দেশে অস্বাভাবিক হারে করোনা রোগীর সংখ্যা বেড়ে চলছে। এর সাথে মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়ছে। প্রতিদিন রেকর্ড ভাঙছে। শনাক্ত আর মৃত্যুর মিছিল বড় হচ্ছে। কিন্তু প্রতিকার মিলছে না। রোগীরা এক হাসপাতাল থেকে ঘুরে অন্য হাসপাতালে ছুটছে। কোথাও ঠাঁই পাচ্ছে না। ঠাঁই নেই আইসিউতে। মিলছে না সাধারণ শয্যাও। অক্সিজেন সংকটে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। চিকিৎসার অভাবে রাস্তায়, এম্বুলেন্সে কারও কারও মৃত্যু হচ্ছে। টিভির পর্দায় চোখ রাখলেই কিছু মানুষের নীরব হাহাকার আর কান্নার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। গত মার্চের শুরু থেকে হঠাৎ করেই করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়তে থাকে। সরকারের তরফ থেকে সেরকম প্রস্তুতি ছিল কি ছিল না, তা নিয়ে বির্তক দেখা দিয়েছে। কেউ কেউ মনে করছেন, সরকার স্বাধীনতার সুর্বণজয়ন্তী উদর্যাপনে যত গুরুত্ব দিয়েছে তার ছিটেফোটাও যদি করোনা প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতো তাহলে কিছুটা হলেও মানুষের ভোগান্তি কমতো।
মানুষের পাঁচটি মৌলিক অধিকারের মধ্যে চিকিৎসাসেবা অন্যতম। একটু সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্যই মানুষের চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। মানুষ ডাক্তার ও হাসপাতালের শরণাপন্ন হয়। সেবা নিয়ে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেলার পরির্বতে রোগীরা লাশ হয়ে বাড়ি ফিরছে। প্রশ্ন উঠতে পারে, এত সময় পাওয়ার পরও কেন চিকিৎসা অবকাঠামো প্রস্তুত করা হলো না? হাতে যে মূল্যবান সময় ছিল তা কেন অপচয় করা হলো? মার্চের শুরু থেকেই করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের আভাস পাওয়া সত্তে¡ও কেন কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হলো না? এইসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা জরুরি। এক বছরের বেশি সময় ধরে করোনার সঙ্গে আমাদের বসবাস। অথচ, হাসপাতালের আইসিইউ সংকটের সমাধান করা সম্ভব হয়নি। সরকার ইচ্ছে করলে এ সংকট দূর করতে পারতো। কিন্তু কেন তা করা হয়নি, তা বোধগম্য নয়। বাংলাদেশের ২৮টি জেলায় আইসিইউ আছে। ৩৬টি জেলায় নেই। এই সংকট সমাধানের চেষ্টা করা হলে ওইসব জেলার রোগীরা ঢাকায় আসতো না। চিকিৎসা না থাকায় রোগীরা বাঁচার আশায় ঢাকায় আসছে। অথচ, এসেই আইসিইউ তো দূরের কথা। একটি সাধারণ শয্যা পর্যন্ত কারও কারও ভাগ্যে জুটছে না। মার্কিন এক স্বাস্থ্যসেবা সংস্থা আইএইচএমই বাংলাদেশের করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধি নিয়ে গবেষণায় বলেছে, বাংলাদেশে যে হারে করোনা রোগীর সংখ্যা বাড়ছে, তাতে আগামী মে মাসের মাঝামাঝি সংক্রমণ চূড়ায় উঠবে। তখন বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোর শুধু করোনা রোগীর জন্যই সাধারণ শয্যার প্রয়োজন পড়বে ৭৪ হাজার। এর মধ্যে ৭ হাজার আইসিইউ শয্যার প্রয়োজন হবে। ভেন্টিলেটরের দরকার হবে ১৭ হাজারের কাছাকাছি। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে, দেশে সরকারি ও বেসরকারি করোনা হাসপাতালে সাধারণ শয্যা রয়েছে সব মিলিয়ে প্রায় ১০ হাজার। এসব চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে আইসিইউ শয্যা রয়েছে ৬০০। এছাড়া সারাদেশে করোনা রোগীদের অক্সিজেন সিলিন্ডার রয়েছে ১৪ হাজার ৫৯৩ টি, হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা ১ হাজার ২২টি ও অক্সিজেন কনসেনট্রেটর ৮৯৭টি। করোনা পরীক্ষাগার রয়েছে ২২৪টি। আরটিপিসিআর মেশিন রয়েছে ১২০টি (সরকারি ৫২ বেসরকারি ৬৮)। জিন এক্সপার্ট ৩১টি এবং এন্টিজেন টেস্ট ল্যাব রয়েছে ৭৩টি। কিন্তু অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে আক্রান্তদের মধ্যে যাদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়া প্রয়োজন তারাও হাসপাতালে ভর্তির সুযোগ পাচ্ছে না। সংক্রমণ পরিস্থিতি যেভাবে ভয়াবহ রূপে হানা দিচ্ছে তাতে হাসপাতালে ঠাঁই পাওয়া আরো কঠিন হয়ে পড়বে। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোর আইসিইউর মতো সাধারণ শয্যাও এখন সোনার হরিণে পরিণত হয়েছে। কমে আসছে হাসপাতালে ভর্তির সুযোগ। সংক্রমণ এভাবে বাড়তে থাকলে রীতিমতো বিনা চিকিৎসায় মারা যাওয়ার মতো অবস্থা হবে।
করোনা ব্যাপক হওয়ার পর কমে গিয়েছিল। আবার এটা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই পরিস্থিতিতে করোনার টেস্ট এবং চিকিৎসার সুযোগ সরকারি-বেসরকারি সব হাসপাতালে করা প্রয়োজন। অধিকাংশ লোকই জানে না কোথায় কোথায় টেস্ট হয়। কী সরকারি কী বেসরকারি সব হাসপাতালেই এখন টেস্টের ব্যবস্থা করতে হবে। কোনো টাকা পয়সা নেয়া যাবে না। এখন মুনাফা করার সময় না। আগে মানুষ বাঁচাতে হবে। তারপর ব্যবসা করা যাবে। সরকারকে এ ব্যাপারে আদেশ দিতে হবে। জেলা ও বিভাগীয় শহরগুলোর সকল হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজে করোনার চিকিৎসার ব্যবস্থা দ্রুত করতে হবে। যদি জেলা পর্যায়ের রোগীদের সেখানেই চিকিৎসা দেয়া যায় তাহলে ঢাকায় চাপ ও সংক্রমণ কমবে। খুব কম মূল্যে চিকিৎসা দিতে হবে। বিশেষ করে, বেসরকারি হাসপাতালগুলো যদি দরিদ্র মানুষের জন্য ৫০ শতাংশ সিট ছেড়ে দিতে পারে তাহলে জাতির বিশাল খেদমত হবে। প্রত্যেক বেসরকারি হাসপাতালে কিছু দরিদ্র রোগীর জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসার বাধ্যবাধকতা থাকলেও বিনামূল্যে চিকিৎসা পেয়েছেন এমন দৃষ্টান্ত খুবই কম। প্রয়োজনে সরকার বেসরকারি হাসপাতালগুলোর খরচের অর্ধেক বহন করতে পারে। তবে তা করতে হবে খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে।
উন্নত বিশ্বে লাখ লাখ মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। এমনকি মারাও যাচ্ছে। তবু প্রতিটি মানুষ চিকিৎসা সেবা পাচ্ছে। ওইসব দেশের ডাক্তার, নার্সরা জীবন বাজি রেখে রোগীদের বাঁচানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের দেশের অধিকাংশ বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের দোরগোড়া থেকেও মুমূর্ষ রোগীদের নির্দয়ভাবে তাড়িয়ে দেয়ার খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। এই প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সংকটকালে হাসপাতালে যাওয়ার পর কোনো রোগীকে যেন ফিরিয়ে না দেয়া হয় সেটা সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে করোনা উপসর্গ নিয়ে যাওয়া সকল রোগীকে না ফিরিয়ে জরুরি সেবা প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন