পৃথিবীব্যাপী ধর্মীয় উপলক্ষ বা দেশীয় উৎসবের সময় জিনিসপত্রের দাম কমে। উৎসব ঘিরে ইউরোপ-আমেরিকায় ছাড়ের হিড়িক পড়ে যায়। অনেকে বছরভর এ সময়টার জন্যই অপেক্ষা করে। সারা বছরের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনে রাখে তারা। ছাড় আর সেলের এ রীতি দুনিয়াজোড়া, ব্যতিক্রম শুধু বাংলাদেশ! এখানে সবরকম উৎসবের আগে পণ্যের দাম বাড়ে। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা সারাবছরই ভেজাল মিশিয়ে কিংবা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে ক্রেতাসাধারণের পকেট কাটেন। রোজার সময় তাদের অপতৎপরতা বেড়ে যায় কয়েকগুণ। সরকারি নিয়ন্ত্রণের অভাবে তারা মুনাফা শিকারে চরম বেপরোয়া হয়ে উঠেন। তাদের অতি মুনাফালোভী মনোবৃত্তির কারণে রমজানে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগের সীমা থাকে না।
অথচ, সকল মুসলিম রাষ্ট্রে রমজান মাসে পণ্যের দাম কমাতে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। আমাদের দেশে কিন্তু পুরো উল্টো। অন্য মুসলিম দেশের ব্যবসায়ীরা ১১ মাস ব্যবসা করে রোজার মাসে পণ্যের দাম কমিয়ে রোজাদারদের সেবা করে। পবিত্র রমজানে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ব্রুনাই, কুয়েত, কাতার, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্রে জিনিসপত্রের মূল্য কমিয়ে নানা রকম সুযোগ-সুবিধা ও অফার দেয়া হয়ে থাকে। ওরাও মুসলমান আমরাও মুসলমান, বিষয়টা ভাবতেও লজ্জা লাগে। আসবে রোজা বাড়বে দাম, এটাই যেন বাংলাদেশের ঐতিহ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। সব মিলিয়ে স্বাধীনতার ৫০ বছর পর হাতে গোনা কিছু লোক ভালো থাকলেও ভালো নেই বেশীরভাগ মানুষ! নীরবে নিভৃতে কাঁদছে তারা!
দীর্ঘদিন ধরে চালের দাম বেশি। কোনোভাবেই দাম কমল না। এতে নিম্ন ও মধ্যআয়ের সংসারে চলছে অস্থিরতা। দেশের পরিস্থিতি এমন যে, নিম্নবিত্তের উচ্চদামে পণ্যক্রয়ের কষ্ট বোঝার বা দেখার কেউ নেই। কোনো কিছুর দাম একবার বাড়লে আর কমে না। পরিবহন সেক্টরের মতোই ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কাছে সর্বসাধারণ যেন অসহায়। রোজা এলেই কেন জিনিসপত্রের দাম বাড়বে? এ তো জানা কথাই যে, রোজায় কিছু পণ্যের চাহিদা বাড়ে। এর মধ্যে আছে পেঁয়াজ, ছোলা, ডাল, চিনি, দুধ, তেল, আটা, মুড়ি, খেজুর, আলু, বেগুন, শসা ইত্যাদি। এসব পণ্য কী পরিমাণ লাগবে, তাও আমাদের জানা আছে। আগেভাগেই কেন আমরা সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারি না। নির্দিষ্ট একটি পণ্য দেশে কতটুকু আছে, কতটুকু উৎপাদিত হয়েছে, বাড়তি কতটুকু আমদানি করতে হবে, তার হিসাব কৃষি ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে অবশ্যই থাকতে হবে। প্রতিবছরই তাহলে কেন এ অনিয়ম? এ ধারা কী যুগ যুগ ধরেই চলবে?
তথ্য অনুযায়ী, রমজানে ভোজ্যতেলের চাহিদা ২ লাখ টন, পেঁয়াজ ৫ লাখ টন, চিনি ১ লাখ ৩৬ হাজার টন, ছোলা ৮০ হাজার টন। তাহলে কী কী দরকার, কখন দরকার, আর কতটুকু দরকার, এসব তথ্য বাজার সংশ্লিষ্টদের অজানা নয়। তারপরও কেন পণ্যের আকাল পড়ে, দাম বাড়ে? প্রশাসন থেকে বলা হয়, পণ্যের ঘাটতি নেই, বিপরীতে আমরা দেখছি দামেরও মাত্রা নেই! অথচ বাজার নিয়ন্ত্রণে মন্ত্রণালয়সহ নানা পর্যায়ের মাথাভারি কর্তৃপক্ষ রয়েছে। জনগণের কষ্টার্জিত অর্থে তাদের বেতন-ভাতা দেয়া হয়। তাহলে সংশ্লিষ্টজনরা কে কতটুকু দায়িত্ব পালন করছেন?
বাংলাদেশে অনেক দরিদ্র এবং মধ্যবিত্ত পরিবার দারিদ্রের গ্লানি থেকে বেরুতে পারছে না শুধুমাত্র নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্য ও চিকিৎসা ব্যয়ের কারণে। মানুষ যেকোন কিছুর বিনিময়ে পরিবারের সদস্যদের সুস্থ দেখতে চায়, কিন্তু দেশে খাদ্যের দাম-মান, চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং পরিবেশ দূষণের প্রভাব এত বেশি যে, সুস্থ থাকাটা দূরহ হয়ে পড়েছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৫ দশমিক ৪২ শতাংশে উঠেছে। সাধারণত নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের দাম দিয়ে খাদ্যমূল্যস্ফীতির হিসাব করা হয়। আর মূল্যস্ফীতির প্রভাব গরিব মানুষের ওপরই বেশি পড়ে। কারণ, তাদের আয়ের বড় অংশই চলে যায় খাদ্যপণ্য কিনতে। আর খাদ্যপণ্য কিনে যত টাকা খরচ হয়, এর ৫০-৬০ শতাংশ চলে যায় চালের পেছনে। তাই মোটা চালের দাম বাড়লে মূল্যস্ফীতির ওপর বেশি প্রভাব পড়ে। ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়লে গরিবেরা সবচেয়ে বেশি চাপে থাকে। এমন উন্নয়ন কাম্য নয়, যেখানে নিম্নমধ্যবিত্তদের জীবনের আহার জোগাতে হিমশিম খেতে হয়! কৃষিপ্রধান দেশে চালের কেজি ৬০ আর ভোজ্যতেলের কেজি ১৩০+। এভাবে কী একটি পরিবারের জীবন চালানো সম্ভব?
তেলের দাম যত বাড়ছে, এ খাত থেকে সরকারের রাজস্ব আয়ও বাড়ছে। কারণ, আমদানির কর কাঠামো এমন যে, আমদানিতে ব্যয় বাড়লে সরকারের রাজস্বও বাড়ে। ‘রাজার রাজস্ব, গরিবেরা নিস্বঃ!’ যদিও ব্যবসায়ীরা দুই বছর ধরে ভোজ্যতেলের তিন স্তরের বদলে এক স্তরে মূল্য সংযোজন কর (মূসক/ভ্যাট) আদায়ের অনুরোধ জানিয়ে আসছেন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ও একাধিকবার এ নিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে চিঠি দেয়। তারপরও ভ্যাট ছাড় মেলেনি। নিত্যপ্রয়োজনীয় এই খাতে ভর্তুকি দিলে সাধারণ মানুষ একটু স্বস্তি পাবে বলে আমরা মনে করি।
অর্থনীতি বিষয়ের সুপরিচিত গবেষণা সংস্থা সানেম বলছে, দেশে দারিদ্র্যের সার্বিক হার বেড়েছে। গত নভেম্বর-ডিসেম্বরে পরিচালিত জরিপ থেকে পাওয়া তাদের হিসাবে, দেশে দারিদ্র্যের হার ৪২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এক বছর আগের চেয়ে দারিদ্র্য পরিস্থিতি প্রায় দ্বিগুণ দেখা যাচ্ছে জরিপে। আমরা ধারণা করছি, মহামারির আঘাত এটি। কিন্তু মহামারির মধ্যেই দেশে ছয় মাসে কোটিপতি ব্যাংক হিসাব বেড়েছে ৪ হাজার ৮৬৩টি। ২০২০-এর মার্চে কোটি টাকার বেশি আমানত রাখা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ৮২ হাজার ৬২৫টি। সেপ্টেম্বরে তুমুল করোনার মধ্যে সেটা দাঁড়িয়েছে ৮৭ হাজার ৪৮৮টি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে পাওয়া ছয় মাসের এসব তথ্য পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। সানেমের খানা জরিপে দেখা গেছে, করোনার প্রভাবে উপায়হীন বিপুল মানুষ খাবারের বাইরে অন্য অনেক খরচ বাদ দিচ্ছে। খাবারের তালিকাও কাটছাঁট করেছে। অনেকে সঞ্চয় ভেঙেছে এবং ভাঙছে। মানুষ বাজার ও চিকিৎসা খরচ সামলাতে পারছে না। সানেমের জরিপকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যের সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে মনে হয়, দেশে দারিদ্র্য বাড়ার পাশাপাশি সম্পদও ব্যাপক হারে বাড়ছে। তবে গুটিকয়েক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের হাতে পুঞ্জীভ‚ত হচ্ছে সেসব।
মুক্তিযুদ্ধের রজতজয়ন্তী পূর্তিকালে এটা অবশ্যই বাংলাদেশের জন্য অতি বাজে খবর। মুষ্টিমেয় মানুষ উল্কার বেগে ধনী হতে থাকবে আর দারিদ্র্যের হার ক্রমে স্ফীত হতে থাকবে। এই দৃশ্য উদ্যাপনের জন্য গরিব শ্রমিক-কৃষক, ছাত্র-জনতা নিশ্চয়ই একাত্তরে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেনি। অথচ সেটাই ঘটছে। কিছুদিন আগে যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা সংস্থা ওয়েলথ ট্যাক্সের প্রতিবেদনেও একই রকম ইঙ্গিত মিলেছিল। আর্থিক তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে সংস্থাটি বলেছিল, অতি ধনী মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির হারে বাংলাদেশ অতি এগিয়ে।
বর্তমানে আমরা যে উদ্বেগের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, তার উৎস শুধু কোভিড নাইনটিন নয়, বরং আরো একটি মহামারি, যা আমাদের নিজেদের বা বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে থাকা প্রিয়জনদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। সেটা হচ্ছে ‘পণ্যমূল্য বৃদ্ধির মহামারি’। বর্তমানে পণ্যমূল্য বৃদ্ধির মেরুকরণ দ্বারাই বেশি আক্রান্ত সাধারণ মানুষ। এটি খুবই বড় দুঃসংবাদ যে, দুটি মহামারি আমাদের দেশে একযোগে কাজ করছে। বেকারত্ব ও আয় রোজগার হারানোর উদ্বেগের কারণে ভাইরাস মোকাবিলায় যথেষ্ট পূর্বসতর্কতা গ্রহণ ছাড়াই লোকদের কাজে যোগ দিতে মরিয়া করে তুলছে।
লেখক: সংবাদকর্মী
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন