পৃথিবী আজ যেন অন্ধকারে আচ্ছন্ন। দাপুটে অনেক চেনা মুখ আজ মাটির নিচে। খসে পড়েছে অনেক তারকা। বিশ্বকে মাতিয়ে রাখা অনেক কণ্ঠ বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছে। আয়ের চাকা প্রায় বন্ধ। গতকালও যারা ধনী ছিল আজ তারা সর্বহারা। করোনা সব তছনছ করে দিয়েছে। পরিবর্তন করে দিয়েছে পৃথিবীর গতিপথ। পাল্টে দিয়েছে জীবনযাত্রা। করোনার প্রথম ঢেউ থেকে দ্বিতীয় ঢেউ বেশি ভয়াবহ। আরও বেশি শক্তিধর। দেখা দিয়েছে অক্সিজেন সংকট। কৃত্রিম অক্সিজেনের অভাবে অনেক হাসপাতালের অসহায় আত্মসমর্পণ। হাসপাতালে সিট খালি নেই। আইসিইউ বেডের সংকট। চিকিৎসা বিজ্ঞানে এগিয়ে দেশগুলোর চিত্র আরও করুন। মৃত্যুপুরীতে পরিনত হয়েছে উন্নত বিশ্বের অনেক দেশ। ভারত নাস্তানাবুদ হয়ে গেছে। শ্মশানে জায়গা নেই। সৎকারের মানুষ নেই। দিল্লির রাস্তায় পরে আছে করোনায় মৃতের লাশ। প্রতিদিন ভাঙছে করোনায় প্রাণহানি ও আক্রান্তের রেকর্ড। পিছিয়ে নেই বাংলাদেশও। একদিনে শতের উপর মৃত্যুর রেকর্ড রয়েছে। দেশে চলছে লকডাউন। মহামারি থেকে বাঁচতে জনসমাগম এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিচ্ছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। বিশ্বময় একটিই শ্লোগান, ঘরে থাকুন, মাস্ক পড়ুন, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখুন। শারীরিক দূরত্বে থেকে মাস্ক পড়াটাই যখন মহামারির প্রাথমিক প্রতিষেধক। আমাদের দেশের এক শ্রেণির শপিং পাগল দিব্বি ঘুরে বেড়াচ্ছে! যেখানে বলা হচ্ছে, জনসমাগম এড়িয়ে চলতে, সেখানে তারা গাদাগাদির প্রতিযোগিতা লাগিয়ে দিয়েছে। নূন্যতম শারীরিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি মানার বালাই নেই। হাজার টাকার শপিং করতে পারে কিন্তু জীবন বাঁচাতে পাঁচ টাকার মাস্ক কিনতে পারে না তারা। শপিংমল থেকে শুরু করে সাধারণ দোকানপাট ও ফুটপাতে মানুষ ঈদের জন্য কেনাকাটায় হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। এ দৃশ্য শুধু ঢাকাতেই নয় মফস্বল শহর, উপজেলা এবং গ্রামের বড় বড় বাজারেও দেখা যাচ্ছে। শুধু ক্রেতারাই নয়, বিক্রেতাদের বেশিরভাগই মাস্ক ঠিকমতো পরছে না, দোকানে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখারও দৃশ্য চোখে পড়ে না, হাত ধুয়ে কিংবা হ্যান্ড স্যানিটাইজ করে শপিংমলে প্রবেশ করার নিয়মও কেউ মানছেন না। ভারতের ভয়াবহ পরিস্থিতি আমাদের সচেতন করতে পারেনি। এপারের কিছু যুবক-যুবতী, নারী-পুরুষ বুঝতেই চাইছে না, মার্কেটে যে নতুন কাপড়ের সাথে মরণঘাতী করোনাও সংক্রমিত করতে পারে। যারা এ পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যবিধি না মেনে মার্কেটে যাওয়াটা জরুরি মনে করছেন, তাদের প্রতি অভিযোগের আঙ্গুল। করোনা মহামারির ১০ নম্বর বিপদ সংকেত জারি থাকা সত্তে¡ও এক নম্বরের গুরুত্বও মানুষ দিচ্ছেন না। ফলে আতঙ্ক, আশঙ্কা, হতাশা, নিরুপায় আমাদের অনেকের ওপরই ভর করে আছে। আমাদের আশপাশে এমনও দেখা যায়, পছন্দের কাপড় না পেয়ে ঈদ করছে না অনেকে। এসব অপ্রীতিকর দৃশ্য দেখে মনে হয়, ঈদে যেন নতুন পোশাকটাই মূখ্য। আমিরুল মুমেনিন হযরত ফারুকে আজম (রাঃ)-এর ঈদ শপিং এর শিক্ষনীয় ঘটনা রয়েছে। ঈদের আগের দিন অর্ধ পৃথিবীর ন্যায়পরায়ণ বাদশা হযরত ফারুকে আজম (রাঃ)-এর স্ত্রী খলিফাকে বললেন, আমাদের জন্য ঈদের নতুন কাপড় না হলেও চলবে। কিন্তু ছোট বাচ্চাটি ঈদের নতুন কাপড়ের জন্য কাঁদছে। খলিফা বললেন, আমার তো নতুন কাপড় কেনার সামর্থ্য নেই। পরে খলিফা ওমর (রাঃ) হযরত আবু উবাইদাকে এক মাসের অগ্রিম বেতন দেয়ার জন্য চিঠি পাঠালেন। অর্ধ দুনিয়ার শাসক হযরত ওমর (রাঃ)-এর খিলাফতের প্রথম দিকে অর্থমন্ত্রী ছিলেন হযরত আবু উবাইদা (রাঃ)। তখন রাষ্ট্রীয় কোষাগার তিনিই দেখাশুনা করতেন। সমগ্র মুসলিম জাহানের খলিফা যিনি, যিনি অর্ধ পৃথিবী শাসন করছেন, তাঁর এ ধরনের চিঠি পাঠ করে হযরত আবু উবাইদা অশ্রুসিক্ত হলেন। হযরত আবু উবাইদা (রাঃ) খলিফাকে টাকা না দিয়ে চিঠির উত্তরে লিখলেন, আমীরুল মুথমিনীন! অগ্রিম বেতন বরাদ্দের জন্য দুটি বিষয়ে আপনাকে ফায়সালা দিতে হবে। প্রথমত, আগামী মাস পর্যন্ত আপনি বেঁচে থাকবেন কি না? দ্বিতীয়ত, বেঁচে থাকলেও মুসলমানেরা আপনাকে খিলাফতের দায়িত্বে বহাল রাখবেন কিনা? চিঠি পাঠ করে হযরত ওমর (রাঃ) কোন প্রতি-উত্তর তো দিলেনই না; বরং এতো কেঁদেছেন যে তাঁর চোখের পানিতে দাঁড়ি পর্যন্ত ভিজে গেলো। আর হাত তুলে হযরত আবু উবাইদার জন্য দোয়া করলেন, হে আল্লাহ! আবু উবাইদার উপর রহম কর, তাঁকে হায়াত দাও। হ্যাঁ, অর্ধ পৃথিবীর ন্যায়পরায়ণ বাদশা ফারুকে আজমের আর উনার পরিবারের জন্য ঈদের নতুন জামা-কাপড় কেনা হয়নি। উনি চাইলে পারতেন কোন এক যুক্তিতে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে অর্থ নিতে, কিন্তু তা না করেননি; বরং অর্থমন্ত্রীর সাহসী উত্তরের জন্য তাঁকে দোয়া করলেন। এ পৃথিবীতে এমন দৃশ্য বিরল বলেই আজ গণতন্ত্র পাঠ্যবইয়ে আবদ্ধ। ঐ সময়ে ছিল মুক্তবুদ্ধি চর্চার স্বাধীনতা। ছিল জনগণের পূর্ণ অধিকার। তাই তো ফারুকে আজমের শাসনামলে যাকাত গ্রহণকারীর সংখ্যা শূন্যের কোটায় নেমে এসেছিলো। খলিফার শাসন এতো সুচারু ছিলো। এত বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ছিলো যে, বিধর্মী ইতিহাসবিদগণও ফারুকে আজমের প্রসংশা করতে কার্পণ্য করেননি। আর নেতৃত্বের মডেল এ খলিফাই ঈদ করেছেন পুরাতন জামায়। শুধু কী তিনি? না। উনার অবুঝ শিশুও। এগুলো শুধু ইতিহাস নয় বরং ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়েও বেঁচে থাকার প্রেরণা। দিগন্ত জয়ের সাহস। একটু ভাবুন, আমি আপনি সাধারণ মানুষ। কোথায় বাদশা আর কোথায় আমরা। বাদশার ঈদ যদি হয় পুরাতন কাপড়ে আমরা কেন প্রাণ বাঁচাতে পুরাতন কাপড়ে ঈদ করতে পারবো না? ত্রিভুবনের প্রিয় মুহাম্মদ (দ.)-এর অনেক ঈদ পুরাতন কাপড়ে কেটেছে। ইসলামের ত্রাণকর্তা সিদ্দিকে আকবর (রাঃ), পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধনীদের একজন উসমান যুন্নুরায়ন (রাঃ), মওলায়ে কায়েনাত আলী (রাঃ), শ্রেষ্ঠ রমণী খাতুনে জান্নাত মা ফাতেমা (রাঃ), জান্নাতের যুবাসরদার হাসনাইনে করিমাইনের ঈদের ইতিহাস লিখতে গেলে চোখ অশ্রুসিক্ত হবে। আপ্লুত হবে কঠিন হৃদয়ের মানুষও। আমরা এ মহান হাস্তিদেরই অনুসারী দাবীদার। আমরা কেন মনকে মানাতে পারবো না? ঈদকে যদি আসলে ইসলামের প্রধান ধর্মীয় উৎসব বলে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, তাহলে প্রিয় নবী (দ.) ও সাহাবায়ে কেরামের ঈদ পালনের ন্যায় আমাদেরও ঈদ পালন হবে আদর্শ বান্দার পরিচয়। আসুন, এবার ঈদ প্রিয়জনকে বাঁচাতে প্রিয় জনের কাছে গিয়ে নয় বরং প্রিয়জনের জন্য প্রভুর কাছে দোয়ার মাধ্যমে কাটাই। যেখানে আছি সেখানে সুস্থ থেকে পরিবারের সাথে কাটাই। মনে রাখবেন, এটা একমাত্র ঈদ নয়। কিন্তু আপনার জীবন একমাত্র। এ একমাত্র জীবন অবশিষ্ট থাকলে অসংখ্যবার ঈদ করা যাবে। বেঁচে থাকলে অনেক ভ্রমণ করা যাবে। ঈদের পূর্ব রাত সারাবছরের শ্রেষ্ঠ রাতের একটা। এ রাত দোয়া কবুলের সুবর্ণময় মূহুর্তের অন্যতম। হেলায় না কাটিয়ে ইবাদতে কাটুন মর্যাদাপূর্ণ রাতটি। মহান আল্লাহ আমাদের সিয়াম সধনাকে কবুল করুন। এবারের ঈদ হোক ইবাদতে। দোয়া ও প্রার্থনায়। করোনার থেকে মুক্তি পেয়ে বিশ্ব যেন তার চিরচেনা রূপে আবার ফিরে যায় সে প্রার্থনায়। অন্ধকার কেটে যেন আলোর ঝলকানিতে ভরে উঠে এ নীল-গগন। স্বজনের বাড়িতে বেড়ানোর মাধ্যমে রোগ ছড়িয়ে নয়; বরং ঈদ কাটুক মহামহিম খোদার জিকির আর প্রিয় মুহাম্মদ (দ.)-এর দরুদে। অন্ধকার কেটে নতুন সূর্যোদয়ের অপেক্ষায় শেষ করছি।
লেখকঃ সংগঠক ও প্রাবন্ধিক।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন