শরীরের উপর করোনা ভাইরাসের স্বল্প মেয়াদী এবং দীর্ঘ মেয়াদী প্রতিক্রিয়া রয়েছে। কিছু মানুষের ক্ষেত্রে করোনা ভাইরাস সংক্রমন শুরু হয় মূলত ফ্লু এর লক্ষণগুলোর মাধ্যমে। কিন্তু করোনা ভাইরাস আপনার ফুসফুস, লিভার, কিডনি এমনকি ব্রেনে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করতে পারে।
কিভাবে ছড়ায়?-
সাধারণত করোনা ভাইরাস আপনার শরীরে প্রবেশ করতে পারে যখন আপনার নিকটবর্তী কোনো সংক্রমিত ব্যক্তি বাতাসে ড্রপলেট ছড়ায়- কাশি, হাঁচি এবং কথা বলার সময়। এটি সহজেই বিস্তার লাভ করে ছয় ফুট দূরত্বের মধ্যে। এ কারণে সংক্রমণ কমাতে কমপক্ষে ছয় ফুট দূরত্ব বজায় রাখতে বলা হয়েছে। একজন সংক্রমিত ব্যক্তি ড্রপলেট বা ক্ষুদ্র পানি কনা বাতাসে ছড়াতে পারে, এমনকি নিজে অসুস্থবোধ না করলেও। অনেক সময় সংক্রমিত ব্যক্তির কোনো লক্ষণ থাকে না। কিন্তু তিনি সহজেই ড্রপলেট ছড়ানোর মাধ্যমে সমাজে ব্যাপক মানুষের মাঝে করোনা ভাইরাসের বিস্তার ঘটাতে পারেন। ভাইরাস আবার আপনাকে সংক্রমিত করতে পারে যখন আপনি দরজার হাতল, লক স্পর্শ করেন যার উপর ভাইরাস রয়েছে। কিন্তু এটির সম্ভবনা অনেক কম। আমাদের দেশে করোনা ভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ চলছে। ধারণা করা হচ্ছে বর্তমানে করোনা ভাইরাসের যুক্তরাজ্য ও দক্ষিণ আফ্রিকা ভেরিয়েন্ট ব্যাপক সংক্রমন ঘটাচ্ছে। কয়েক দিন আগেও আমরা কেউ বুঝতেই পারিনি যে পরিস্থিতি এমন ভয়াবহ রূপ নিবে। কারণ একজন আক্রান্ত ব্যক্তি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক থাকতে পারে। কিন্তু ড্রপলেট এমনকি কথাবার্তা বলার মাধ্যমেও তিনি সমাজের বিভিন্ন স্থানে সংক্রমণ ঘটাতে পারেন।
উপরের শ্বাসনালীর সংক্রমন ঃ
যখন করোনা ভাইরাস আপনার শরীরে প্রবেশ করে তখন এটি সাধারণত নাক, সাইনাস ক্যাভিটি এবং গলার কোষগুলোর মধ্যে অবস্থান করে। অধিকাংশ মানুষের ক্ষেত্রে সেখানে ভাইরাসটি অবস্থান করে সেখান থেকে লক্ষন শুরু হয়। কিন্তু আপনি দুই সপ্তাহ পর্যন্ত কিছুই অনুভব নাও করতে পারেন। যতক্ষন ভাইরাসটি স্বাস্থবান কোষকে আক্রমন করে এবং বংশ বৃদ্ধি শুরু করে। আর তাই আপনি অন্যদের সংক্রমিত করতে পারেন এমনকি আপনার কোনো লক্ষন না থাকলেও।
সচরাচর পরিলক্ষিত অন্যান্য লক্ষন সমূহ ঃ
প্রথম লক্ষন দেখা যায় জ্বর, মাথা ব্যথা, সোর থ্রোট বা গলায় ক্ষত, শুষ্ক কফ। কিন্তু প্রাথমিক অবস্থায় যা অনুভব করবেন সেটির তারতম্য হতে পারে। আপনার আরও যে সব লক্ষন হতে পারে সেগুলো হলো ঃ (ক) সর্টনেস অব ব্রেথ বা ছোট ছোট শ্বাস নেওয়া। (খ) ঠান্ডা, জ্বর এবং শরীর ব্যথা, (গ) অনুভুতি, গন্ধ এবং স্বাদ না পাওয়া। (ঘ) দূর্বলতা (ঙ) সর্দি (চ) বমি বমি ভাব এবং ডায়রিয়া।
নীচের শ্বাসনালীর সংক্রমন ঃ
যদি আপনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কোভিড-১৯ ভাইরাসকে দমন করতে না পারে বা বশীভূত করতে না পারে তাহলেই ভাইরাসটি আপনার ফুসফুসে যেতে পারে। সেখানে ভাইরাসটি ফুসফুসের কোষ এবং আবরণকে আক্রমণ করে। পানি এবং মিউকাস জমা হয় যার কারণে রক্তে অক্সিজেন সরবরাহ কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। শ্বাস নিতে খুব কষ্ট হয়। এটিকে ভাইরাল নিউমোনিয়া বলা হয়। অধিকাংশ মানুষ এক সপ্তাহ বা দুই সপ্তাহের মধ্যে ভাল হয়ে যায়। কিন্তু কারও কারও আরো অধিক সময় লাগতে পারে।
এ.আর.ডি. এস ঃ
একিউট রেসপিরেটরি ডিসট্রেস সিনড্রোমে কোভিড-১৯ নিউমোনিয়া খুব দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে। অক্সিজেন লেভেল খুব দ্রুত কমে যেতে থাকে। এ ধরণের অবস্থায় শ্বাস নিতে ভেন্টিলেটরের প্রয়োজন হতে পারে। এক্স-রে এবং সিটি স্ক্যান করলে দেখা যাবে ফুসফুসের বিশাল অংশ একদম অক্সিজেন পাচ্ছে না। রক্তে অক্সিজেন লেভেল বিপদজনকভাবে কমে যায়।
রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ঃ
অনেক ডাক্তার ভাবেন অনেক বেশি ইমমিউন রেসপন্সের কারণে কোভিড-১৯ এর ক্ষেত্রে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়ে থাকে। ক্যামিক্যাল সিগনালিং এজেন্ট যা সাইটোকাইন নামে পরিচিত তার লেভেল এত বেশী থাকে যে, ইমমিউন সেল স্বাস্থ্যবান কোষকেও আক্রমন শুরু করে। ডাক্তাররা একে সাইটোকাইন স্টর্ম বলে থাকেন। এর ফলে রক্তচাপ কমে যেতে পারে। অরগান ফেইলিউর এবং রক্তনালী ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে থাকে। অনেক সময় দেখা যায় সাইটোকাইন স্টর্ম এর কারনে লিভার বা কিডনি ফেইলিউর হয়ে রোগী মারা যায়।
হার্টের সমস্যা ঃ
কোভিড-১৯ এর কারণে মায়োকার্ডাইটিস, এরিথমিয়া, কার্ডিওমায়োপ্যাথি, একিউট কার্ডিয়াক ইনজুরি, এমনকি রোগী শকে চলে যেতে পারে। রোগী কেবল তখনই শকে চলে যাবেন যখন হার্ট শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় রক্ত পাম্প করতে পারবে না। এক্ষেত্রে করোনারী আর্টারি ডিজিজ এর রোগীদের সচেতন থাকতে হবে।
রক্তনালীতে সমস্যা ঃ
কোভিড-১৯ রক্তনালীর কোষকে আক্রমন করতে পারে। হার্টের সমস্যা ছাড়া কোভিড-১৯ রক্ত জমাট বাঁধাতে পারে যার কারণে স্ট্রোক অথবা পালমোনারী এম্বোলিজম বা ফুসফুসে রক্ত জমাটবদ্ধতা হতে পারে। করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গুরুতর অসুস্থ হলে তাদের রক্তে ডি ডাইমার নামক বস্তুর উপস্থিতি বাড়তে থাকে। এটি বেশি রক্ত জমাট বাঁধার নির্দেশক।
ব্রেন রিলেটেড সমস্যা ঃ
কোভিড-১৯ স্নায়ুতন্ত্রে সমস্যা সৃষ্টি করে থাকে এমনকি খিচুনিসহ। এটি হতে পারে ব্রেনে ফোলা ভাবের কারণে অথবা কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের প্রদাহের কারণে। অন্যান্য যে সব লক্ষন আপনার স্নায়ুতন্ত্রের সাথে সম্পৃক্ত যা কোভিড-১৯ এর ক্ষেত্রে দেখা যেতে পারে সেগুলো হলো- (ক) জ্ঞান হারিয়ে ফেলা (খ) গন্ধ না পাওয়া (গ) স্ট্রোক।
লিভারের সমস্যা ঃ
কোভিড-১৯ রোগীদের মধ্যে যারা হাসপাতালে ভর্তি হন তাদের অর্ধেকের রক্তে এনজাইম লেভেল বেশী থাকে যা লিভার ধ্বংসের নির্দেশক। এই লিভার ডেমেজের বিষয়টি ভাইরাস নিজে নাও করতে পারে। ওষুধ সেবন বা অতিরিক্ত কার্যকর রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাও এ ধরণের অবস্থার সৃষ্টি করে থাকে।
চোখের সমস্যা ঃ
করোনা ভাইরাস সংক্রমণ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের তিন ভাগের এক ভাগের চোখের সমস্যা কনজাংটিভাইটিস দেখা যায়। এটি হয় যখন একটি ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া অথবা কোনো এলার্জেন যখন সেই টিস্যুর মাঝে প্রদাহ সৃষ্টি করে যা আমাদের চোখ এবং চোখের পাতার ভিতরের অংশ আবৃত করে রাখে।
কিডনি ড্যামেজ ঃ
করোনা ভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে অনেক অসুস্থ হয়ে পড়লে এ ধরণের ঘটনা ঘটতে পারে। ওষুধ সেবন, রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা কাজ না করলে, ব্লাড প্রেসার কমে গেলে এবং ভাইরাস আক্রান্ত হওয়ার পূর্বের রোগীর সার্বিক অবস্থা সবকিছু মিলেই কিডনি ড্যামেজ হতে পারে।
কোনো লক্ষন নেই? ঃ
কিছু পর্যবেক্ষণে দেখা যায় কোভিড-১৯ রোগীদের শতকরা ৪০ ভাগের কোনো লক্ষন থাকে না। আবার কখনো এ হার অনেক বেশী থাকে। এ ধরণের রোগীরা কোনো অসুস্থতা বোধ করেন না। কিন্তু তারপরেও ভাইরাস আপনার শরীরের ক্ষতি করতে পারে। যাদের কোনো লক্ষণ থাকে না তাদের এক্স-রে বা সিটি স্ক্যানে ফুসফুসের ক্ষতি বা ড্যামেজ দেখা যায় গ্রাউন্ড গ্লাস অপাসিটি সহ। এটি কোভিড-১৯ রোগীদের ফুসফুসের ক্ষতি।
এ কারণেই করোনা ভাইরাসের সংক্রমন কমাতে হলে সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে, মাস্ক পড়ে সুরক্ষা নিতে হবে। মনে রাখতে হবে করোনা ভাইরাসের আক্রমণ থেকে কেউ রেহাই পাবে না, যদি না সবাই এতে অংশগ্রহন না করে। অতিরিক্ত গণজমায়েত পরিহার করুণ এবং অবশ্যই মাস্ক পরিধান করে আপনার জরুরি কাজে বের হউন।
ডাঃ মোঃ ফারুক হোসেন
মুখ ও দন্তরোগ বিশেষজ্ঞ
মোবাইল ঃ ০১৮১৭৫২১৮৯৭
ই-মেইল ঃ dr.faruqu@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন