শক্রবার ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ কার্তিক ১৪৩১, ০৬ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

তিল ধারণের ঠাঁই নেই

দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া, শিমুলিয়া-বাংলাবাজার ঘাট সড়ক পথেও উপচেপড়া ভিড় : ভোগান্তি চরমে

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ১০ মে, ২০২১, ১২:০০ এএম

বেলা সোয়া ১১টা। বাংলাবাজার ঘাটে এসে পৌঁছাল রো রো ফেরি শাহ্ পরান। ফেরিতে দুটি অ্যাম্বুলেন্স আর তিনটি ছোট পিকআপ ভ্যান ছাড়া গিজগিজ করছে মানুষ। তিল ধারণের ঠাঁই নেই। একই অবস্থা দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটসহ সড়ক পথেও। পরিবারের সঙ্গে ঈদ করতে রাজধানী ঢাকা থেকে এভাবেই বাড়ি ফিরছেন সাধারণ মানুষ। এতে চরম ভোগান্তি পড়ছে তারা। গুনতে হচ্ছে বাড়তি ভাড়া।
ঘাট সূত্রে জানা গেছে, বিজিবি মোতায়েনের পরও গতকাল সকাল থেকে মুন্সিগঞ্জের শিমুলিয়া ঘাটে ঘরমুখো মানুষের ঢল নামে। বিজিবির বাধা সত্ত্বেও জোর করে ফেরিতে ওঠেন যাত্রীরা। শিমুলিয়া ঘাট থেকে সকাল ১০টার দিকে প্রায় দুই হাজার যাত্রী নিয়ে ছেড়ে আসে ফেরি শাহপরাণ। এর আগে ১১টি অ্যাম্বুলেন্স ও কিছু যাত্রী নিয়ে আসে ফেরি ফরিদপুর। বাংলাবাজার ঘাট থেকে ফেরি দুটি আবার শিমুলিয়ার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। ফেরি দুটিতে কমপক্ষে পাঁচ হাজার যাত্রী ছিলেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এদিকে, ঘাটে দীর্ঘসময় আটকে আছে অ্যাম্বুলেন্সসহ জরুরি যানবাহন। জরুরি সার্ভিস পারাপারে বিলম্ব হওয়ায় রোগীরাও চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। মাছ, তরমুজসহ কাঁচামালে পচন ধরায় বাংলাবাজার ঘাটে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিসি) লোকজন ও পুলিশকে ঘিরে বিক্ষোভের ঘটনা ঘটেছে।
বাংলাবাজার ঘাট কর্তৃপক্ষ বলছে, অ্যাম্বুলেন্স ও জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ফেরি ছাড়া হচ্ছে না। যখনই অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে ফেরি ছাড়া হয়, তখনই ওই ফেরিতে যাত্রীরা হুমড়ি খেয়ে পড়েন। যাত্রীদের কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।
একই অবস্থা সড়ক পথেও। গতকাল ঢাকা টাঙ্গাইল মহাসড়কে দূরপাল্লার যানবাহন চলাচলে বিধিনিষেধ থাকায় খোলা ট্রাক, পণ্যবাহী ট্রাক, মোটরসাইকেলসহ ব্যক্তিগত ছোট ছোট যানবাহনে গাদাগাদি করে বঙ্গবন্ধু সেতু পার হচ্ছেন তারা।কোথাও মানা হচ্ছে না স্বাস্থ্যবিধি। এতে করে বেড়ে যাচ্ছে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি। আমাদের সংবাদদাতাদের পাঠানো তথ্যে এ চিত্র ফুটে উঠেছে।
বরিশাল ব্যুরো জানায়, আন্তঃজেলা সড়ক পরিবহন বন্ধের সরকারী নির্দেশনার মধ্যেই রাজধানী থেকে মাওয়া হয়ে পদ্মা পাড়ি দিয়ে কাঁঠালবাড়ী থেকে বাস যোগে হাজার হাজার মানুষ নির্বিঘ্নেই বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্নস্থানে পৌঁছে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে বরিশাল বিভাগেই সরকারী হিসেবে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ১৫ হাজার। মারা গেছেন প্রায় পৌনে ৩শ’।
শুরু থেকে যথাযথ প্রতিরোধ ছিল না। ফলে ঢাকা থেকে প্রতিদিন বিপুল সংখ্যক মানুষ মাওয়া’র শিমুলিয়াতে পৌছে যেকোনভাবেই পদ্মা পার হয়ে কাঁঠালবাড়ী পৌঁছে সেখান থেকে অভ্যন্তরীণ রুটের বাসেই ভাংগা-মোস্তফাপুর হয়ে মাদারীপুর ও বরিশালের সীমান্তবর্তী ভুরঘাটায় পৌঁছে যাচ্ছেন। এমনকি কাঁঠালবাড়ী থেকে বরিশাল পর্যন্ত গ্যাস চালিত বিপুল সংখ্যক থ্রী-হুইলারও প্রতিদিন কয়েক হাজার যাত্রী পরিবহন করছে। আর বরিশাল থেকে পটুয়াখালী, বরগুনা, ভোলা ও ঝালকাঠিতে পৌঁছে যাচ্ছেন জেলার অভ্যন্তরীন রুটের বাসসহ বিভিন্ন যানবাহনে।
বরিশাল কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালে ঢাকা থেকে আগত কয়েকজন যাত্রী জানান, ‘মাওয়া এসে পদ্মা পাড়ি দিতেই কিছু কষ্ট ও সময় ব্যয় হলেও আর কোন সমস্যা হয়নি। বরিশাল মিনিবাস টার্মিনালেও একই চিত্র। হাজার হাজার মানুষ ভাঙা ভাংঙা পথে অভ্যন্তরীণ রুটের বাসেই ছুটছে পটুয়াখালী, বরগুনা, ঝালকাঠি ও পিরোজপুরসহ বিভিন্ন এলাকায়।
এদিকে, জনস্রোতকে ‘বর্তমান করোনা সঙ্কটে জনস্বাস্থ্যের জন্য কোন ভাল লক্ষণ নয়’ বলে সতর্ক করে দিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকগন। তাদের মতে, ‘এসব ঘরমুখি মানুষের কতজন যে করোনাভাইরাসের বাহক, তার হিসেব নেই। এরাই দক্ষিণাঞ্চলে এসে নিজ পরিবার ও আত্মীয় স্বজনকে সংক্রমিত করতে পারে’। ‘গত বছরও ঈদের পরেই দক্ষিণাঞ্চলে করোনা সংক্রমণ সর্বোচ্চ হয়েছে বলে স্মরণ করিয়ে দিয়ে ‘সকলকে অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে সতর্ক হবার’ পরামর্শ দিয়েছে চিকিৎসকরা।
মুন্সীগঞ্জ জেলা সংবাদদাতা জানান, মাওয়ায় শিমুলিয়াঘাটে প্রবেশমুখে ২ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা সত্বেও দক্ষিণাঞ্চলগামী ঘরমুখো মানুষের যাত্রা থামানো যাচ্ছে না। ঘরমুখো যাত্রীদের ঢল অব্যাহত রয়েছে। সকাল থেকে হাজার হাজার যাত্রী পারাপারের জন্য শিমুলিয়া ঘাটে ভিড় করতে থাকে। সকালে সকাল ৭ টায় অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে ফেরি ফরিদপুর ও ১০ টার দিকে রো-রো ফেরি শাহপরান ছেড়ে যায় বাংলাবাজার ঘাটের উদ্দেশ্যে। এসময় অ্যাম্বুলেন্সের সঙ্গে শত শত যাত্রী ফেরিতে উঠে পরে।এখনও কয়েক হাজার যাত্রী শিমুলিয়ার ৩ নং ফেরিঘাটে পারাপারের জন্য অপেক্ষা করছে।
ঘরমুখী যাত্রীরা জানান, মাহিন্দ্র ও অটোরিকশায় বাংলাবাজার ঘাট থেকে বরিশাল পর্যন্ত ভাড়া নেওয়া হচ্ছে জনপ্রতি ৮০০ টাকা। মাহিন্দ্র ও অটোরিকশায় কমপক্ষে আটজন বহন করা হচ্ছে। মোটরসাইকেলে বরিশাল পর্যন্ত ২ জনের ভাড়া নেওয়া হচ্ছে ১ হাজার ৫০০ টাকা, খুলনা ২ হাজার ৫০০ টাকা, মাদারীপুরে ৩০০ থেকে ৪০০, ভাঙ্গা ৬০০, ফরিদপুরে ১ হাজার ৫০০ আর গোপালগঞ্জে ১ হাজার ৬০০ টাকা।
বিআইডব্লিউটিসির কর্তৃপক্ষ জানান, শুধু মাত্র লাশবাহী গাড়ী ও অ্যাম্বুলেন্স পারাপারের জন্য দিনে ফেরি চালু রাখা হয়েছে। শিমুলিয়াঘাটের ব্যবস্থাপক (বাণিজ্য) সাফায়েত আহমেদ জানান, সকালে অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে ২টি ফেরি বাংলাবাজার ঘাটের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। কোনো প্রাইভেটকার, পিকআপ ও মাইক্রো প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রশাসক জানান বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে স্থানীয় পুলিশকে সহায়তা করতে ঘাট এলাকায় বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে।
গোয়ালন্দ (রাজবাড়ী) উপজেলা সংবাদদাতা জানান, দৌলতদিয়া পাটুরিয়া নৌরুটে ঢাকা ফেতর ঘরমুখি মানুষের ঢল। করোনাভাইরাস এর ঝুকিঁ নিয়েই হচ্ছে ফেরি পারাপার স্বাস্থ্যবিধির কোন বালাই নেই।
সকালে পাটুরিয়া থেকে ছেড়ে আসা ইউটিলিটি ছোট ফেরি মাধবীলতা দৌলতদিয়া ৫নং ফেরি ঘাটে আসলে দেখা যায় গাদাগাদি করে একজনের ঘা ঘেষে আরেকজন দাঁড়িয়ে আছে। সামাজিক দূরত্ব বা স্বাস্থ্যবিধি কোনটাই মানছেন তারা। বাড়িতে সবার সাথে ঈদ উদযাপন করতে আগেভাগেই ঢাকা ছাড়ছেন তার। সরকার ঘোষিত লকউানের মধ্যে দিনে সীমিতভাবে জরুরি রোগীবাহি অ্যাম্বুলেন্স ও সরকারি কাজে ব্যবহারিত গাড়ি পারাপারের জন্য ছোট ফেরি চলাচল করছে। সেই ফেরিগুলোতে ঢাকা ফেরত যাত্রীর ঢল ছিলো চোখে পড়ার মত।
মাধবী লতা ফেরীর মাষ্টার মেহের আলী বলেন, করোনা কালীন সময় এই ঘাটে সীমিত ভাবে দুই একটা ছোট ফেরি চলাচল করছে । জরুরী রোগীবাহি এ্যম্বলেন্স ও রাট্রের কাজের জন্য কিছু গাড়ি পারাপার করা হচ্ছে। সে সুযোগে গাদাগাদি করে করোনা ভাইরাসের ঝুকি নিয়ে ফেরীতে উঠছে যাত্রীরা।
বিআইডব্লিউটিসি দৌলতদিয়া ঘাট ব্যবস্থাপক ফিরোজ খান বলেন, উর্ধতণ কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ছোট ফেরি চলাচল করছে।তবে জরুরী সেবার এ্যম্বলেন্স এক সঙ্গে ৮ থেকে ১০ টা হলে ছোট ফেরি দিয়ে সে গুলো পারাপার করা হবে। এ ছাড়া রাতে পণ্যবাহী ট্রাক পারাপার করা হবে। ফেরি বন্ধ থাকায় দৌলতদিয়া প্রান্তে যাত্রী ও ছোট যানবাহনের কিছুটা চাপ রয়েছে।
টাঙ্গাইল জেলা সংবাদদাতা জানান, ছোট ছোট দুই সন্তান নিয়ে গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া যাচ্ছেন সালেহা বেগম। স্বামী গাজীপুরের একটি গার্মেন্টসে চাকরি করেন। সেখানেই বাসা ভাড়া করে বসবাস করতেন তারা। ঈদের আগে গার্মেন্টস ছুটি হলেও স্বামীর বাড়ি ফেরা অনিশ্চিত হওয়ায় দুই সন্তানকে নিয়ে রওনা দিয়েছেন তিনি। সেহরি খেয়ে রওনা হলেও কয়েক দফা গাড়ি পাল্টিয়ে বেলা ১০ টার দিকে বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্ব পাড় এসে পৌঁছেছেন।
তিনি জানান, স্বামীর গার্মেন্টস ছুটি হলে ওই সময় চাপ বেশি থাকবে। আমাদের নিয়ে আসা অনেক কষ্ট হবে এই ভেবে আগেই পাঠিয়ে দিয়েছেন। ৫ ঘন্টায় বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্ব পাড় আসলাম। এখন মোটরসাইকেলে ৪০০ টাকা দিয়ে সেতু পাড় হয়ে পশ্চিম পাড় গিয়ে। ভেঙে ভেঙে বাড়ি। সন্তান নিয়ে যাওয়া অনেক কষ্ট হচ্ছে। কষ্ট যতই হোক বাড়িতে পরিবার পরিজন নিয়ে ঈদ করতেই হবে এটাই তার বড় পাওয়া।
শুধু সালেহা নয়, তার মতো আসাদুল ইসলাম, রহিজ উদ্দিন, আব্দুল কুদ্দুসসহ উত্তরাঞ্চলগামী হাজারো মানুষ করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্ব পাড়ে। উদ্দেশ্য বাড়িতে পরিবার পরিজনদের সাথে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করা। তাই যে যেভাবে পারছেন বাড়ি যাচ্ছেন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন