দেশে করোনা সংক্রমণে ফের ঊর্ধ্বগতি দেখা দিয়েছে। হু হু করে বাড়ছে সংক্রমণ ও মৃত্যু। কেন এমন হচ্ছে? কী কার্য-কারণ কাজ করেছে এর পেছনে? এটা কি প্রত্যাশিত ছিল? হয়ে থাকলে এর মোকাবেলায় আমাদের প্রস্তুতিই বা কতটুকু? বিপদ যখন এসেই পড়ল, আমরা কি সঠিক কর্মপরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছি? সংকট উত্তরণ, জনদুর্ভোগ লাঘব ও মৃত্যুর সংখ্যা ন্যূনতম পর্যায়ে রাখতে বিষয়গুলো গভীরভাবে নিরীক্ষণ ও পর্যালোচনার দাবি রাখে।
গত বছর ৮ মার্চ দেশে প্রথমবারের মতো করোনা রোগী শনাক্ত হয় এবং ১৮ মার্চ প্রথম কোনো ব্যক্তি এ রোগে মৃত্যু বরণ করেন বলে নিশ্চিত করা হয়। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহানে প্রথম আবির্ভাবের পর ইউরোপ, আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ ঘুরে রোগটি যখন এ দেশে ছড়াতে শুরু করে, বুঝা গেল, আমাদের প্রস্তুতি একেবারেই অপ্রতুল। দেখা গেল, রোগটির আবির্ভাবের পর এ দেশে আসা অব্দি মাঝখানে যে দু’ আড়াই মাস সময় পাওয়া গিয়েছিল, রোগটির প্রকৃতি বুঝা এবং এর শনাক্তকরণ, ব্যবস্থাপনা ও বিস্তার রোধে যথাযথ কর্ম-পরিকল্পনা প্রণয়নে আমরা এ সময়টুকুর সদ্ব্যবহার করতে পারিনি। ফলে, শুরুতে সারাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় এক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। রোগী ও চিকিৎসক নির্বিশেষে সকলের উপর দিয়ে যেন এক প্রচন্ড ঝড় বয়ে যায়।
গত এক বছরে মানুষ এ রোগ সম্পর্কে অনেক শিখেছে। প্রাথমিক হযবরল অবস্থার পর দু’ চার মাস শেষে শুরুর দিককার আতঙ্ক কেটে যায়। ইতোমধ্যে এ রোগ প্রতিরোধ ও মোকাবেলায় ব্যক্তিক ও সামষ্টিক পর্যায়ে কী কী করণীয় সে বিষয়েও সবাই কম-বেশি ধারণা অর্জন করেছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের উদাহরণ থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে যায়, এ রোগ মোকাবেলায় বেসিক পলিসি হিসেবে এর বিস্তার রোধের উপর সর্বাত্মক গুরুত্ব আরোপ করতে হবে, যাতে মহামারি নিয়ন্ত্রণে না আসা পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি করে সাধারণ শয্যা কিংবা আইসিইউতে সেবা দিতে হবে এমন রোগীর সংখ্যা দেশের হাসপাতালসমূহের সামর্থ্যের মধ্যে সীমিত রাখা যায়। এ জন্যে করোনা উপদ্রুত প্রায় সব দেশেই যে সব ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছিল তার মধ্যে ছিল, রোগী শনাক্তকরণ, আইসোলেশন, কোয়ারেন্টিন, সাবান-পানিতে হাত ধোয়া, হ্যান্ড স্যানিটাইজেশন, মাস্ক পরিধান, আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে বিধি-নিষেধ এবং স্থানীয় পর্যায়ে সীমিত পরিসরে কিংবা সর্বাত্মক লকডাউন। লকডাউনের মতো ব্যবস্থা দেশের শিল্প-কারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য ও স্বল্প-আয়ের খেটে খাওয়া মানুষের জন্য এক বিশাল ধাক্কা হিসেবে আবির্ভূত হয়, যে কারণে সরকার করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে না আসা সত্তে¡ও মাস দুয়েক পর আরোপিত লকডাউন পর্যায়ক্রমে প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়।
আমাদের সৌভাগ্য, এরকম অবস্থায় লকডাউন প্রত্যাহারের পরও, বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা মিথ্যে প্রমাণ করে, মহামারির স্বাভাবিক প্রকৃতি অনুযায়ী সংক্রমণের মাত্রা একটি চূড়ায় পৌঁছানোর পর এক পর্যায়ে কমতে শুরু করে এবং বছরের শেষ নাগাদ মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। তবে, বিজ্ঞানীরা বার বার সাবধান করছিলেন, করোনা ফের আরও ভয়াবহ রূপে ফিরে আসতে পারে। উদাহরণ হিসেবে তাঁরা শত বছর আগেকার স্প্যানিশ ফ্লুর কথা বলছিলেন, যার দ্বিতীয় ঢেউটি প্রথম ঢেউয়ের চেয়ে অনেক ভয়াবহ ছিল। এ ছাড়া বিশ্বের অনেক দেশেই করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসার পর আবারও বৃদ্ধি পাওয়ার ঘটনা ঘটছিল। সুতরাং দেশে করোনার আরেকটি ধাক্কা আসতে পারে, এটা একরকম অবধারিতই ছিল। প্রধানত শ্বাসতন্ত্রের রোগ হওয়ার কারণে ধারণা করা হচ্ছিল, ধাক্কাটা হয়তো শীতেই আসবে। এ কারণে সরকার সব কিছু খুলে দিলেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ খুলে দেয়ার সাহস করেনি। সঙ্গত কারণে শুধু বিজ্ঞানীরাই নন, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও জনসাধারণকে করোনার সম্ভাব্য দ্বিতীয় ঢেউয়ের ব্যাপারে সাবধান করে যাচ্ছিলেন। আল্লাহর ইচ্ছা, শীতকালটা ভালয় ভালয় পার হয়ে গেল। এদিকে দেশের মানুষ কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করছিলেন, যদি করোনার টিকাটাও চলে আসে। সৌভাগ্যবশত, বছরের শুরুতে টিকারও একটি চালান চলে এলো, যা ছিল করোনার বিরুদ্ধে আমাদের চলমান যুদ্ধে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। অন্যদিকে, কিছু বিজ্ঞানী এমন ধারণা দিয়ে আসছিলেন যে, বিগত বছরের শেষ নাগাদ জনসাধারণের মধ্যে সংক্রমণের ব্যাপকতা হার্ড ইমিউনিটি তৈরির মতো পর্যায়ে উপনীত হতে পারে। এই যখন সামগ্রিক অবস্থা, তখন জনসাধারণের একটি বড় অংশের মধ্যে ফুরফুরে ভাব চলে আসে। চলতি বছরের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে সংক্রমণের হার পুরো সময়কালের মধ্যে নিম্নতম পর্যায়ে নেমে এলো। কেউ কেউ ভাবতে শুরু করলেন, করোনার এই আপদ বিদায় হলো বুঝি। অনেকেই মাস্ক পরিধান ও সামাজিক দূরত্বের মতো বিষয়গুলো থোড়াই কেয়ার করতে শুরু করলেন। চারিদিকে মাহফিল-সমাবেশ, বিয়ে-শাদির যেন হিড়িক পড়ে গেল। পর্যটন কেন্দ্রগুলোয় দেখা দিলো উপচেপড়া ভিড়। ফলে, যে ধাক্কাটা শীতে আসি আসি করেও আসেনি সেটা অবশেষে এলো, তবে গরমের শুরুতে। মার্চের শুরু থেকে সংক্রমণ বাড়তে শুরু করল এবং দ্রুতই এ বৃদ্ধির হার তীব্র গতি নিল। প্রথম ধাক্কার চেয়ে এই দ্বিতীয় ধাক্কাটা শুধু যে সংক্রমণের হারের দিক থেকেই অনেক তীব্র তা নয়, রোগের তীব্রতার দিক থেকেও এটি অনেক বেশি শক্তিশালী। একজন চিকিৎসকের ভাষ্য অনুযায়ী, এবারে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ রোগীরই অক্সিজেন প্রয়োজন হচ্ছে। চাপ বাড়ছে হাসপাতালে, অর্ধেক রোগীরই লাগছে অক্সিজেন।
সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে দৈনিক সংক্রমণের হার অতীতের সকল রেকর্ড ভেঙ্গে ইতোমধ্যে ৭ হাজার ছাড়িয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সা¤প্রতিক সময়ে জনসাধারণের স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে অবহেলা নিঃসন্দেহে সংক্রমণ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে একটি বড় ভূমিকা রেখেছে। তবে, ঠিক কী কারণে সংক্রমণের হার হঠাৎ আবার বাড়তে শুরু করল তা গবেষণার বিষয়। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধির প্রতি অবহেলা ছাড়াও আরও অনেক বিষয়ের ভূমিকা থাকতে পারে। হতে পারে, মিউটেশনের মাধ্যমে ভাইরাসটি অধিকতর শক্তিশালী কোনো রূপ লাভ করেছে। তাছাড়া, জিনোম সিকোয়েন্সিং-এ দেশে রোগীদের নমুনায় অনেক দ্রুত সংক্রমণে সক্ষম ইউকে ভ্যারিয়েন্ট এবং সাউথ আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্টেরও সন্ধান মিলেছে। এমন মতামতও আছে যে, গরমের সময় একটি বদ্ধ ঘরে যখন এসি বা ফ্যান চালিয়ে অনেক লোক অবস্থান করে, তখন তা করোনা সংক্রমণ ছড়ানোর একটি আদর্শ পরিবেশ হয়ে দাঁড়ায়। (COVID-19 Outbreak Associated with Air Conditioning in Restaurant, Guangzhou, China, 2020 - Volume 26, Number 7—July 2020 - Emerging Infectious Diseases journal - CDC) উদ্বেগের বিষয় হলো, দেশের হাসপাতালসমূহে সাধারণ ও আইসিউ মিলিয়ে করোনা রোগীদের জন্য যতটা শয্যা আছে, তার সবই এখন পুরো মাত্রায় ভর্তি হয়ে গেছে। এমতাবস্থায়, করোনা সংক্রমণ যে হারে বাড়ছে তাতে যদি একটি যতি টানা না যায়, তাহলে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়তে পারে। যদিও ইতোমধ্যে দেশে টিকার একটি চালান এসেছে, ব্যাপকভিত্তিকভাবে দেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক লোককে টিকার আওতায় আনতে যে পরিমাণ টিকা প্রয়োজন তা হাতে পাওয়া এবং এ কর্মসূচির সামগ্রিক বাস্তবায়ন একটি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তা ছাড়া মিউটেশনের মাধ্যমে করোনাভাইরাসের যেসব নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্টের উদ্ভব হচ্ছে, তাদের সকলের বিরুদ্ধে এ যাবৎ উদ্ভাবিত টিকাসমূহ সমভাবে কার্যকর নাও হতে পারে। সুতরাং টিকা দানের মাধ্যমে খুব শিগগির করোনা সংক্রমণের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা যাবে, এ প্রত্যাশা সুদূর পরাহত।
এমতাবস্থায়, সংক্রমণের দ্রুত বিস্তারের রাস টেনে ধরতে সরকার কিছু বিধিনিষেধ সাপেক্ষে এক সপ্তাহের জন্য লকডাউন ঘোষণা করেছে। কিন্তু, এতে তাৎক্ষণিকভাবে দুটো সমস্যা দেখা দিয়েছে। এক, দৈনিক আয়-রোজগারের উপর নির্ভরশীল লোকজন বিপুল সংখ্যায় গ্রাম অভিমুখে ছুটছে। অনেক ক্ষেত্রেই লোকজন স্বাস্থ্যবিধির কোনো তোয়াক্কা না করে ছুটছে এবং এভাবে যাত্রা পথে করোনা সংক্রমণ আরও ছড়িয়ে দিতে ভূমিকা রেখে চলেছে। তাছাড়া, অনেকেই মনে করছেন, এই গ্রামমুখী স্রোত শহরাঞ্চল থেকে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে করোনা ছড়িয়ে দিচ্ছে। দুই, যথার্থ বিকল্প ব্যবস্থা ছাড়াই হঠাৎ করে লকডাউন ঘোষণা করায় যে সব প্রতিষ্ঠান বা শিল্প-কারখানা খোলা থাকছে, সেখানে পৌঁছতে লোকজন ভোগান্তিতে পড়ছে। অনেকে মনে করেন, এ ব্যবস্থাটি মার্চের শুরুতে যখন সংক্রমণ বৃদ্ধির একটি সুস্পষ্ট ট্রেন্ড দেখা যাচ্ছিল তখন নেয়া হলে অনেক বেশি কার্যকর হতো।
এক সপ্তাহের জন্য ঘোষণা করা হলেও, অনেকের ধারণা, এ লকডাউন-এর মেয়াদ আরও বাড়তে পারে। ইতোমধ্যে সর্বাত্মক লকডাউনের ঘোষণাও এসেছে। অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায়, আমাদের দেশের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতায় পূর্ণাঙ্গ লকডাউন আরোপ ও কার্যকর করা বেশ কঠিন। আংশিক লকডাউন কতটুকু ফলদায়ক হতে পারে তা নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ থেকেই যায়। এক্ষেত্রে অফিস-আদালত, কল-কারখানা দৈনিক অনধিক ৫০ শতাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারী দিয়ে একাধিক শিডিউলে রোটেশনের ভিত্তিতে চালু রাখার ফলে ভালো ফল আসতে পারে। এতে একদিকে অফিস, কারখানায় এক সাথে অনেক লোকের উপস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে, অন্যদিকে পরিবহন সমস্যাও লাঘব হবে। ব্যাংকের ন্যায় যেসব আর্থিক বা অন্যবিধ সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে বিপুল সংখ্যক গ্রাহকের সমাগম ঘটে, সেখানে লেনদেনের সময় কমিয়ে দিলে উল্টো লোকজনের ভিড় বেড়ে যায়। এর ফলে করোনা নিয়ন্ত্রণের চেয়ে বরং বিস্তারের পরিবেশ তৈরি হতে পারে।
যেহেতু আমাদের মতো দেশে লকডাউন-এর মতো চরম ব্যবস্থা সফলভাবে প্রয়োগ সহজসাধ্য নয়, তাই আমাদের মাস্ক পরিধান ও সামাজিক দূরত্বের মতো বিষয়গুলো নিশ্চিত করার উপর অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করা উচিত। কেননা, এসব কর্মকৌশলের সাথে লকডাউন-এর মতো ব্যবস্থার ন্যায় কোনো রকম আর্থিক টানা-পড়েনের সংশ্লেষ নাই। অতীতে এক্ষেত্রে আমাদের সীমিত সাফল্যের কারণ আমরা জনগণকে ঠিকমতো উদ্বুদ্ধ করতে পারিনি। এটা কেবল পুলিশি ব্যবস্থার মাধ্যমে সম্ভব নয়। তাছাড়া, পুলিশের জনবলেরও সীমাবদ্ধতা আছে। প্রয়োজনে সীমিত সময়ের জন্য সেনাবাহিনীকেও সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। তবে, মনে হয়, সবচেয়ে ভালো ফল আসতে পারে জনসাধারণকে কার্যকরভাবে সম্পৃক্ত করা গেলে। যদি প্রত্যেক পাড়া-মহল্লায় দল-মত নির্বিশেষে স্থানীয় রাজনৈতিক, সামাজিক কর্মী ও ছাত্র-শিক্ষকদের সমন্বয়ে স্বেচ্ছাসেবক টিম গঠন করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতায় কাজে লাগানো যায়, তাহলে নিশ্চিতভাবেই সাধারণ জনতাকে উদ্বুদ্ধকরণ সম্ভব হবে বলে আশা করা যেতে পারে। এতে যে ফল আসবে, তা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একক তৎপরতায় অর্জন করা সম্ভব নয়।
লেখক: অধ্যাপক, ফার্মেসি বিভাগ, জাবি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন