আবু হেনা মুক্তি : বৃহত্তর খুলনাঞ্চলের চিহ্নিত ঘাটগুলো দিয়ে প্রতি বছর এমন সময় প্রতিদিন হাজার হাজার গরু পার হয়ে ভিড় জমাতো এ অঞ্চলের গরুর হাটগুলোতে। সে পথ এখন রুদ্ধ। তবে সেই পথ দিয়ে আসছে মসলা, মাদকদ্রব্য আর শাড়িকাপড়। ভারতীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজর গরুর দিকে। আর এই সুযোগে চোরাচালান সিন্ডিকেট স্মাগলিং গুডস আনছে দেদারসে। খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলার বিপণি বিতানগুলোতে এখন শেষ মুহূর্তে ভারতীয় পণ্যে সয়লাব। আর মসলার মার্কেটে প্রতিদিন ঢুকছে বিনা শুল্কে চোরাইপথে আনা জিরা, গরম মসলা,
আদা, রসুন এবং যুবসমাজের হাতে পৌঁছে যাচ্ছে ফেনসিডিল আর ইয়াবা। চোরাকারবারিরা চকোলেট সামগ্রী, চিপস, হরলিক্স আর কসমেটিকস আনছে হরহামেশা।
ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে চোরাচালান পুরোদমে শুরু হয়েছে। ঈদুল ফিতরের পর চোরাচালানে কিছুটা ভাটা পড়ে। তবে মাদকদ্রব্য চোরাচালানিরা কোনো অবস্থায় কখনই থেমে নেই। গত পক্ষকাল ধরে বৃহত্তর খুলনাঞ্চল ও সীমান্ত অঞ্চলে র্যাব, কোস্টগার্ড, গোয়েন্দা পুলিশ ও বিডিআর চোরাচালানি পণ্য উদ্ধার করলেও শাড়িকাপড়, মসলা ও মাদক চোরাচালান কোনোভাবেই ঠেকানো যাচ্ছে না। কোনো না কোনো পথে প্রতিনিয়ত চোরাচালান অব্যাহত রয়েছে। প্রায়ই ধরা পড়ছে। তবুও অপ্রতিরোধ্য সিন্ডিকেট চক্রটি। চোরাকারবারিরা প্রতি মুহূর্তে রুট বদলাচ্ছে। কিন্তু গোয়েন্দা নজরদারি এড়াতে পারে না। তিন কোটি কখনো সাত কোটি টাকার মাল ধরা পড়ার পরও চোরাকারবারিরা বেপরোয়া। সীমান্ত এলাকা দিয়ে প্রতিনিয়ত খুলনাঞ্চলে ভারতীয় শাড়ি, থ্রিপিস ও কাপড়চোপড় এবং গরম মসলাসহ বিভিন্ন মালামাল আসছে। নগরীর বিপণি বিতানগুলোতে ভারতীয় শাড়িকাপড়ে সয়লাব। তাদের গোডাউনে রয়েছে লাখ লাখ টাকার মালামাল। অপরদিকে ঈদকে সামনে রেখেই কথিত ফিলিংসের জন্য ফেনসিডিল, গাঁজা, হেরোইন, বাংলা মদ ঢুকছে। চোরাকারবারিরা ফুলেফেঁপে কোটিপতি হচ্ছে। আর যুবসমাজ এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। মাদকের কারণেই বৃহত্তর খুলনার অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। চার দিকে খুন, রাহাজানি, চাঁদাবাজি, সংঘাত চরম আকার ধারণ করেছে। ঈদের আগ মুহূর্তে নেশার টাকা জোগাতে মাদকসেবীরা তৎপর হয়ে উঠেছে।
সূত্র মতে, সা¤প্রতিককালে খুলনাসহ তৎসংলগ্ন এলাকায় অবৈধ ভারতীয় কাপড়ের চোরাচালানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বাগেরহাট, খুলনা ও সাতক্ষীরা এলাকাসমূহে কোস্টগার্ড পশ্চিম জোন কর্তৃক টহল জোরদার করা হয়েছে। তাছাড়া পবিত্র ঈদ উপলক্ষে চোরাচালানির আনাগোনা ও কার্যক্রম তুলনামূলক বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশ কোস্টগার্ড পশ্চিম জোনের অপারেশন কর্মকর্তা জানান, একটি চক্র অবৈধ ভারতীয় পণ্য চোরাচালানি করে আসছে। চোরাচালান বন্ধে বাংলাদেশ কোস্টগার্ড পশ্চিম জোনের নিয়মিত অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে জানানো হয়। এদিকে, প্রতি বছর কোরবানির ২০ দিন আগে থেকে চোরাচালানি ঘাট দিয়ে ব্যাপক হারে ভারতীয় গরু পাচার হয়। এবার চিত্র ভিন্ন। গরু না এলেও ঐ গরু চোরাকারবারি সিন্ডিকেট চক্র গরুর চামড়া নিতে প্রাথমিক প্রস্তুতি নিয়েছে ইতোমধ্যে। চামড়া ব্যবসায়ীদের অভিমত, প্রতি বছর চামড়া পাচার হয়। এবারও অসাধু ব্যবসায়ীরা ভারতীয় ব্যবসায়ীদের কাছে চামড়া দিতে গোপনে আঁতাত করলেও সে বিষয়ে দৃশ্যত কোনো আগাম ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। আদৌ হবে কি না তা জনগণের বোধগম্য নয়।
অপরদিকে, সাতক্ষীরা সীমান্ত দিয়ে খুলনা ও সীমান্ত অঞ্চলের চোরাচালান সিন্ডিকেট প্রতিনিয়ত শাড়িকাপড় ও মাদকদ্রব্য চোরাচালান করছে। জানা গেছে, পুলিশের কতিপয় কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে চলছে এই বাণিজ্য। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে একটি চক্র একের পর এক কালোবাজারি করলেও কেন তাদের আইনে সোপর্দ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা যাচ্ছে না তা খতিয়ে দেখার দাবি জানিয়েছেন সচেতন মহল। বর্তমান সরকার চোরাচালান রোধে অত্যন্ত আন্তরিক। অথচ ফাঁক- ফোকর দিয়ে প্রতিনিয়ত খুলনাঞ্চলে চোরাচালান চলছে। সামান্য কিছু অর্থের বিনিময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কতিপয় সদস্য বেমালুম চেপে যাচ্ছে। বø্যাকিং রুট ওপেন করে দিচ্ছে।
এদিকে, রাজধানীভিত্তিক চোরাচালানের ল্যান্ডিক্যাটাল হিসেবে ব্যবহার করা হয় সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাটকে। এখানকার তালিকাভুক্ত চোরাচালানিরা ক্ষমতাসীনদের ছত্রছায়ায় অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে বছরের পর বছর। এরা যেন ক্ষমতাসীনদের আশীর্বাদপুষ্ট। আর অসাধু কর্মকর্তাদের আস্থাভাজন। তাই এদের যেন রোখা দায়। খুলনাঞ্চলে চোরাচালানে এখন শীর্ষে রয়েছে ফেনসিডিল ও ইয়াবা। বৃহত্তর খুলনাঞ্চলে রোজার শুরু থেকেই এবং কোরবানির ঈদ পর্যন্ত ব্যাপকভাবে ফেনসিডিল ও ইয়াবা ঢুকছে এবং ঢুকবে বলে সূত্রগুলো জানায়। প্রতিনিয়ত ইয়াবা ধরা পড়ছে। এছাড়া হেরোইন, গাঁজা ও ভারতীয় নিম্নমানের মদ আসছে দেদারসে। খুলনাঞ্চলের তরুণ, যুবক-যুবতী থেকে শুরু করে একশ্রেণীর শিক্ষিত সমাজের কাছে ইয়াবা সেবনের জনপ্রিয়তা রয়েছে। খুলনা মহানগরীর ৫০টি স্পটে এবং সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের শতাধিক স্পটে ইয়াবা পাচারকারীরা তাদের এজেন্টের মাধ্যমে দেদারসে বিক্রি করছে। এদেশের ফেনসিডিল ও ইয়াবার বাজার পুরোটাই দখল করে আছে ভারত। সীমান্ত দিয়ে পার হয়ে আসা মাদকদ্রব্যের মধ্যে সামান্য ধরা পড়েছে র্যাব ও পুলিশের হাতে। দু-একজন এজেন্ট ধরা পড়লেও মূল গডফাদাররা কেউই ধরা পড়ছে না। চোরাচালান সিন্ডিকেট চক্র পর্দার আড়াল থেকে কলকাঠি নাড়াচ্ছে। প্রতি মাসে আয় করছে কোটি কোটি টাকা। অপর একটি সূত্র মতে, নৌপথে ব্যাপক হারে ইয়াবা, ফেনসিডিল ও বিয়ার আসছে। সুন্দরবনের নৌপথ চোরাচালানের আধুনিক রুট হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। সুন্দরবনের দস্যু বাহিনীরাও এই চোরাচালানিদের পৃষ্ঠপোষকতা করে থাকে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন