সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

মহান মে দিবস

| প্রকাশের সময় : ১ মে, ২০২১, ১২:০৩ এএম

আজ মহান মে দিবস। ১৮৮৬ সালের মে মাসের প্রথম সপ্তাহে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলনকারীদের উপর পুলিশের গুলিবর্ষণ ও রক্তাক্ত ঘটনার স্মৃতিবিজড়িত মে দিবসের ডাক এখনো সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। প্রায় দেড়শ’ বছর ধরে বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষ তাদের ন্যায্য অধিকার ও জীবনমানের উন্নয়ন ও নিরাপত্তার দাবিতে আন্দোলন করে এলেও পুঁজি বিকাশের তুলনায় শ্রমিক শ্রেণির অবস্থার তেমন পরিবর্তন ঘটেনি। প্রতিবছর বিশ্বে ঘটা করে মে দিবস পালিত হলেও করোনার দীর্ঘমেয়াদী সংক্রমণের কারণে বিশ্বজুড়ে ভিন্ন এক প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে। বিশ্বের সব মানুষ জীবনের নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক ঝুঁকিতে থাকলেও সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে পড়েছে শ্রমজীবী মানুষ। ফলে মে দিবস এবার এক ভিন্ন আঙ্গিকে পালিত হচ্ছে। লকডাউনের মধ্যে বাংলাদেশে মে দিবস ঘটা করে পালনের সুযোগ নেই। একদিকে কোটি কোটি মানুষের কর্মহীন হয়ে পড়া, অন্যদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষের দিশেহারা অবস্থা। দু’বেলা দু’মুঠো খাওয়াই এখন তাদের জন্য মুশকিল হয়ে পড়েছে। বেকারত্ব ও দারিদ্র্যের কষাঘাতে তাদের এখন ত্রাহি অবস্থা। হু হু করে বাড়ছে দারিদ্র্যের হার। বিভিন্ন পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ইতোমধ্যে নতুনভাবে দুই কোটিরও বেশি মানুষ দরিদ্র হয়ে গেছে। হতদরিদ্রের সংখ্যাও সমানুপাতে বাড়ছে।

বিগত এক বছরে করোনার প্রভাবে দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে। শিল্পোৎপাদন এবং আমদানি-রফতানি আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। প্রবৃদ্ধি পাঁচ শতাংশের নিচে নেমেছে। গত বছর করোনার ধাক্কা সামলিয়ে মানুষ কর্মজীবনে ফেরার চেষ্টায় যখন উদগ্রীব এবং কলকারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙ্গা হতে শুরু করে তখনই নতুন করে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ যেন সব লন্ডভন্ড করে দিয়েছে। সরকার চেষ্টা করছে লাখ লাখ দরিদ্র পরিবার ও কর্মহীন মানুষকে সহায়তা করতে। গার্মেন্ট, কৃষিসহ বিভিন্ন খাতে প্রণোদনা দিয়ে উজ্জীবীত রাখতে। তারপরও করোনার ভয়াল থাবার কাছে সবকিছুই যেন ন্যুব্জ হয়ে পড়ছে। বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের প্রধান দুই খাত গার্মেন্ট ও জনশক্তিতে করোনার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। সরকার চেষ্টা করছে একই সঙ্গে অর্থনীতি সচল রাখা এবং করোনা নিয়ন্ত্রণে সীমিত পরিসরে লকডাউন দিয়ে দুই কূল রক্ষা করতে। বাস্তবতা হচ্ছে, করোনা পুরো বিশ্বের অর্থনীতিতেই আঘাত করেছে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। শত শত গার্মেন্ট কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়া, হাজার হাজার শ্রমিক বেকার হওয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানে লোকবল কমিয়ে কিংবা বেতন কমিয়ে কৃচ্ছসাধনের পথ অবলম্বন করছে। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি কর্মজীবী অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত। এ খাতে লাখ লাখ ক্ষুদ্র থেকে মাঝারি ধরনের উদ্যোক্তা যেমন রয়েছে, তেমনি লাখ লাখ শ্রমজীবী মানুষও রয়েছে। এই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের মানুষগুলো সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছে। কাজ হারিয়ে এবং কাজ না পেয়ে তারা বেকার বসে আছে। দু’বেলা খাওয়ার মতো অবস্থায় তারা নেই। খেটে খাওয়া এসব মানুষের পাশে দাঁড়ানোর মতো যেন কেউ নেই। আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো সবচেয়ে বেশি কষ্টে দিনাতিপাত করছে। তারা না পারছে হাত পাততে, না পারছে সংসার চালাতে। এদের সহায়তা করার মতো উদ্যোগও পরিলক্ষিত হচ্ছে না। বাধ্য হয়ে অনেক পরিবার রাজধানী ছেড়ে গ্রামে চলে গেছে। সেখানে গিয়েও যে তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে, তার নিশ্চয়তা নেই। গত বছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে ৫০ লাখ পরিবারকে নগদ আড়াই হাজার টাকা করে প্রণোদনা দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন, সেসব পরিবারের কয়েক লাখ এখনও এ অর্থ পায়নি। এ নিয়ে দুর্নীতিরও অভিযোগ উঠেছে। এছাড়া গার্মেন্ট ও কৃষি খাতে যে প্রণোদনা দেয়া হয়, এ ক্ষেত্রে দক্ষতা ও সক্ষমতার অভাবে অর্থ ছাড় যথাযথভাবে করা যায়নি। এতে প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছা ব্যাহত হয়েছে। এবারও সরকার ৩৫ লাখ পরিবারকে নগদ অর্থ দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এ সংখ্যা আরও বাড়ানো উচিৎ। গত বছর করোনাকালে আমাদের মূল অর্থনৈতিক খুঁটি হয়ে ছিল কৃষিখাত। কৃষকদের অক্লান্ত পরিশ্রমে ফসলের বাম্পার ফলন খাদ্য সংস্থানের রক্ষাকবচ হয়ে দাঁড়ায়। দেখা যাচ্ছে, এক বছরের মাথায় দেশে খাদ্যসংকট তীব্র হয়ে উঠেছে। বিগত ১৩ বছরের মধ্যে সরকারি গুদামে খাদ্যের মজুদ তলানিতে এসে ঠেকেছে। যেখানে খাদ্যসংকট কাটাতে গুদামে ন্যূনতম ১৫ লাখ টন খাদ্য মজুদ থাকার কথা, সেখানে ৩ লাখে নেমেছে। এ পরিস্থিতিতে সরকারকে বিভিন্ন দেশ থেকে লাখ লাখ টন চাল আমদানি করতে হচ্ছে। এবারের বোরো মৌসুমে সরকার ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্র নির্ধারণ করেছে। সাধারণত এই লক্ষ্যমাত্রা কখনোই পূরণ হয় না। মিলার ও মধ্যসত্ত¡ভোগীদের কারসাজির ফলে কৃষক ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয়। এদিকে সরকারের দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। তা নাহলে, খাদ্য সংকট প্রকট হয়ে উঠার আশঙ্কা রয়েছে। নিত্যপণ্যের বাজার অনিয়ন্ত্রিত হয়ে রয়েছে। জিনিসপত্রের দাম মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের কঠোর পদক্ষেপ নেয়া জরুরি।

এবারের মহান মে দিবসের প্রধানতম ব্রত হওয়া উচিৎ অসহায় খেটে খাওয়া শ্রমিক-মজুর এবং নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের আর্থিক সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করা। করোনা যেমন নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, তেমনি সাধারণ মানুষকে খাদ্য ও অর্থ প্রদান করে সহায়তা করতে হবে। সরকার তার অবস্থান থেকে প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের সহায়তায় চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে সরকারের একার পক্ষে এ সহায়তা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে বিত্তবানদের এগিয়ে আসতে হবে। সামনে ঈদ। এই ঈদকে কেন্দ্র করে ধনিক শ্রেণীর উচিৎ যথাসম্ভব যাকাত, ফিতরা, অনুদান দিয়ে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো। ইসলামিক বিধানে এটা তাদের আবশ্যিক দায়িত্ব ও কর্তব্য। আমরা দেখেছি, এই করোনাকালে অনেক শিল্পপতি, ধনী ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করেছেন। তারা তাদের ধন-সম্পদ সঙ্গে নিয়ে যেতে পারেননি। এ উপলব্ধি থেকে বিত্তবানদের উচিৎ বিপদগ্রস্ত মানুষের সহায়তায় এগিয়ে আসা। গার্মেন্টসহ বিভিন্ন শিল্প কারখানা এবং কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিৎ কর্মরত শ্রমিক ও কর্মকর্তাদের বেতন ভাতা যথাসময়ে পরিশোধ করা। সরকারকে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে জড়িত লাখ লাখ উদ্যোক্তা ও শ্রমিকের মধ্যে নগদ অর্থ বিতরণ করে তাদের হাতে অর্থের যোগান দিতে হবে। তাতে তারা যেমন কিছুটা স্বস্তি পাবে তেমনি অর্থ প্রবাহও বাড়বে, যা অর্থনীতিতে কাজে আসবে। পরিশেষে মহান মে দিবসে আমরা সকল মেহনতী ও অসহায় হয়ে পড়া মানুষের প্রতি সমবেদনা ও সহমর্মীতা জ্ঞাপন করছি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন