এনায়েত আলী বিশ্বাস : আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষা-দীক্ষায় উদ্বুদ্ধ অনুসন্ধিৎসা নিয়ে এদেশের মুসলমানেরা আজ পর্যন্ত তাদের অতীত ঐতিহাসিক উপাদান সংগ্রহে ও এর অধ্যয়নে পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রবৃত্ত না হলেও কেউ কেউ এ ব্যাপারে এগিয়ে এসেছেন। এদের মধ্যে মরহুম আব্দুল করিম সাহিত্যবিশারদ অন্যতম। তাঁর ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় মুসলিম বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে এ যাবত যে সমস্ত অমূল্য উপাদান সংগৃহীত হয়েছে তা থেকে দেখা যায়, বাংলায় মোগল আমলে বহু মুসলিম কবির আবির্ভাব ঘটেছে। এক্ষেত্রে অধ্যাপক আলী আহমেদের ‘বাংলা কলমী পুথির বিবরণ’ ও অধ্যাপক যোতীন্দ্র মোহন ভট্টাচার্যের ‘বাংলার বৈষ্ণব ভাবাপন্ন মুসলমান কবি’ শীর্ষ গ্রন্থটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মোগল আমলে মুসলিম পৃষ্ঠপোষকতায় বহু মুসলিম কবি-সাহিত্যিক সাহিত্য চর্চায় অগ্রসর হয়েছিলেন তাতে সন্দেহ নেই। তবে মোগল আমলে কবি-সাহিত্যিকদের সময় নির্ণয়ের ক্ষেত্রে চট্টগ্রামের অষ্টাদশ শতাব্দির কবি মুকিমের নাম উল্লেখ করতে হয়। তিনি ১৭০০ থেকে ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। তাঁর ‘ফায়েদুল মুকতদী’ গ্রন্থটি কবির শেষ রচনা। এটির রচনাকাল ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দ ১৭৬০ থেকে ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দ মধ্যে। তাঁর ‘গোলে বকাওলী’ কাব্যে কবি চট্টগ্রামের অতীত ও বর্তমান কবিদের একটা নামের তালিকা দিয়েছেন। কবির তালিকানুযায়ী সয়্যিদ সুলতান (১৫৫০-১৬৪৮) মুসলিম বাংলার মধ্যযুগীয় কবিদের মধ্যে প্রাচীন ও প্রসিদ্ধ। তাঁর প্রথম কাব্য ‘শব-ই মেরাজ’ গ্রন্থের রচনাকাল ১৫৮৬ খ্রিস্টাব্দ এই সময় কবির বয়স ৩৫/৩৬ বছর ধরা হলে তিনি ১৫৫০ খ্রিস্টাব্দ কাছাকাছি সময় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। কবি মুহাম্মদ খান কবি সয়্যিদ সুলতানের শিষ্য ছিলেন। মুহাম্মদ খান গুরুর আদেশে ‘কিয়ামৎ নামা’ রচনা করেন। এর রচনাকাল ১৫৬৭ শতাব্দে বা ১৬৪৬ খ্রিস্টাব্দ। ‘সত্য-কলি-বিবাদ’ রচনাকালে মুহাম্মদ খানের বয়স ছিল ৩৫ বছর। সে হিসেবে তাঁর জন্ম ১৬০০ খ্রিস্টাব্দ। সে সময় সয়্যিদ সুলতানের বয়স ছিল ৫০ বছর অর্থাৎ ১৬৪৬ খ্রিস্টাব্দের পর কবি সয়্যিদ সুলতান আর অধিককাল বাঁচেননি। কেন না, সয়্যিদ সুলতানের ‘ওফাৎ-রসূল)’ কাব্যের পরিকল্পনায় ৪ আসহাবের ও কারবালার ঘটনার বর্ণনার কথা পাওয়া সত্তে¡ও তিনি নিশ্চয়ই বার্ধক্য বশতঃ তা লিখে যেতে না পেরে তাঁর কবি শিষ্য মুহাম্মদ খানকে এই দুই বিষয়ে লিখতে আদেশ দিয়েছিলেন। কবি মুহাম্মদ খান তাঁর ‘মকতুল হুসেন’ কাব্যে হানিফার পত্র পাঠ খÐে ‘এজিদের উত্তর’ নামক অংশে মুজাফর নামক এক কবির রচনাবলে উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি সয়্যিদ সুলতানের দৌহিত্র বলে জানা যায়। কবি সয়্যিদ সুলতান কতগুলো পুস্তক রচনা করেছিলেন তা সঠিকভাবে জানা যায় না। তবে তাঁর যেগুলো গান ও পুস্তকের পরিচয় পাওয়া গেছে। তাঁর মধ্যে নবী বংশ, শব-ই মেরাজ, রসূল বিজয়, ওফাৎই রসূল, জয়কুম রাজার লড়াই, ইবলিস নামা, জ্ঞান চৌতিশা, জ্ঞান প্রদীপ, মারফতী গান ও পদাবলী। এসব রচনার মূল বৈশিষ্ট হলো বাংলা ভাষায় ধর্মের কথা প্রচার করা। কিন্তু গোঁড়া মুসলমানরা কবিকে মুনাফিক বলে আখ্যা দিলেন। কিন্তু কবি তাতে দমেননি। খ্রিস্টিয় ষোড়শ শতাব্দির শেষ ও সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে বাংলাভাষায় ইসলাম ধর্মের কথা লিপিবদ্ধ করা দূষণীয় ও পাপ কাজ বলে গোঁড়া মুসলমানরা মনে করতেন। কবি আজীবন এই গোঁড়ামীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে গেছেন।
শেখ পরান : আনুমানিক (১৫৫০-১৬১৫)। তার সম্বন্ধে তেমন কোন আলোচনা হয়নি। এ যাবত তার দু’খানা গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া গেছে। একটির নাম ‘নূর নামা’ অপরটির নাম ‘নসীহৎ নামা’। পুস্তকদু’খানার রচনাকাল পাওয়া যায়নি। তিনি অপর এক কবি শেখ মুত্তলিবের পিতা ছিলেন। কবি মুত্তলিবের ‘কিফায়িতুল মুসল্লিন’ রচনার তারিখ জানা যায় ১৬৩৯ খ্রিস্টাব্দ। এ সময় কবির বয়স ছিল ৩৯ বছর। তাহলে তাঁর জন্ম ১৬০০ খ্রিস্টাব্দ। এ থেকে বোঝা যায়, শেখ পরান কবি সয়্যিদ সুলতানের সমসাময়িক ছিলেন। তিনি ‘নূর নামা’ গ্রন্থে, সয়্যিদ সুলতানের নাম ও ‘নবী বংশে’র উল্লেখ করেছেন। শেখ পরান যে, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডু গ্রামের অধিবাসী ছিলেন তা তাঁর পুত্র শেখ মুত্তলিবের সাক্ষ্য হতে জানা যায়। সয়্যিদ সুলতান ও পরানের সমসাময়িক এমনকি কিঞ্চিত পূর্ববর্তী কবি হাজী মুহম্মদ শেখ পরান তাঁর নসীহৎ নামার বর্ণনানুযায়ী হাজী মুহম্মদ পূর্ববর্তী লোক। পূর্ববর্তী না হলেও সমসাময়িক। তাঁর গ্রন্থ ‘নূর জামাল’ ও ‘সরৎ নামা’। নসরুল্লাহ খাঁ (১৫৬০-১৬২৫)। কবির চারখানা গ্রন্থের খবর পাওয়া গেছে এরমধ্যে ‘জঙ্গ নামা, মুসার সোয়াল, শরীয়াত নামা ও হেদায়েতুল ইসলাম’।
সপ্তদশ শতাব্দীর মুসলমান কবিদের মধ্যে নানা কারণে সয়্যিদ মরতুজা বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন। তাঁর পিতার নাম সয়্যিদ হাসান। তাঁর পিতা উত্তর প্রদেশের বেরেলি জেলার অধিবাসী ছিলেন। তাঁর পিতা বেরিলি থেকে মুর্শিদবাদে এসে বাস করতে থাকেন। এই জেলার জঙ্গিপুরের নিকটবর্তী বালিয়াঘাটা নামক পল্লীতে সয়্যিদ মরতুজার জন্ম হয়(১৫৯০-১৬৬২)। সয়্যিদ মরতুজা একজন খ্যাতনামা দরবেশ ছিলেন। তিনি সঙ্গিত ও আনন্দোল্লাসে বিভোর থাকতেন। লাহোরের মুফতি খুলাম হুসেন সরওয়ারের ‘খজিনাতুল আসফিয়া’ নামক গ্রন্থে লিখিত আছে, শাহ সয়্যিদ মরতুজা রাজ মহলে বাস করতেন। নানা কিরামৎ বা অলৌকিক ক্রিয়ার অধিকারী ছিলেন। এবং তৌহীদ সম্বন্ধনীয় গান গেয়ে বেড়াতেন। হায়াত মাহমুদ মোগল আমলের শেষ এবং শক্তিশালী কবি। রংপুর জেলার ঘোড়াঘাট সরকারের সুলুঙগার বাগদান পরগনার ঝাড়বিশালা গ্রামে কবির জন্ম হয়। এই ঝাড়বিশালা গ্রাম রংপুর জেলার পীরগঞ্জ থানার অন্তর্গত। তাঁর পিতার নাম শাহ কবির। তিনি ও একজন কবি এবং ঘোড়াঘাট সরকারের দেওয়ান ছিলেন। এ পর্যন্ত তাঁর চারখানা পুস্তকের সন্ধান পাওয়া গেছে। ‘জঙ্গ নামা বা মহরম পর্ব (১৭২৩), চিত্ত উত্থান বা সর্বভেদ(১৭৩২), হিত জ্ঞান-বাণী(১৭৫৩), আম্বিয়া বাণী(১৭৫৮)’।
মোগল আমলে মোগল সা¤্রাজ্যের বাইরে অবস্থিত দু’টি স্বাধীন প্রত্যন্ত-প্রাদেশিক রাজ্যে ও মুসলিম বাংলা সাহিত্যের বিশেষ চর্চা হয়। এদু’টি রাজ্যের নাম রোসাঙ্গ ও ত্রিপুরা। রাজ্য দু’টি মোগল আমলের শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতা বজায় রাখলেও মোগল যুগে সাংস্কৃতিক প্রভাবে ভরপুর ছিল। এই দুই রাজ্যে এখনকার মত বাংলা ভাষাভাষী মুসলমানের সংখ্যা ছিল অনেক। কতকটা যুগ ধর্মের প্রভাবে এবং কতকটা বাংলাভাষী মুসলমানের সংখ্যার দিক থেকে রাজ্য দু’টিতে ফারসি ও বাংলা ভাষার প্রভাব বদ্ধমূল হয়ে যায়। এই দুই রাজ্যের মুসলিম বাংলা সাহিত্য চর্চা এতই ব্যাপক ও মূল্যবান যে, মোগল আমলের মুসলিম বাংলা সাহিত্য সম্বন্ধে আলোচনা করতে গেলে রোসাঙ্গ ও ত্রিপুরার কথা কিছুতেই বাদ দেওয়া যায় না। মুঘলেরা বাংলাদেশে বাংলা সাহিত্য চর্চার জন্য সরাসরি যা করেননি রোসাঙ্গ ও ত্রিপুরার রাজগণ তা করেছিলেন। আধুনিক আরাকানের প্রাচীন নাম রোসাং বা রোসাঙ্গ। আরাকানিরা একে রখইং অংগীবা রাক্ষস ভ‚মি নামে অবিহিত করে থাকে। মোগল আমলে আরাকান রাজ্যের সীমা নির্ণয় কঠিন। সময় সময় হাত বদলালেও সমগ্র চট্টগ্রামের অধিকাংশ স্থান, বিশেষ করে কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ তীরবর্তী ভ‚ভাগ, মোগল যুগের শেষদিক পর্যন্ত রোসাংগ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। সমগ্র চট্টগ্রামে এখনও যে মঘী সন প্রচলিত তা তেকে প্রমাণ করে দেয় চট্টগ্রামে আরাকানি প্রভাব গত গভীর। এখনও আরাকানের মুসলমানেরা বাংলা ও বর্মী এই দুই ভাষায় সমান পারদর্শী। আরাকান রাজ সভার বাংলা সাহিত্য নামক পুস্তকে দেখা যায়, ৭৮৮-৭১০ খ্রিস্টাব্দ মহৎ চন্দ্র যখন রাজত্ব করতেন তখন থেকে রোসাঙ্গে আরবের বণিক সম্প্রদায় বসবাস করে আসছিল। এদের দ্বারা খ্রিস্টাব্দ অষ্টম ও নবম শতাব্দীতে ইসলাম প্রচারিত হতে থাকে। খ্রিস্টাব্দ পঞ্চদশ শতাব্দীর গোড়া থেকেই রোসাঙ্গ রাজগণ মুসলিম প্রভাবকে সানন্দে বরণ করে নিতে বাধ্য হন। ১৪৩০ খ্রিস্টাব্দ রোসাঙ্গ গৌড়ের করদ রাজ্য রূপে আপন অস্তিত্ব বজায় রাখে। এ সময় গৌড়ের মুসলমানরা মুরং শহরে বসতি স্থাপন করে। তারা যে বাংলা ভাষাভাষী ছিলেন এতে কোন সন্দেহ নেই। আরোও দেখা যায়, ১৩৩৪-১৬৪৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দুশো বছরের অধিককাল যাবত স্বাধীন রোসাঙ্গ রাজগণ তাদের মুদ্রায় কালিমাশাহ, সিকান্দারশাহ, সলীমশাহ, হুসেনশাহ প্রমুখ মুসলিম উপাধি স্বীয় আরাকানি নামে ব্যবহার করেছিলেন। এ দুশ’ বছর ধরে বঙ্গের মুসলমান-পাঠান মুসলিম রাজ শক্তির সাথে স্বাধীন আরাকান রাজগণের মোটেই সদ্ভাব ছিল না। অথচ তারা দেশে মুসলিম রীতি ও আচার মেনে আসছিলেন। এ থেকে মনে হয়, আরাকানি মঘ সভ্যতা রাষ্ট্র-নীতি ও আচার ব্যবহার হতে মুসলিম সভ্যতা, রাজনীতি ও আচার ব্যবহার অনেকাংশে শ্রেষ্ঠ ও উন্নত ছিল বলে আরাকানির রাজগণ বঙ্গের মুসলিম প্রভাব হতে মুক্ত হতে পারেননি। তাদের প্রধানমন্ত্রী, মহাপাত্র, মুখ্যপাত্র, পাত্র, সমর সচীব, কাজী প্রভৃতি সমস্ত উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। রাজা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হলেও বৌদ্ধ ভিক্ষুদের দ্বারা অভিষেক ক্রিয়া সম্পন্ন হত না। রাষ্ট্রীয় বিষয় বলেই বোধ হয় তাদের অভিষেক ক্রিয়া মুসলিম প্রধানমন্ত্রী দ্বারাই সুসম্পন্ন হত। আরাকান রাজ শ্রী চন্দ্র সুধর্মার (১৬৫২-১৬৮৪) অভিষেক নবরাজ উপাধিক প্রধানমন্ত্রী মজলিস কর্তৃক সম্পন্ন হয়। এ সম্পর্কে কবি আলাওলের ‘সিকান্দার নামা’ কাব্যে তার বিবরণ দিয়েছেন। এ থেকে দেখা যায়, আরাকানের রাজ সভা সপ্তদশ শতাব্দির শেষ পর্যন্ত মুসলিম প্রভাবে ভরপুর ছিল। এই প্রভাব ধর্মীয় হোক বা না হোক সাংস্কৃতিক প্রভাব তো বটেই। খ্রিস্টাব্দ সপ্তদশ শতাব্দীতে এই প্রভাব চরমে ওঠে। আরাকানের যে মুসলিম প্রভাব বিস্তৃতি লাভ করে তা প্রধানত বঙ্গীয় মুসলিম প্রভাব। এর ফলে বঙ্গের বাইরে স্বাধীন আরাকানে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এর মূলে আরাকানি অপকর্ষ এবং বাংলা ভাষার উৎকর্ষ কার্যকর হয়ে ওঠে। অধিকন্তু, আরাকানের বাংলাভাষী সভাসদগণের পৃষ্ঠ পোষকতায় পরিপুষ্ট না হলে এবং তথাকার বিদ্বজ্জনের উৎসাহ লাভ না করে এই প্রতিষ্ঠা সম্ভব পর হত না।
রোসাঙ্গ রাজের যেসব মুসলমান সভাসদ বাংলা ভাষা সাহিত্য চর্চায় স্বজাতীয় কবিকে নিয়োজিত করে মাতৃভাষার শ্রীবৃদ্ধি আনায়ন করেছিলেন তাদের মধ্যে একজন শ্রী সুধর্ম রাজার সমর সচিব আশরাফ খান (১৬২২-১৬৩৮)। এ সময় আরো একজন মুসলিম কবির নাম পাওয়া যায়, তার নাম মরদন। তার কাব্যের নাম ‘নসীরা নামা’। শ্রী সুধর্ম রাজার পরে (১৬৩৮-১৬৪৫) রাজা হলেন নৃপগিরি। এই সাত বছর আরাকানে রাষ্ট্রবিপ্লব ও গৃহ বিবাদ চলতে থাকে। ফলে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত ভ‚ভাগ আরাকান রাজের হস্তচ্যুত হয়। দেশের এই অরাজকতা ও অশান্তির সময় সাহিত্যচর্চা অব্যাহত ছিল বলে মনে হয় না। কিন্তু পরবর্তী সাদ উমাদারের রাজত্বকালে (১৬৪৫-১৬৫২) তার মুখপাত্র প্রধানমন্ত্রী মাগন ঠাকুরের সহযোগিতায় মহাকবি আলাওল তার অমর কাব্য ‘পদ্মাবতী’ রচনা করেছিলেন। মাগন ঠাকুর নিজেও একজন কবি ছিলেন। তিনি কোরেশ বংশ সম্ভৃত মুসলমান ছিলেন। তার ‘চন্দ্রাবতী’ নামে একখানা কাব্য পাওয়া গেছে। সাদ উমাদারের মৃত্যুর পর তৎপুত্র চন্দ্রসুধর্ম (১৬৫২-১৬৮৪) রোসাঙ্গের রাজা হলেন। মাগন ঠাকুরের মৃত্যুর পর সোলেমান নামক ওপর একজন মুসলমান চন্দ্র সুধর্মের প্রধানমন্ত্রী হলেন। এ সময় সয়্যিদ মুহাম্মদ চন্দ্র সুধর্মের সমর সচিব ছিলেন। মহাকবি আলাওল তারই আদেশে ‘সপ্তপয়কর’ কাব্য রচনা করেন। এ সময় মজলিস নামক অপর এক ব্যক্তি চন্দ্র সুধর্মের রাজ সভার নবরাজ মজলিস নামে পরিচিত ছিলেন। আলাওল তার আদেশেই সিকান্দার নামার পদ্যানুবাদ করেন। চন্দ্র সুধর্মের আরেক মন্ত্রী সয়্যিদ মুসার আদেশে ‘সয়ফুল মূলক’ রচনা করেছিলেন। এভাবে আরাকানে যে সাহিত্য চর্চা শুরু হয় আলাওলের মৃত্যুর পরও তা বিলুপ্ত হয়নি। আলাওলের অধ্যাত্ম উত্তরাধিকারীদের মধ্যে আব্দুল করিম খন্দকার ১৭০৫ খ্রিস্টাব্দ ‘দুল্লা মজলিস’ নামে একখানা বিরাট কাব্য রচনা করেন।
মোগল আমলে আরাকানের ন্যয় ত্রিপুরা চাকমা অধ্যুষিত রাজ্য হলেও মুসলিম সভ্যতা ও সাংস্কৃতিক প্রভাব হতে এ রাজ্য মুক্ত ছিল না। রাজ দরবার, শাসন, পোশাক-পরিচ্ছদ প্রভৃতি ব্যাপারে ত্রিপুরার উপরে মুসলিম প্রভাব গভীর রেখাপাত করে। অধিকন্তু, বাংলা ভাষার প্রাধান্য এই রাজ্যে চিরকালই স্বীকৃত হয়েছে। এই রাজ্যের মুদ্রা ও দলিল পত্রে বাংলা ভাষার প্রাচীন নিদর্শন দেখা যায়। শৈখ চান্দ (১৫৬০-১৬২৫) অন্যতম। তিনি একাধারে সাধক ও শক্তিশালী কবি ছিলেন। তাঁর গ্রন্থের মধ্যে ‘রসূল বিজয়’ বৃহৎ কাব্য। এ কাব্য কবির পীর শাহদৌলার আদেশে লিপিবদ্ধ হয়। বইখানি মূলত মারফত সম্বন্ধীয়। কবি শৈখ চান্দ গুরু শাহদৌলাকে নানা জটিল তত্ত¡মূলক প্রশ্ন করেছিলেন। শাহদৌলা ঐ সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন। এরূপ তত্ত¡মূলক প্রশ্নোত্তর ছলে পুস্তকটি রচিত। কিয়ামত নামা নামেই পুস্তকের বিষয়বস্তুর পরিচয় পাওয়া যায়। এই কাব্যের রচনাকাল সম্পর্কে কবি নিজেই বলেছেন, ‘এক সহ¯্র ২২ সনে পুস্তক রচন, শাহ চন্দ ফকির বলে শুন গুণিগণ। ‘হর-গৌরি সংবাদ’ এর মোট পত্র সংখ্যা ১৩। এ একটা ক্ষুদ্র যোগ শাস্ত্রীয় পুঁথি। এ সময়ের সুফি সাধকদের প্রথা অবলম্বনে লিখিত হয়। ‘তালিব নামা’ একখানা চম্পু কাব্য। গদ্যে ও পদ্যে লিখিত বলে পুঁথি খানা বিশিষ্ট। এ গ্রন্থের সাথে কবির শাহদৌলা গ্রন্থের যথেষ্ট মিল আছে। মরমিয়া তত্তে¡ পরিপূর্ণ। এই পুস্তকটি বাংলা গদ্যের একটা প্রাচীনতম নমুনা হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছে।
সয়্যিদ মো. আকবর (১৬৫৭-১৭২০) : তার পুঁথির পাÐুলপি যা উদ্ধার হয়েছে তার মধ্যে ‘জেবলমূলক শামারোখ’। শুকুর মোহম্মদ (১৬৮০-১৭৫০) : তার কাব্যের নাম ‘ময়নামতীর গান’। ত্রিপুরা রাজা গোপী চন্দ্র ও তাঁর স্ত্রী রাণী ময়নামতীকে কেন্দ্র করে যে গান প্রচলিত ছিল, কবি তাকে অষ্টাদশ শতাব্দির গোড়ার দিকে কাব্যে রূপ দিয়েছেন। একে ঐতিহাসিক কাব্য বলা যায়। মো. রফিউদ্দিন : কবির কাব্যের নাম ‘জেবলমূলক শামারোখ’। এর পূর্বে কবি আকবর ১৬৭৩ সালে এই নামে একখানা কাব্য লিখেছিলেন। শেখ সাদী ১৭১২। তাঁর একখানা কাব্য ‘গদ্য মল্লিকা’।
মোগল আমলে বাংলা সাহিত্যের প্রসারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করেছিল ফারসি ভাষা। মুসলমানরা ফারসি ভাষাকে অপেক্ষাকৃত সহজে গ্রহণ করায় বাংলায় মুসলিম বাংলা সাহিত্য স্বাভাবিকভাবে বিস্তার লাভ করে। ষোড়শ শতাব্দির প্রথম পাদ থেকে ব্রজবুলিতে রচনার প্রথা প্রবর্তিত হয়। সপ্তদশ শতাব্দির প্রথম পাদ পর্যন্ত এই রেওয়াজ বাংলায় গান রচনার ক্ষেত্রে অত্যন্ত প্রাধান্য লাভ করে। গোবিন্দ দাস (১৫৩০-১৬১০), জ্ঞান দাস (১৫৩০-১৬১৫), বলরাম দাস (১৫৩০-১৬১০), রায় শেখর, কবি বলভ (১৫৯৮), বিশেষ খ্যাতনামা বৈষ্ণব পদকর্তারা এ সময় ব্রজবুলিতে অজ¯্র পদ রচনা করে বাংলায় ব্রজবুলির মাধুর্যে ভরপুর করে তুলেছিলেন। এই সাহিত্যিক রেওয়াজ অনুসরণ করে বাংলার মুসলমান কবিরা ব্রজবুলি রচনায় মনোনিবেশ করেন। এদের মধ্যে শাহ আকবর, নসীর মাহমুদ, কবীর, সাল বেগ বা সালেহ বেগ, সয়্যিদ মরতুজা, কমর আলী প্রমুখ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন