আসলাম পারভেজ, হাটহাজারী : আসন্ন পবিত্র কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে হাটহাজারীতে জমে উঠেছে পশুর হাট। তবে গরু-ছাগল বেপারিদের পাশাপাশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছেÑ দা, ছুরি তৈরির কামাররাও। তাদের বর্তমানে নিঃশ্বাস ফেলার সময় নেই। যেখানে-সেখানে পশুর হাট বসানোর ফলে ইজারাকৃত বাজারে উঠছে না গরু-ছাগল। এতে করে ব্যাপক লোকসানের মুখে পড়েছে সরকার ও বাজার ইজারাদাররা। বিজ্ঞআদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও এক শ্রেণীর অর্থলোভী ব্যক্তিরা সড়ক ও রেললাইনের উপর বসানো হয়েছে গরু-ছাগলের বাজার। এছাড়া রোগ আক্রান্ত গরু ছাগলে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যাপারে স্থানীয় প্রশাসন ও প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোন প্রকার তদারকি নেই। প্রতি বছরের ন্যায়ে সারাদেশের মত হাটহাজারীতেও চাঁদাবাজ ও জাল টাকার ছড়াছড়িসহ বিভিন্ন সম্ভাব্য সমস্যাই উদ্বিগ্ন গরু-ছাগল ক্রেতা-বিক্রতারা।
হাটহাজারীতে দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলা থেকে পশু এনে মৌসুমী ব্যবসায়ীরা ইতিমধ্যে গরু-ছাগল এনে লালনপালন করছে। উপজেলার বিভিন্ন স্থানে সড়ক-মহাসড়ক ঘেঁষে বাঁশ তেলপাড় দিয়ে অস্থায়ীভাবে গোয়াল ঘর তৈরি করে পশু সাজিয়ে রেখেছে। উপজেলার বিভিন্ন বাজারের মধ্যে নাজিরহাট বাজার, ফরহাদাবাদ বাজার, কাটিরহাট বাজার, সরকারহাট বাজার, মগ্যাহাট, মহুরী হাট, চারিয়াবুড়ি পুকুর, চারিয়া নয়াহাট, চারিয়া বোর্ড স্কুল, মিরেরহ হাট, হাটহাজারী সদরের রেল স্টেশনের আশপাশ, ইছাপুর বাজার, মদন হাট, মার্দাশা, শিকরপুর, বুড়িশ্চর, মদুনাঘাট, আমান বাজার, ফতেয়াবাদ, চৌধুরী হাটসহ উপজেলার ১৪টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভার বিভিন্ন স্থানে গুরু-ছাগল বিকিকিনি হয়ে থাকলেও দেশের দূর-দূরান্ত থেকে আনা গরুগুলো রোগ আক্রান্ত কিনা তা পরীক্ষার জন্য উপজেলা প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তরের কোন তদারকি না থাকায় ক্রেতা সাধারণের মাঝে হতাশা দেখা দিয়েছে। গত বছরের তুলনায় এ বছর গরু ব্যাপক দাম বেড়েছে বলে জানান ক্রেতারা। গত বছর যে সব গরু ২০/২৫ হাজার টাকায় মিলেছে সে সব গরু বর্তমানে ৫০/৬০ হাজার টাকা বিক্রয় হচ্ছে বলে জানান অনেকে।
এদিকে আজিজুল হক সেলিম নামে এক গরু ক্রেতা চৌধুরী হাট বাজারে গরু কিনতে এসে এই প্রতিবেদককে জানান, যানবাহনের তীব্র যানজট অন্য দিকে অসুস্ত গরু পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য নেই কোন বিশেষজ্ঞ দল অন্য দিকে জাল টাকার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তেমন নজরদারীও নেই। প্রতি বছরের ন্যায়ে এ বছরও কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে মৌসুমী গরু ব্যবসায়ীরা গরু এনে বাড়ির আশপাশে অস্থায়ী ঘর তৈরি করে পশুর লালন-পালন ও বিনা হাসিলে বিক্রয় করছে এতে করে সরকার হারাচ্ছে বিশাল অংকের রাজস্ব। ব্যাপক অর্থের ক্ষতির মুখে পড়ছে বাজার ইজারাদাররা।
এদিকে এই কোরবানির ঈদ সামনে রেখে কামাররাও ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। দা, ছুরি, বটি ও গরু জবাই করার কিরিচ তৈরিসহ সান দেয়ার কাজে ব্যস্ত কামাররা। সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলা ও পৌরসভার অধিকাংশ বাজারে কামারেরা কাজে ব্যস্ত। কাজের ফাঁকে কথা হয় হাটহাজারী বাজারস্থ এক কর্মকারের সাথে। তিনি এই প্রতিবেদককে জানান, পৈতিৃক সূত্রে তাদের এই পেশায় আসা। হাটহাজারী ছাড়াও পার্শ্ববর্তী রাউজান ও ফটিকছড়ি উপজেলা হতে লোকজন এখানে দা ছুরি নিয়ে আসে। কোরবানির ঈদে কাজের চাপ সামাল দিতে চারজন লোক রেখেছেন তিনি। তাদেরকে একমাসের জন্য দিতে হবে জনপ্রতি পাঁচ হাজার টাকা।
এদিকে আরো কয়েকজন কর্মকার জানান, সারা বছর কাজ খুব কম থাকে। কোরবানি এলে কাজের চাপ বেড়ে যায়। ছোট ছুরি থেকে শুরু করে বড় কিরিচ, ধামায় শান দেয়ার জন্য ২০ টাকা থেকে কাজ গুণাগুণের উপর ভিত্তি করে ৮০ টাকা পর্যন্ত নেয়া হয়। তিনি বলেন, অনেক গ্রাহক সঠিক মূল্য দেন না। বর্তমানে কয়লার দামও বেশী। দা, ছুরিতে শান দেয়ার আগে আগুনে পোড়ানের জন্য কয়লা অতি প্রয়োজনীয়। কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে মৌসুমী কামারের দেখা মিলছে প্রচুর। অনেকে নতুন দা, ছুরি তৈরীর কাজ নেয়া বন্ধ করে দিয়েছে।
পবিত্র ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে হাটহাজারী উপজেলার বিভিন্ন স্থানে ভেজাল মসলা সিন্ডিকেট সক্রিয় হয়ে উঠেছে। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ও মিল মালিক গুঁড়ো মসলায় ভেজাল মিশিয়ে বাজারজাত করছে বলে জানা গেছে। এসব মশলার বেশিরভাগই বিএসটিআইএর অনুমোদন নেই বলেও জানা যায়। তবে প্যাকেটের উপরে সিল-ছাপ দেখে বোঝার উপায় নেই এগুলো আসল, নাকি ভেজাল। আবার অনেকে প্যাকেটের গায়ে ভুয়া বিএসটিআইএর সিল ব্যবহার করে বাজারজাত করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কোনো তদারকি এখনও পর্যন্ত চোখে পড়েনি। হাটহাজারী উপজেলার বাজারগুলোতে ঘুরে জানা গেছে, ভেজাল গুঁড়ো মসলার রমরমা ব্যবসা। নামে-বেনামে বাজারজাতকৃত গুঁড়ো মশলার প্যকেটে উৎপাদন, মেয়াদ উত্তীর্ণ তারিখ, ব্যাচ নং ও সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য কিছুই লেখা নেই। প্যাকেটের গায়ে শুধু হাটহাজারী ও চট্টগ্রাম ঠিকানা লেখা আছে। এসব গুঁড়ো মসলার প্যাকেটের গায়ে ১০০ ভাগ গ্যারান্টিযুক্ত নির্ভেজাল কথাটি লেখা রয়েছে। এ ধরনের অসংখ্য নামের গুঁড়ো মসলায় সয়লাব হয়েছে হাটহাজারী বাজার ও উপজেলা প্রত্যন্ত অঞ্চলের বাজারগুলো। সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রামে দেড় শতাধিক মিল বাণিজ্যিকভাবে গুঁড়ো মসলা তৈরি করে। এর মধ্যে মাত্র ৩৫টি প্রতিষ্ঠানের বিএসটিআইয়ের অনুমোদন রয়েছে। বাকিগুলো অনুমোদনহীনভাবেই মসলা তৈরি করে বিক্রি করছে। খাতুনগঞ্জের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান গুঁড়ো মসলা তৈরিতে বিএসটিআইয়ের অনুমোদন নিলেও বাকি ১২-১৫টি প্রতিষ্ঠানের কোনো অনুমোদন নেই। কোরবানির ঈদ উপলক্ষে এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রচুর ভেজাল মসলা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে।
এদিকে সংশ্লিষ্ট স্থানীয় প্রশাসনের কোনো তদারকি না থাকায় মরিচ, হলুদ ও মসলা মাড়াইকারী মিলের মালিকরাও ভেজাল গুঁড়ো মসলা তৈরি করে বিক্রি করছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাটহাজারী বাজারের রঙ্গিপাড়া সড়কের এক মিল শ্রমিক মরিচ, হলুদ ও মশলা ভেজাল করার কথা স্বীকার করে এ প্রতিবেদককে বলেন, গাছের গুঁড়ি ও ধানের কুঁড়ার সঙ্গে রঙ মিশিয়ে তৈরি ভেজাল ধনিয়া প্রতি কেজি পাইকারিতে বিক্রি হয় ১৪০-১৬০ টাকায়। অন্যদিকে ৫০ কেজি গাছের গুঁড়ি বা কুঁড়া, নিম্নমানের ১০ কেজি শুকনো মরিচ, ৫ আউন্স কমলা রঙ, ১ আউন্স লাল রঙ মিশিয়ে মিলিং শেষে পাওয়া যায় ৫৫ কেজি মরিচের গুঁড়ো। মিলিং খরচসহ কেজি প্রতি দাম পড়ে ৪০-৪৫ টাকা। ভেজাল এ মরিচের গুঁড়ো পাইকারী পর্যায়ে ৬০-৭৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে ব্যবসায়ীদের কাছে। একইভাবে ৫০ কেজি ভূষি বা ধানের কুঁড়ার সঙ্গে ৫ কেজি আস্ত হলুদ, ৫ আউন্স কমলা রঙ মিশিয়ে মিলিং করে পাওয়া যায় ৫০ কেজি গুঁড়ো হলুদ। এ হলুদ প্রতি কেজি ৪২-৪৮ টাকা খরচ হলেও বিক্রি হচ্ছে ৭৫-৮০ টাকায়। হাটহাজারী বাজার ও উপজেলার বিভিন্ন এলাকার গুদামে এসব গুঁড়ো মসলা মজুদ রাখা হলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো অভিযান পরিচালনা করা হয়নি বলে অভিযোগ ভুক্তভোগিদের। এ সুযোগে কোরবানির ঈদ সামনে রেখে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর এসব ভেজাল গুঁড়ো মসলা সারা দেশে ছড়িয়ে দিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। হাটহাজারী বাজারের একাধিক ব্যবসায়ী জানান, এসব গুঁড়ো মসলা অবাধে বাজারে বিক্রি করলেও প্রশাসনের কোনো নজরদারি নেই। এ ছাড়া এদের অনেকের ঠিকানাও ভুয়া বলে জানা গেছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন