শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

করোনায় অর্থনীতির সঙ্কট ও উত্তরণের উপায়

মো. মাঈনউদ্দীন | প্রকাশের সময় : ১৩ এপ্রিল, ২০২১, ১২:০৩ এএম

প্রাণঘাতী করোনার উর্ধ্বমুখী সংক্রমণ অব্যাহত রয়েছে। সংক্রমণ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। করোনা তার ধরণ পাল্টিয়েছে। এখন ঠান্ডা-জর ছাড়াও উপসর্গহীন করোনা শনাক্ত হচ্ছে। আক্রান্ত বাড়তে থাকায় হাসপাতালে প্রকট হয়ে উঠেছে আইসিইউ ও সাধারণ শয্যা সংকট। স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যসূত্রে জানা যায়, দেশে করোনা আক্রান্ত রোগীদের জন্য সাধারণ শয্যা রয়েছে মাত্র ৯ হাজার ৭১১ টি। আইসিইউ রয়েছে ৫৮৬টি, যা খুবই অপ্রতুল। আইসিইউর অভাবে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে অনেক রোগী। হাসপাতালে সাধারণ শয্যায় ও স্থান পাচ্ছে না রোগী। অ্যাম্বুলেন্সে মারা যাচ্ছে। গত মাসের শেষ দিক থেকে হঠাৎ বাড়তে থাকে করোনা আক্রান্ত রোগী। আক্রান্ত ও মৃত্যু হার ক্রমে বাড়ছে। হাসপাতালগুলোতে স্থান সংকুলান হচ্ছে না। বেসরকারী হাসপাতালেও আইসিউ মিলছেনা। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রথম দফা সংক্রমণের চেয়ে দ্বিতীয় দফা সংক্রমণ বহুগুণে শক্তিশালী। তবে এই দফা সংক্রমণ কোথায় গিয়ে ঠেকবে, কতদিন থাকবে তা কেউ বলতে পারছে না। দ্বিতীয় দফার এ সংক্রমণকে অবহেলা করলে অনেক বড় ভুল হবে। বিনা চিকিৎসা, বিনা পরিচর্যায় বহু লোক মারা যাবে। এদিকে বাংলাদেশে প্রথম ডোজ টিকা দিলেও সংক্রমণ ঠেকানো যাচ্ছে না। মানুষ টিকা নিলেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিকল্প নেই। সরকার লকডাউন দিলেও ব্যবসায়ী, কর্মজীবী ও শ্রমিকরা জীবনের তাগিদে ঝুঁকি নিয়ে কাজে নেমে পড়ে। তবে টিকাদান ও লকডাউন যা ঘোষনা করা হোক না কেন, সবাইকে কোভিড- ১৯ এর ভয়াবহতা থেকে বাঁচতে হলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে, সামাজিক দুরুত্ব বজায় রাখতে হবে, মাস্ক পড়তে হবে, জনসমাগম এড়িয়ে চলতে হবে।

করোনার এ ভায়াবহ প্রাদুর্ভাবে বিশ্ব অর্থনীতিতে মারাত্মক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপসহ অনেক দেশ জীবন ও অর্থনীতির ভয়াবহ পরিস্থিতি অতিক্রম করছে। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশও করোনায় কম ক্ষতির সম্মুখিন হচ্ছে না, তবে প্রথম দিকে অর্থাৎ গত বছর মানুষের মাঝে ভয়, জীবনের ঝুঁকি ও স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রবনতা দেখা গিয়েছিল। ফলে গত আগষ্টের দিকে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা কমতে দেখা যায়। মানুষ নানা অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে নেমে পড়ে। পাশাপাশি সরকারের প্রণোদনাসহ বিভিন্ন প্যাকেজ ঘোষনার মধ্যদিয়ে জীবন ও অর্থনীতি অনেকটা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। প্রথমদিকে আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতি, কৃষি ও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স অর্থনীতিতে ভাল অবদান রেখেছে। তাতে এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের অর্থনীতির গতি উর্ধ্বমুখী লক্ষ্য করা গেছে। যদিও আমাদের বেকারত্ব, দারিদ্র্যতা, বৈষম্য, দুর্নীতি বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু করোনার দ্বিতীয় ঢেউ যদি আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করে তাহলে ব্যাপক হারে যেমন জীবনহানী ঘটবে তেমনি অর্থনীতির ও অধঃগতি দেখা দিতে পারে। মানুষ জীবনের তাগিদে জীবিকার প্রয়োজেনে ঘরে থাকতে পারছে না। করোনার প্রথম ধাক্কায় বিশেষ করে শহরের ক্ষুদ্রব্যবসায়ী, শ্রমিক, দিনমজুর ও নিম্ন আয়ের মানুষ যে ক্ষতির সম্মুখিন হয়েছিল, তা সামলে উঠার চেষ্টার মাঝে করোনার প্রকোপতা ব্যপক হারে বৃদ্ধি সকলকে নতুন করে চিন্তায় ফেলেছে। বর্তমানে আমদানিকৃত টিকার উপর নির্ভর না করে নিজের দেশে টিকা উৎপাদনের জন্য গবেষণা ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া উচিত। এ ব্যপারে সরকারকেই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সার্বিক পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, এই ভাইরাস সহজে নির্মূল হবে না।বিশে^র সকল মানুষকে টিকার আওতায় আনা আর টিকা দিয়ে ভাইরাস থেকে বাঁচার ব্যবস্থা কম সময়ে সম্ভব নয়। তাই ভাইরাসের প্রদুর্ভাব থেকে মানুষকে বাঁচাতে হলে স্বাস্থ্য বিষেশজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে পাড়ায় পাড়ায়, মহল্লায় মহল্লায় স্বাস্থ্যবিধি মানা, মাস্ক পরাা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা উচিৎ। সকলের মাঝে সচেতনতা আনার জন্য কমিটি গঠন করা ও তার বাস্তবায়ন করা দরকার। করোনা আমাদের জীবনের সাথে মিশে গেছে, এর থেকে বাঁচতে হলে কঠোরভাবে প্রতিরোধ করতে হবে। সরকারকে এ ব্যপারে কঠোর হতে হবে। হাসপাতালগুলোতে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন সরবারহ, বেড সংখ্যা বাড়ানো এবং আইসিউ’র সংখ্যা বাড়ানো সর্বোপরি স্বাস্থ্য বিষয়ক ও আই সিইউর বিভিন্ন সরঞ্জামাদির খরচ কমাতে হবে, ভ্যাট কমাতে হবে।

আমাদের জীবনও বাঁচাতে হবে, জীবিকাও ধরে রাখতে হবে। তাই জীবন বাঁচানোর তাগিদে, খাদ্য ও নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠান, শিল্পকারখান ও কৃষিবিষয়ক অতি প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্বল্প পরিসরে চালু রাখা যেতে পারে। আমাদের অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখতে হবে। অর্থনীতির গতি রুদ্ধ করা যাবে না। চলতি অর্থবছর প্রায় শেষ পর্যায়ে। ২০২১-২২ অর্থ বছরের বাজেট পেশের সময় কাছাকাছি। কয়েকদিন আগে চলমান অর্থবছরে বাজেটের (২০২০-২১) দ্বিতীয় প্রান্তিক (জুলাই-ডিসেম্বর) পর্যন্ত বাস্তবায়ণ অগ্রগতি ও আয়-ব্যয় গতিধারা এবং সামাজিক অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ সংক্রান্ত প্রতিবেদন জাতীয় সংসদে প্রকাশ করা হয়। তাতে দেখা যায়, করোনাকালে অর্থ বছরে দ্বিতীয় প্রান্তিকে বার্ষিক উন্নয়ণ কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ণ কমেছে তিন দশমিক ১ শতাংশ। এসময় বাজেট বাস্তবায়ন বা সরকারের ব্যয় কমেছে ১০ দশমিক ৫৮ শতাংশ। সামনের সময়ে ব্যয় বাড়ানোর জন্য জোরদার পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। দ্বিতীয় প্রান্তিকে রপ্তানি আয় ১৯.২৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার দাঁড়িয়েছে, যা বিগত অর্থবছরের তুলনায় ০.৩৬ শতাংশ কম। আমদানী ৬.৮ শতাংশ কমে হয়েছে ২৫.২৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। মুদ্রস্ফীতি ২০১৯-এ ছিল ৫.৫৯ (ডিসেম্বর-১৯)। তা সামান্য বেড়ে হয় ৫.৬৯ শতাংশ (ডিসেম্বর-২০)। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, আসন্ন বাজেটে দেশীয় শিল্পের উন্নয়নের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হবে। অর্থনীতির গতি ধরে রাখতে হলে টিকার ব্যবহার কার্যকর করা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে উন্নত করার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। অর্থনীতিবিদ ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেয়া উচিত। করোনাকালীন সময়ে যেভাবে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়ছে, বেকারত্ব বাড়ছে, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে, তা সামনে রেখে সরকারকে উন্নয়ণের পদক্ষেপ নিতে হবে। কৃষিকে আধুনিকিকরণ, কৃষি সরঞ্জামাদি ও কৃষি উপকরণের দাম কমানোসহ কৃষকের উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে তাদের কৃষি উৎপাদনে উদ্বুদ্ধ করা উচিত। করোনার এ সময়ে সরকারকে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচীর আওতায় দরিদ্র, হতদরিদ্র ও বেকার শ্রমিকদের মাঝে প্রয়োজনীয় অর্থসহ চাল, ডাল, আলু, তৈল সহ প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবারহ করা উচিত।

অর্থনীতির গতিশীলতা ও উন্নয়নের পিছনে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিরাট অবদান রয়েছে। কিন্তু করোনার দ্বিতীয় ঢেউ-এর ফলে ব্যবসায়ী ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা ব্যাংকের ঋণ পরিশোধে সমস্যায় পড়ছে। ফলে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির আশংকা তীব্র হচ্ছে। ব্যাংকের ঋণ আদায়ের হার হ্রাস পেলে বিনিয়োগের গতি মন্থর হবে, উৎপাদনে বিঘ্ন ঘটাবে, যার প্রভাব জনজীবনে পড়বে। ব্যবসায়ীদের জন্য প্রণোদনা প্যাকেজ বৃদ্ধি ও বরাদ্দ বাড়ানো উচিত এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক ও প্রাতিষ্ঠানিক খাতসহ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তাদের প্রণোদনার প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন