ভয়াবহ এক দুরবস্থার সম্মুখীন এখন সমগ্র দুনিয়া। করোনা ভাইরাসের মারাত্মক ছোবলে ইতোমধ্যে মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছে লক্ষ লক্ষ বনি আদম। আক্রান্ত হয়েছে আরও বহু বহুগুণ বেশি। প্রথম ঢেউয়ের পর চলছে দ্বিতীয় ঢেউ। অপেক্ষা করছে তৃতীয় ঢেউ। এরপর আরও কত ঢেউ অপেক্ষা করছে তা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনই জানেন। হাসপাতালে ঠাঁই নেই। বহু জায়গায়ই অক্সিজেনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই, আইসিইউতে সিট নেই। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের অবস্থা অত্যন্ত ভয়াবহ। মৃত্যুর ও শনাক্তের নতুন রেকর্ড হচ্ছে প্রতিদিন। অপরদিকে এ মহামারির ধরন পাল্টাচ্ছে প্রতিদিন প্রতিক্ষণে। প্রয়োজনমত প্রতিষেধক টিকা প্রাপ্তিতেও রয়েছে প্রতিবন্ধকতা, জটিলতা। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের জন্য লোক চলাচলের উপর লকডাউন ইত্যাদি নানা বিধি-নিষেধ আরোপ করা হলেও তা কার্যকর করা যাচ্ছে না। আয় উপার্জন ছাড়া মানুষ চলবে কীভাবে, বাঁচবে কী উপায়ে? বাধা-নিষেধ আরোপ করা না হলে সংক্রমণ ছড়িয়ে যায় ব্যাপকভাবে। আবার কঠোর থেকে কঠোরতর বিধি-নিষেধ কার্যকর করতে গেলে সৃষ্টি হয় যারা দিন আনে দিন খায় এমন জনগোষ্ঠির মরণদশা। উভয় সংকট। সরকার সাধ্যমত চেষ্টা করে যাচ্ছে বটে। কিন্তু তা কতটা আর সম্ভব। প্রতিটি কর্মস্থলে ছাঁটাই হচ্ছে প্রতিদিন। বাড়ছে কর্মহীন বেকার লোকের সংখ্যা। ক্ষুধা আর বেকারের মিছিলটা যেন দিন দিন শুধু বেড়ে যাচ্ছে। মানবতার এই চরম দুর্দিনে যাদের শক্তি আছে, সামর্থ্য আছে তাদের এগিয়ে আসতে হবে। মনুষত্বের আজ এক মহাপরীক্ষা চলছে। এ পরীক্ষায় পিছপা হলে চলবে না। যার যতটুকু সম্বল আছে তাই নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। ওই সব চাকরিচ্যুত বেকার দুর্দশাগ্রস্থ, অসহায়, নিরন্ন, ক্ষুধার্ত, বুভুক্ষুলোকদের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। আর এটাতো পবিত্র মাহে রমজান, যার অপর এক নাম ‘শাহরুল মাওয়াসাত’। সহানুভূতির মাস, সহমর্মিতার মাস, সমবেদনার মাস। এ মাসে দান-সদকার সওয়াব অন্যান্য মাসের তুলনায় অনেক বেশি। আর সত্যিকার মুসলমানের অন্যতম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে নিজের প্রয়োজনের তুলনায় অন্যের প্রয়োজনকে বড় করে দেখা। এ ব্যাপারে কুরআন-হাদীসে রয়েছে অসংখ্য বাণী। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, সাহাবায়ে কেরাম, আউলিয়ায়ে কেরাম ও বিভিন্ন যুগের ওলী-আউলিয়াদের জীবনের ভুরি ভুরি উদাহরণ রয়েছে। মনে রাখতে হবে, আমরা মুসলমান। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন আমাদের জীবনের চরম ও পরম লক্ষ্য। আর আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের অন্যতম সেরা উপায় হল, বিপদে-আপদে, দুঃখ-মুসিবতে আল্লাহর বান্দাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ানো। তাদের প্রতি সহানুভূতি, সহমর্মিতা প্রকাশ করা। তাদের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করা। নিরন্নকে অন্ন দান করা। সার্বিকভাবে সেবা-যত্ন করে তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা।
অবহেলা করে সৃষ্টিকে কেউ পায়নিক ¯্রষ্টায়
তাঁর নূর হাসে তোমারি সমুখে সৃষ্টির আঙিনায়।
বুভুক্ষ যবে যঠর জ্বালায় শুকনো মুখের হাসি
স্রষ্টা তখন বেদনা-কাতর বিষণ্ণ উপবাসী।
তৃষ্ণা কাতর পায় না যখন তেষ্টা মেটাতে বারী
সেই তৃষ্ণার জ্বালা গিয়ে বাঁধে বুকে খোদ বিধাতারি।
নিপীড়িত যত মজলুমানের বুকফাটা হাহাকার
কাঁপাইয়া তোলে মহিমান্বিত মসনদ আল্লার।
রুগ্ন, পীড়িত, আর্ত আতুর, অনাথে সেবিল যেবা
স্বয়ং আল্লা’ বিশ্বপতির- সে জন করিল সেবা।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহপাক বলেন: ‘তাদের ধন-সম্পদে রয়েছে অভাবগ্রস্ত ও বঞ্চিতদের হক বা অধিকার।’ (৫১:১৯)।
মহান আল্লাহ কুরআনপাকে অন্যত্র বলেন: ‘আমি তোমাদেরকে যে রিজিক দিয়েছি তোমরা তা হতে দান করবে মৃত্যু আসার পূর্বেই। অন্যথায় মৃত্যু এসে গেলে বলবে, হে আমার প্রতিপালক। (মৃত্যুটা একটু বিলম্বিত কর) আর কিছুটা সময় দান করলে আমি দান-সদকা করতাম। এবং সৎ কর্মপরায়নদের অন্তর্ভুক্ত হতাম। কিন্তু যখন কারও মৃত্যুর নির্ধারিত কাল উপস্থিত হবে তখন আল্লাহ তাকে কিছুতেই আর অবকাশ দেবেন না। তোমরা যা কর আল্লাহ সে সম্পর্কে সবিশেষ অবহিত আছেন।’ (৬৩:১০,১১) অপর এক আয়াতে আল্লাহপাক বলেন: ‘তোমরা যা ভালবাস তা হতে ব্যয় না করা পর্যন্ত কখনো পুণ্য লাভ করবে না।’ বেহেশতী লোকদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা প্রসঙ্গে আল্লাহপাক বলেন: ‘আহার্যের প্রতি আসক্তি থাকা সত্তে¡ও তারা অভাবগ্রস্ত, ইয়াতিম ও বন্দীকে আহার্য দান করে।’ (৭৬:৮) অর্থাৎ তারা শুধু নিজেদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত বস্তুই দরিদ্রদেরকে দান করে না; বরং নিজেদের প্রয়োজন থাকা সত্তে¡ও দান করে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন: হে আদম সন্তান তুমি দান করতে থাক আমিও তোমাকে দান করব।’ (বুখারী) আল্লাহর ওয়াস্তে দান করলে তাতে ধন-সম্পদ হ্রাস পায় না, বরং তার বহুগুণ তাকে ফেরত দেন। আল্লাহপাক এ সম্পর্কে বলেন: ‘এমন কোন ব্যক্তি আছে কি যে আল্লাহতালাকে (আল্লাহর বান্দাকে) লাভজনক কর্জ দান করবে অতঃপর আল্লাহপাক তাকে বহুগুণ বর্ধিত করে পরিশোধ করবেন?’ হাদীস শরীফে আছে, আল্লাহপাক যখন এ আয়াত নাযিল করেন যে, কেউ একটি নেকী করলে আল্লাহপাক দশগুণ সওয়াব দেবেন: তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দোয়া করলেন ‘হে আল্লাহ, আপনি আমার উম্মতকে আরও সওয়াব বাড়িয়ে দিন তখন নিন্মোক্ত আয়াত নাজিল করে আল্লাহ জানিয়ে দেন, আমি বর্ধিত করে দেব। প্রিয় নবী স. তখন আরজ করলেন, হে আমার প্রতিপালক আপনি আরও বাড়িয়ে দিন। তখন মহান রব্বুল আলামীন এ আয়াত নাজিল করলেন : যারা নিজেদের ধন-সম্পদ আল্লাহর পথে ব্যয় করে তাদের উপমা হচ্ছে এমন একটি শস্যবীজের মতো, যা সাতটি শীষ উৎপাদন করে, আর প্রতিটি শীষে উৎপাদিত হয় এক শত শস্যদানা। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বহুগুণে বাড়িয়ে দেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময় সর্বজ্ঞ।’ (২:২৬১) আল্লাহপাক অন্যত্র বলেন: ‘পূর্ব ও পশ্চিমদিকে তোমাদের মুখ ফেরানোতে কোন পুণ্য নেই; তবে পুণ্য আছে কেউ আল্লাহ, পরকাল, ফেরেশতাগণ, কিতাবসমূহ এবং নবীগণের প্রতি ঈমান আনলে এবং আল্লাহর প্রেমে আত্মীয়-স্বজন, পিতৃহীন ইয়াতীম, অভাবগ্রস্থ, পর্যটক, সাহায্যপ্রার্থীগণকে এবং দাস মুক্তির জন্য অর্থ দান করলে।’ (২:১৭৭) আল্লাহপাক অন্যত্র বলেন: ‘আপনি আমার ঐ সকল খাঁটি বান্দাদের বলে দিন, যারা ঈমান এনেছে তারা যেন নামাজ কায়েম করে এবং আমার দেয়া রিজিক থেকে প্রকাশ্যে ও গোপনে এমন দিন আসার পূর্বে যেন দান করে যে দিন কোন প্রকার কেনা-কাটা ও বন্ধুত্ব কাজে আসবে না।’
আমরা কবির ভাষায় উদাত্ত আহবান জানাচ্ছি:
হাত বাড়িয়ে দাও ভাইরে হাত বাড়িয়ে দাও
মুমূর্ষু ওই বুভুক্ষুদের মুখের পানে চাও।।
ভূখা, অনাথ, মুমূর্ষুদের দাও দু’মঠো ভাত
কী যাতনায় কাটছে ওদের প্রতিটি দিনরাত
দানের হস্ত খুলে ওদের পার্শ্বেতে দাঁড়াও।
আমাদের জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম আহবান জানিয়েছেন
দে জাকাত, দে জাকাত, তোরা দে রে জাকাত
তোর দিল খুলবে পরে- ওরে আগে খুলুক হাত।।
দেখ্ পাক কোরআন, শোন্ নবীজীর ফরমান
ভোগের তরে আসেনি দুনিয়ায় মুসলমান
(তোর) একার তরে দেননি খোদা দৌলতের খেলাত।।
স্মরণ রাখতে হবে, আমরা সেই নবীর উম্মত, যিনি ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ দানবীর। যার কাছে কেউ কিছু চেয়ে জীবনেও ফেরত যায়নি। তাঁর জীবনচরিতে পাওয়া যায়, মক্কা বিজয়ের পর মুসলমানদের তখন সুদিন। বিভিন্ন গোত্রের লোকেরা এসে ইসলাম গ্রহণ করছে। মালে গণীমত আসছে দিকদিগন্ত থেকে। মসজিদে নববী বোঝাই হয়ে গেল মালে। নবীজী ফজরের নামাজের পর দান করতে থাকলেন। এশার নামাজ পর্যন্ত দান করে গেলেন অকাতরে। শেষ কড়িটি পর্যন্ত বিলিয়ে দিয়ে রিক্ত হস্তে ফিরে গেলেন ঘরে। দেখলেন ঘরে একমুষ্টি খাবারও নেই। চুলা জ্বলেনি সারা দিনে। তিনি অনাহারে রাত কাটিয়ে দিলেন। পরদিন প্রাতে আবার গণীমতের মালে মসজিদে নববী বোঝাই হয়ে গেল। নবীজী পূর্ববত দান করতে থাকলেন। শেষ কড়িটি পর্যন্ত বিলিয়ে দিয়ে রিক্ত হস্তে বাড়ি ফিরে জানলেন আজও চুলো জ্বলেনি ঘরে। অনাহারে রাত কাটিয়ে দিলেন। এল তৃতীয় দিন। এলো অঢেল মাল। বিলিয়ে গেলেন নবীজী এশা অবধি। ঘরে ফিরে শুনলেন খ্যাদ্যাভাবে আজও চুলা জ্বলেনি তার ঘরে। অনাহারেই রাত কাটিয়ে দিলেন আগের দু’দিনের মতো।
একদা একজন অভাবগ্রস্থ লোক এসে নবীজীর কাছে কিছু যাচ্ঞা করল। তিনি তাঁর সকল সহধর্মিনীর ঘরে খবর নিয়ে জানলেন কারো ঘরে কোন খাবার নেই। মসজিদে নববীতে যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের কাছে এই অভুক্ত লোকটির রাতের খাবারের দায়িত্ব কে নিতে পারে জানতে চাইলেন। সাহাবী তালহা রা. দায়িত্ব নিয়ে মেহমানকে ঘরে নিয়ে গেলেন। ঘরে ছিল সামান্য মাত্র খাবার। তিনি স্ত্রীকে বললেন, বাচ্চাদের কথায় কথায় ঘুম পাড়িয়ে দাও তারপর খাবারটুকু নিয়ে এসো মেহমানের সামনে। কৌশলে বাতিটি নিভিয়ে দিয়ে আমরা মেহমানকে নিয়ে খেতে বসব। মেহমান যেন বুঝতে না পারে যে খাদ্য কম। আমরা তার পাশে বসে খাবার অভিনয় করে যাব। বাতি না থাকায় সে বুঝতে পারবে না প্রকৃত অবস্থা। সেভাবে মিয়া-বিবি অভিনয় করে মেহমানকে তৃপ্তি সহকারে ভোজন করিয়ে সন্তানদের নিয়ে অভুক্ত থেকে রাত কাটিয়ে দিলেন। যখন হযরত তালহা মসজিদে নববীতে ফজরের নামাজ পড়তে গেলেন, তখন নবীজী তাকে সুসংবাদ শুনালেন, আল্লাহপাক তাদের এ কাজে অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়েছেন। এবং তাদের প্রশংসায় সূরা হাশরের ‘তারা তাদের প্রয়োজনকে সর্বদাই নিজেদের প্রয়োজনের ওপর অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে’ এ আয়াত নাজিল করেছেন।
ইতিহাসের পাতার মুসলমানদের বদান্যতার হাজারো কাহিনী সোনালি আখরে লিখিত রয়েছে। তারমধ্যে থেকে মাত্র দু’একটি উল্লেখ করে আমরা এ নিবন্ধের ইতি টানব। তার মধ্যে নবীনন্দিনী হযরত ফাতিমা রা. ও হযরত আলীর একটি ঘটনা উল্লেখ করছি। হযরত ইবনে আব্বাস রা. বর্ণনা করেছেন: হযরত হাসান ও হুসাইন একদা ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তখন হযরত আলী রা. ও মা ফাতিমা তাদের আরোগ্যের জন্য তিনটি করে রোজা পালনের মানত করেন। আল্লাহপাকের মেহেরবানীতে তাঁরা আরোগ্য লাভ করলে, ফাতিমা ও আলী রা. রোজা পালন আরম্ভ করেন। কিন্তু তাঁদের ঘরে ছিল না সেহরী ও ইফতার করার মতো কোনো খাদ্যসামগ্রী। তখন হযরত আলী রা. শামউন নামক এক ইয়াহুদীর নিকট থেকে নির্দিষ্ট পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কিছু পশম নিয়ে এল সুতা বানিয়ে দেয়ার জন্য। পারিশ্রমিক নির্ধারিত হলো তিন ছা যব। হযরত ফাতিমা প্রথম দিন এক তৃতীয়াংশ পশমের সুতা কাটলেন এবং সে বাবদ প্রাপ্ত যব দিয়ে ৫টি রুটি তৈরি করলেন ২টি হাসান-হুসাইনের জন্য, ২টি নিজেদের জন্য ও ১টি তাঁদের বাঁদীর জন্য। সন্ধ্যাবেলা হযরত আলী ইফতার করতে বসলেন, রুটি ছিড়ে মুখে দিতে যাবেন এমন সময় এক ফকীর এসে কিছু খেতে চাইলে আলী ও ফাতিমা রা. তাদের রুটি ফকিরকে দান করে দিলেন। দ্বিতীয় রোজাটি পালন করে যখন ইফতার করতে গেলেন তখন এলেন আর এক ফকির। স্বামী-স্ত্রী আহার না করে ঐ রুটিও দিয়ে দিলেন ফকিরকে। পশমের দ্বিতীয় ভাগ দিয়ে পারিশ্রমিক যে যব পাওয়া গেল তা দিয়ে মা ফাতেমা পূর্বের মতো ৫টি রুটি তৈরি করলেন। তৃতীয় দিন ইফতার করবেন এমন সময় আবারও হাজির হলেন এক ফকির। নবী নন্দিনী মা ফাতিমা ও জামাতা শেরে খোদা হযরত আলী রা. তাদের আহার্য রুটি দান করে দিলেন যাচ্ঞাকারী ফকিরকে।
এ প্রসঙ্গে ইতিহাস খ্যাত আলেমে দ্বীন ও মহান ওলী আল্লাহ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মুবারকের একটি কাহিনী বর্ণনা করা যেতে পারে। তিনি তখন ইরাকের বাসিন্দা। প্রায় বছরই তিনি কাফেলায় শরীক হয়ে নফল ওমরা করতেন। আলোচ্য বছরও তিনি এক কাফেলায় শরীক হয়ে মক্কা শরীফের পথ ধরলেন। এ দীর্ঘ সফর কালে কাফেলার লোকেরা তাদের সামান-আসবাবের অপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ফেলে দিতেন। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক রহ. একদা দেখতে পেলেন, তাদের আহারের জন্য যে মোরগ আনা হয়েছে তার মধ্যে থেকে মরা মোরগ নিক্ষেপ করা হচ্ছে তিনি আরও দেখলেন একটি লোকালয়ের নিকট দিয়ে কাফেলা পথ অতিক্রম করা কালে যে মোরগ নিক্ষেপ করা হয়েছে একটি মেয়ে এসে সেখান থেকে সেই মরা মোরগ কুড়িয়ে নিয়ে ঘরের দিকে ছুটছে। তার কৌতূহল হলো এবং রহস্য উদঘাটনের জন্য মেয়েটির পেছনে পেছনে গিয়ে তাদের বাড়িতে উপস্থিত হলেন। ঘরের দরওয়াজার কড়া নাড়তেই ভেতর থেকে আওয়াজ এলো কে? হযরত ইবনে মুবারক নিজ পরিচয় দিয়ে বললেন, আপনাদের মেয়েটি যে মোরগটি নিয়ে এসেছে সেটিতো মরা মোরগ। আর মরা মোরগ ভক্ষণ করা হারাম। গৃহকর্তী বললেন, এ ঘরের মালিক ইন্তেকাল করেছেন। ঘরে এককণা খাদ্যশস্য নেই। আমরা বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে তিন দিন পর্যন্ত অনাহারি। তাই জীবন রক্ষার্থে মরা মোরগ সংগ্রহ করেছি। এটি আপনার জন্য খাওয়া হারাম। কিন্তু নিরূপায় অবস্থায় জান বাঁচানোর জন্য আমাদের খাওয়া জায়েজ। এই হৃদয় বিদারক কথা শুনে আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক কাফেলায় ফিরে এলেন এবং কাফেলার লোকদের জানিয়ে দিলেন, তিনি এ বছর আর হজ্বে যাবেন না। তার যে টাকা-পয়সা ও মালামাল ছিল তা আলাদা করে নিজেরটা নিয়ে ঐ অসহায় দরিদ্রগৃহে পৌঁছে সমুদয় অর্থ তাদেরকে দান করে দিয়ে নিজ আবাসস্থানে ফিরে গেলেন।
ওদিকে কাফেলার অন্যান্য লোকেরা মক্কায় হজ্জের কার্যাবলী সমাধা করে রাসূলে পাক স. এর রওজা জিয়ারতের জন্য মদীনায় এলেন। জেয়ারত সমাপ্ত করলেন এবং রাতে ঘুমিয়ে গেলেন। তাদের মধ্যে একজনের স্বপনের মধ্যে নবীজী স. এর জিয়ারত নসিব হলো। স্বপনের মধ্যে তিনি আরজ করলেন, আমার হজ্জ কবুল হয়েছে কিনা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জওয়াব দিলেন না, এবার একজন হাজিরও হজ্জ কবুল হয়নি। তবে হ্যাঁ, মাত্র একজন লোকের হজ্জ কবুল হয়েছে এবং তার উসিলায় আরাফাহ ময়দানে উপস্থিত সকল হাজীর হজ্জ আল্লাহপাক কবুল করেছেন। লোকটি জানতে চাইলেন, কে সেই মহান ব্যক্তি, কে সে সৌভাগ্যবান, যার হজ্জ আল্লাহ কবুল করে নিয়েছেন এবং তার উসিলায় অন্য হাজিদেরও হজ্জ কবুল করে নিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ স. বললেন, তার নাম আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক- তাঁর পরিচয় এই এই। জওয়াব শুনে লোকটি খুশিতে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল। সেতো আমার পরিচিত, আমার শহরেরই লোক। কিন্তু তিনিতো এ বছর হজ্জ করেননি। পথিমধ্যে যাত্রা ভঙ্গ করে তাঁর সমস্ত মাল-সামান ও টাকা-পয়সা এক অসহায় পরিবারকে দান করে দিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তাঁর এই দানকে আল্লাহপাক এতোই পছন্দ করেছেন যে, মক্কা, আরাফা, মিনা, মুজদালিফা না গিয়েও তিনি মকবুল হজ্জের পূর্ণ সওয়াবতো পেয়েছেনই। তার উসিলায় এবারকার সকল হাজির হজ্জই কবুল করে নিয়েছেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : সমগ্র সৃষ্টি আল্লাহর পরিবার ভুক্ত। আল্লাহর নিকট প্রিয় ঐ ব্যক্তি যে আল্লাহর পরিবারের অপরাপর সৃষ্টির প্রতি অনুগ্রহশীল। আল্লাহপাক আরও বলেন: ‘উত্তম কাজের জন্য উত্তম পুরস্কার ব্যতীত কী হতে পারে?’ (৫৫:৬০)
আসুন, আমরা আল্লাহপাকের ডাকে সাড়া দিয়ে নেকের প্রতিযোগিতায় আত্মনিয়োগ করি। নিরন্ন, বুভূক্ষ, ক্ষুধার্ত, মুমূর্ষু অসহায় লোকদের পাশে গিয়ে দাঁড়াই।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন