু প্রয়োজন সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও নজরদারী।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন